পিবিএ ডেস্কঃ আগে উচ্চ ফলনশীল ফল ও ফসল ফলানোর কাজ করতেন। গরু লালন পালন থেকে শুরু করে প্রতিপালন করেছেন ছাগলও। তখন তিনি চেষ্টা করেছেন ‘ব্লাক বেঙ্গল গোট’ জাতের ছাগলের খামার দিয়ে। ওই খামারে হরিয়ানা ও রাজস্থানি জাতের বিশেষ কয়েকটি ছাগলও ছিল। কিন্তু নতুন কিছু করার উন্মাদনা ভর করে মাথায়। এরপর ২০১৬ সালে শুরু হয় আরও একটি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা। নতুন সেই ভাবনায় যুক্ত হয় ‘রাস’ ও ‘বায়োফ্লক’ পদ্ধতিতে মাছ চাষ।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের শেষ সম্বলটুকু বিনিয়োগ করেছেন। ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সম্পূর্ণ নতুন এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে তিনি এখন অন্যদের কাছে হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়। এরইমধ্যে দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন একজন তরুণ ও সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে। তিনি আর কেউ নন; রাজশাহীর ইমদাদুল হক।
ইমদাদ বলছেন তার বহুমুখী কর্মপ্রয়াসের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের তীব্র আগ্রহ। ২০১৬ সালে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে ভিয়েতনামে রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়া কালচার সিস্টেম বা ‘রাস’ পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রজেক্ট দেখেন। এরপর ঢাকার সায়েন্স ল্যাবেও একই প্রজেক্ট দেখেন। মূলত সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেই ‘রাস’ পদ্ধতি মাছ চাষ করার পণ করেন। তিন মাসে আটবার ভাঙ্গা-গড়া করেন। শেষ পর্যন্ত বাড়ির উঠানে রূপায়িত হয় তার আজকের এই ‘রাস’ পদ্ধতির মাছের খামার। যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দৃষ্টান্তও।
বাইরে থেকে একটি সাধারণ পাকা বাড়ি মনে হলেও ভেতরে চলছে নীরব এক কর্মযজ্ঞ। এখানে নির্দিষ্ট আবর্তনের মধ্যেই উৎপাদন করা হচ্ছে পোনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করার মত উপযোগী মাছ। একেবারেই নতুন ও বিজ্ঞানসম্মত উদ্ভাবনী পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে একটি বাড়ির মধ্যেই কীভাবে মাছ তৈরির কারখানা করা সম্ভব ইমদাদুল হক জানালেন সেই সাফল্য গাঁথা।
বলা হচ্ছে, মাছ চাষের আধুনিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি হচ্ছে রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়া কালচার সিস্টেম বা ‘রাস’ পদ্ধতি। এর ব্যবহার এবং এর উপকরণ বাণিজ্যে বহু দূর এগিয়েছে চীন। চীনের জানসান এলাকায় ‘রাস’ পদ্ধতির উপকরণ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্হিবিশ্বে এখন মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঝুঁকি এড়াতে ‘রাস’ একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি। এর প্রসার পাচ্ছে দেশেও।
রাজশাহীর কাটাখালী এলাকার বহুমুখী তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ইমদাদুল হক পিবিএ’কে বলেন, বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে বেশ ক’টি খামার গড়ে উঠেছে। তার অন্যতম একটি হচ্ছে তার খামার। ‘রাস’ পদ্ধতিতে ঘরের মধ্যে মাছ চাষ করায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়েছেন রাজশাহীর ইমদাদুল হক। রাজধানী ঢাকায় ‘সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’ পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে।
উৎপাদনমুখী এবং উদ্ভাবনী সাফল্যের সন্ধানে নেমে রাজশাহীর ইমদাদুল হক তাই অনেকটাই সফলতার মুখ দেখেছেন। উৎপাদনমুখী ও উদ্ভাবনী কাজে তার রয়েছে প্রচণ্ড আগ্রহ। বিভিন্ন কৃষি খামারের উদ্যোগের হাত ধরে তিনি এখন সফল মৎস্য খামারি। তাও আবার আধুনিক এই ঘরোয়া পদ্ধতির মাছ চাষে। ঠিক কারখানার মতোই ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি করেছেন মাছের খামার। প্রচলিত কৃষিবিজ্ঞান সমন্বিত পদ্ধতিগুলোকে সাজিয়ে নিয়েছেন অনেকটা নিজের মত করেই।
নিজের খামারে কাজ করছেন ইমদাদুল হক ‘রাস; পদ্ধতি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ইমদাদুল হক বলেন, প্রথমেই পাঁচ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতার একটি ট্যাংক তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে আরও পাঁচ থেকে ছয়টা ট্যাংক করতে হবে। ট্যাংকগুলোর মধ্যে একটি হবে মেকানিক্যাল ট্যাংক। মেকানিক্যাল ফিল্টারের মধ্যে মাছের বিষ্ঠা ঘুরবে। সেগুলো ঘুরে ঘুরে নিচে পড়ে যাবে, এরপরে পানিটা ফিল্টার হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আরেকটি বায়োলজিক্যাল ফিল্টারে পড়বে। বায়োলজিক্যাল ফিল্টারে যাওয়ার পর পানির মধ্যে অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট ও টক্সিনসহ যেসব বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হবে সেগুলো বের হয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটি একটি ট্যাংকেও সম্ভব। তবে পানিটা আরও বেশি বিশুদ্ধ করতে তিনি পাঁচটি ট্যাংক ব্যবহার করেছেন।
বায়ো ফিল্টারের মধ্যে ধাপে ধাপে পানিগুলো যেতে থাকবে এবং বিশুদ্ধ হতে থাকবে। পানিগুলো বিশুদ্ধ হওয়ার পর মোটরের মাধ্যমে রিজার্ভ ট্যাংক থেকে আবারও প্রতিটি মাছের ট্যাংকে পৌঁছে যাবে। যে পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি মাছের মধ্যে ঢুকবে ঠিক ততটুকু দূষিত পানির পাইপের মধ্যে দিয়ে মাছের ট্যাংক থেকে বেরিয়ে যাবে। এভাবে মাছের বিষ্ঠা, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ এবং পানির মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলো পরিশোধিত হচ্ছে বলে জানান ইমদাদুল হক।
‘রাস’ পদ্ধতির পাশাপাশি এখানে যুক্ত হয়েছে মাছ চাষের আরও একটি উদ্ভাবিত পদ্ধতি ‘বায়োফ্লক’। এই পদ্ধতি নিঃসন্দেহে রাস’র চেয়ে একধাপ অগ্রগামী। ‘বায়োফ্লক’র সুবিধা হচ্ছে এখানে খরচ আরও অনেক কম। এখানকার পানিটাকে প্রতিদিন পরিশোধন করারও প্রয়োজন হয় না। পানিটা এখানেই থেকে যাবে কিন্তু প্রোভাইটিক (প্রোবায়োটিক ব্যাকটিরিয়া) দিলে ওখানেই পানি ফিল্টার হয়ে যাবে। প্রোভাইটিকের যে ব্যাকটিরিয়াটা তৈরি হবে তা দিয়ে মাছের উচ্ছিষ্ট খাদ্যে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। যে কেউ বাড়ির মধ্যে থাকা পরিত্যক্ত জায়গায় এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে পারবেন। একটা ১০০ লিটারের ড্রামে ১০০ পিস শিং মাছ দিলে এটা চার মাসে খাওয়ার উপযোগী হয়ে যাবে।এভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে এসে আগের পুঞ্জিভূত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন ইমদাদুল হক। আধুনিক এই কলাকৌশলের সঙ্গে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা যুক্ত করে খুব কম খরচে বাড়িতে তৈরি করেছেন মাছ চাষের অবকাঠামো। তার বাড়ির উঠানই এখন মৎস্য কারখানা। শুরুতে ৫০০ তেলাপিয়া দিয়ে ‘রাস’ পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। এর ১৫/২০ দিনের মধ্যেই ফলটাও পেয়ে গেছেন। কারণ ওজন দিলেই মাছের বৃদ্ধিটা অনুমান করা যায় যে, কতদিনে মাছটা কতটুকু ওজন হবে। এভাবে পরপর দু’বার তেলাপিয়া মাছ চাষ করে লাভের মুখ দেখেন তিনি।
আশাজাগানিয়া সফলতা আসায় এরপর কৈ এবং শিং মাছ চাষ শুরু করেন। সেখানেও সোনা ফলে। কৈ ও শিং চাষের পর এবার দেশি মাগুর ও বিদেশি সৌখিন মাছ চাষ শুরু করেন। তার বাড়িতে গেলে মনে হবে পুরো উঠানটিই যেন জীবন্ত অ্যাকুরিয়াম। লাল, নীল ও সোনালী রঙের মাছগুলো ইমদাদুলের জীবনটাকেও যে রঙিন করে তুলেছে তা বোঝার আর কোনো অপেক্ষা থাকে না।নিজের খামারে কাজ করছেন ইমদাদুল হক সফল কৃষি উদ্যোক্তা ইমদাদুল হক ভেতরে ভেতরে তার ‘রাস’ পদ্ধতির খামারকে নিজের মত করে সম্প্রসারণ করেছেন। এখানে ছোট বড় মিলিয়ে ৪২টি সিমেন্টের ট্যাংক ও ২২টি প্লাস্টিকের ড্রামে প্রায় তিন লাখ লিটার পানিতে উৎপাদন হচ্ছে দেশি শিং, কৈ ও সৌখিন বিদেশি মাছ। একেকটি ট্যাংকে ৬০০ থেকে ১৬ হাজার ৫০০ লিটার করে পানি রয়েছে। আর প্লাস্টিকের ড্রামে ১০০ থেকে এক হাজার লিটার পানি রয়েছে। তবে পুকুরের চেয়ে শতকরা ৩৫ ভাগ খরচেই এখানে মাছ চাষ করা যাচ্ছে।
সেক্ষেত্রে পুকুরের বাৎসরিক লিজের টাকা লাগে না, বিষ লাগে না, সার লাগে না। লাগছে না পাহারাদারের মাসিক বেতনের খরচও। পরিবহন খরচ নেই। জেলের খরচ নেই। এজন্যই শতকরা ৬৫ ভাগ খরচ কম হয়। এই ‘রাস’ পদ্ধতিতে একটি ট্যাংকে সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ কেজি পর্যন্ত মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। তার বাড়িতে মাত্র ১২ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৬ ফুট প্রশস্ত সিমেন্টের একটি পাকা জলায়তনও রয়েছে। যেখানে চাষ করা হচ্ছে বিদেশি জাতের রঙিন সৌখিন মাছের রেণু।
ইমদাদ বলেন, মাত্র এইটুকু আয়তনেই ঠিকঠাকমত রেণু চাষ করলে চার মাসে এক লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। জলায়াতন দেখিয়ে তিনি বলেন, মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের রেণু পোনাগুলো তিনি এখানে কালচার করেন। তারপর তিন থেকে চার মাসের মধেই এগুলো বিক্রি উপযোগী হয়ে যায়। চার মাসে ছয় থেকে সাত হাজার রেণু কালচার করা যায়। ‘বায়োফ্লক’ পদ্ধতিতে যদি এই পরিমাণ জলায়তনে কেউ রেণু পোনা চাষ করেন তাহলে চার মাসে এক লাক টাকা আয় করা সম্ভব। আর এতে খরচ হবে মাত্র পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। তাই তার এই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি দৃষ্টি কেড়েছে সবার।
এছাড়া বাড়ির উঠানে কৈ, কার্প, মিল্কি, গোল্ড ফিশ, কমেট, ব্লাক মোরসহ প্রায় ২৫ রকমের রঙিন সৌখিন মাছ চাষ হচ্ছে। এসব মাছ উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘বায়োফ্লক’ পদ্ধতি।
এখানে শুরুতে অবকাঠামোতে ব্যয় করেছেন আট লাখ টাকা। এটি ছিল স্থায়ী বিনিয়োগ। এরপর মাছ চাষে যা বিনিয়োগ করছেন সেই তুলনায় লাভ পাচ্ছেন প্রায় চারগুণ। বাড়ির উঠানে করা এই মাছের আধুনিক খামার তার ভাগ্য ফিরিয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার ‘রাস’ পদ্ধতির এই মৎস্য খামার সম্প্রসারণে আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান এই সফল উদ্যোক্তা।
পিবিএ/এমআর