পিবিএ ডেস্ক: গুগলের কারসাজিতে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বেই ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে পত্রিকা শিল্প। প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে প্রকাশক-সম্পাদকদের রাতের ঘুম হারাম হলেও গুগলের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান খবর থেকে ঠিকই প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা আয় করে নিচ্ছে।
মনে করুন, গুগলে আপনি সাকিব আল হাসান লিখে সার্চ দিয়েছেন। পেয়ে গেলেন পিবিএর একটি লিংক। ক্লিক করলেন। পড়লেন। বেরিয়ে গেলেন। অথচ জানলেন না গুগল আপনাকে ব্যবহার করে বেশ কিছু টাকা আয় করে নিল। এই টাকার পরিমাণ কত?
বিশ্ব খ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগল কেমন আয় করে, সেটি জানতে ওয়াশিংটন ডিসির গণমাধ্যমভিত্তিক অলাভজনক মৈত্রী সংগঠন ‘নিউজ মিডিয়া অ্যালায়েন্স’-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ২০০০ পত্রিকা যুক্ত। সংগঠনটি বলছে, ২০১৮ সালে গুগল ব্যবহারকারীদের শুধু নিউজ পড়িয়ে ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে! এই হিসাব অনেকাংশে আনুমানিক। প্রকৃত অঙ্ক হিসাব করতে গেলে প্রকাশক-সম্পাদকদের মতো আপনারও ঘুম হারাম হয়ে যাবে।
গুগল এই টাকা আয় করেছে তাদের সার্চ এবং গুগল নিউজের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির আয়ের পরিমাণ শেষ দুটি ‘অ্যাভেঞ্জার্স’ মুভির বিক্রীত টিকিটের দামের থেকে বেশি! শুধু তা-ই নয়; বিশ্বের কোনো পেশাদার ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানও এত টাকা বছরে আয় করে না।
‘নিউজ মিডিয়া অ্যালায়েন্স’-এর প্রধান নির্বাহী ডেভিড চাভার্ন বলছেন, গুগলের এই আয় থেকে সাংবাদিকদেরও প্রাপ্য রয়েছে, কারণ তারাই কনটেন্টগুলো প্রস্তুত করে।
গুগলের ব্যবসার ক্ষেত্রে নিউজ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের ক্লিকের ৪০ শতাংশ আসে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কনটেন্ট থেকে। গুগল সরাসরি প্রকাশকদের অর্থ তো দেয়ই না, বরং বিভিন্ন শিরোনাম পোস্ট করে ক্লিক আদায় করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের পর থেকে বিভিন্ন ব্রাউজার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে কোটি কোটি ডলার কামিয়ে নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কোনো অর্থ না দিয়ে তৃতীয় পক্ষের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন থেকে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ শেষে নামমাত্র অংশ দেয় প্রকাশকদের। বিজ্ঞাপনের প্রায় পুরো অর্থ চলে যায় গুগল কিংবা ফেইসবুকের অ্যাকাউন্টে।
আপনি যখন গুগলে সার্চ করে কোনো নিউজ পড়েন, তখন তাদের ওয়েবসাইটে সেটি কাউন্ট হয়। অনেক সময় নিউজ পড়তে পড়তে কনটেন্টের ভেতর কিছু বিজ্ঞাপন দেখতে পান, এই বিজ্ঞাপনগুলোতে আপনি ক্লিক করলে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু টাকা পায়। বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের বড় একটা অংশ গুগল, ফেইসবুক কিংবা মজিলা নিয়ে যায়। টাকা ভাগ করার এই নীতিমালা নিয়েও আছে বিতর্ক।
রীতিমতো ‘কইয়ের তেলে কই ভাজা’র পাশাপাশি গুগল, ফেইসবুক আবার অন্য ধরনেরও প্রতারণাও করে। নিউজ সাইট তাদের বিজ্ঞাপন না দিলে কনটেন্ট পাঠকের কাছে পৌঁছায় না।
গুগলের আয় খতিয়ে দেখতে নিজস্ব উদ্যোগে ‘নিউজ মিডিয়া অ্যালায়েন্স’ অনলাইনভিত্তিক একটি গবেষণা চালিয়েছে। সংবাদমাধ্যম এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা করছে তারা।
সাংবাদিকদের ঠকিয়ে গুগলের এমন ব্যবসা বন্ধ করতে গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক নেতারা কংগ্রেসে হাজির হন। কীভাবে গুগলের থেকে আরও বেশি অর্থ প্রকাশকরা আয় করতে পারেন, সেটি নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন।
গুগলের ব্যবসার ধরন
গুগলের ব্যবসার প্রধান মাধ্যম বিজ্ঞাপন। এটিকে তারা অ্যাডসেন্স বলে। নিউজ সাইটের পাশাপাশি অন্যান্য সাইটে বিজ্ঞাপন প্রকাশের পদ্ধতি নিয়ে ২০০৩ সালে চালু হয় ‘গুগল অ্যাডসেন্স’। নিউজ সাইট ছাড়াও নিজস্ব ব্লগ, চাকরির ওয়েবসাইট, ভ্রমণের ওয়েবসাইটে এই বিজ্ঞাপন নেওয়া যায়। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে গুগলের আয়টা বেশি হয় নিউজ সাইট থেকে।
যেভাবে কাজ করে অ্যাডসেন্স
www.google.com/adsense এই ঠিকানায় প্রবেশ করে প্রথমে কোনো ওয়েবসাইটকে নিবন্ধন করাতে হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা শেষ করলে নির্দিষ্ট সময় পর আপনি তাদের বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন।
গুগলের কাছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিজ্ঞাপন পাঠায়। সেগুলো গুগল আপনার ওয়েবসাইটে শো করাবে। সাইটের কোথায় কোথায় বিজ্ঞাপন দেখা যাবে, সেটি আপনি নির্ধারণ করে দিতে পারবেন। তবে কী বিজ্ঞাপন দেখা যাবে, সেটি থাকে গুগলের হাতে।
তাই ওয়েবসাইটের কনটেন্ট একটি জরুরি বিষয়। ওয়েবসাইটের কনটেন্ট অনুযায়ী বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে গুগল। অর্থাৎ ওয়েবসাইটের কনটেন্টের সঙ্গে মিল রেখেই সেসব বিষয়ে গুগল অ্যাডসেন্সে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। তাই নিজের ওয়েবসাইটে ঠিক কী ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হবে, সেটি নিজে থেকে ঠিক করার উপায় নেই। এ কাজটি গুগলই করে থাকে। এই বিজ্ঞাপন পেতে ওয়েবসাইটের মালিককে কোনো টাকা দিতে হয় না।
ওয়েবসাইটের মালিকদের যেভাবে অর্থ দেয় গুগল
গুগলের কারসাজি মূলত এখানে। আপনি কখনোই প্রতিদিন এক ধরনের আয় করতে পারবেন না। একেক দিন একেক ধরনের আয় হয়।
বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য একটি ফিচারের মাধ্যমে অটোমেটিক নিলাম করে থাকে গুগল। সেখান থেকে নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার সাইটের জন্য বিজ্ঞাপন ঠিক করে তারা। সব বিজ্ঞাপনের মূল্য এক ধরনের নয়। গুগল তাদের সাইটে লিখেছে, এটি ‘অনেক বিষয়ের’ ওপর নির্ভর করে।
সব বিষয় গুগল নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করে না। তাদের ভাষায়, বিজ্ঞাপনদাতাদের বাজেট পরিবর্তন হলে রেট নেমে যায়, রেট নির্ধারিত হয় সাইটের নির্দিষ্ট কনটেন্ট বিবেচনায় এবং ব্যবহারকারী কোন বিজ্ঞাপনে ক্লিক করছে সেটির বিবেচনায়।
আয়ের হিসাব প্রতিদিন চেক করা গেলেও গুগলকে অনেকেই বিশ্বাস করে না। আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের প্রকাশকরা তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন, তুলছেন। অভিযোগ, সাইট মালিকদের কম টাকা দিয়ে গুগল বেশি নেয়। গুগল এই অভিযোগ এত দিন অস্বীকার করলেও ‘নিউজ মিডিয়া অ্যালায়েন্স’-এর আরেকটি তথ্যের কারণে সেটি এখন আর পারছে না।
সংগঠনটি জানিয়েছে, আমেরিকার কয়েক হাজার পত্রিকা ২০১৮ সালে অনলাইন বিজ্ঞাপন থেকে যা আয় করেছে, গুগল একাই তার প্রায় সমান আয় করেছে! পত্রিকাগুলোর ওই আয় আবার শুধু গুগল নয়; ফেইসবুকসহ অন্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের থেকেও এসেছে। সেখানে গুগলের এমন আয়কে মার্কিন প্রকাশকরা ‘পুকুর চুরি’র মতো ঘটনা বলছেন।
পিবিএ/বাখ