সাতক্ষীরার প্রতারক শাহেদের উত্থান হয় যেভাবে

মনির হোসেন জীবন,ঢাকা: প্রতারণা আর চাপাবাজি দিয়েই উত্থান হয়েছিল উত্তরা ও মিরপুরে অবস্থিত বেসরকারী রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো: সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম ওরফে কাজী শাদেহ। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা দিয়ে সাতক্ষীরার প্রতারক মো: সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম ওরফে কাজী শাহেদের উত্থান জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে এমএলএম ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এমননি ভাবে শাহে খুব অল্প দিনে টাকার অবৈধ পাহাড় গড়ে তোলে। প্রতারণা মামলায় অসংখ্যবার জেলও খেটেছিলেন। সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন আইনশৃংখলা বাহিনী। এর বেশির ভাগই প্রতারণা মামলা। অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার নানাবিধ অপকর্মের নাগালও পায়নি কেউ। কারণ তিনি নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাহেদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সাহেদ অল্পদিনেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার এই উত্থানের বিষয়ে এলাকাবাসীও হতবাক। যদিও সাতক্ষীরায় তাকে সবাই প্রতারক সাহেদ হিসেবেই চেনে। নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টক শো’তে অংশ নেওয়াও শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম ওরফে কাজী শাদেহ । প্রবাদ আছে না- ”চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী”, বিশ্বব্যাপী মরণঘাতী করোনাভাইরাস ( কোভিড-১৯) সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের অনুমতি পেয়ে করোনা রোগীদের পরীক্ষা নিয়ে জাল-জালিয়াতি,প্রতারনা,ভুয়া করেনার রিপোর্টসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করতে গিয়ে অবশেষে এলিট ফোর্স র‌্যাবের হাতে ধরা খেয়েছেন তিনি।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরা মডেল টাউনের ১১ নম্বর সেক্টর ১৭ নম্বর রোড ৩৮ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত বেসরকারী রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।একই সাথে তার মিরপুরের হাসপাতালেও অভিযান চালানো হয়। মঙ্গলবার ও প্রধান কার্যালয় অফিস ও হাসপাতাল সিলগালা করে দিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর এই ঝটিকা অভিযানে নেতৃত্ব দেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সারোয়ার আলম।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মূখপাত্র (পরিচালক) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম আজ গনমাধ্যমকে জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর তারা বেশ কয়েকদিন ধরে গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছিলেন রিজেন্ট হাসপাতালে। সেখানে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে তারা জালিয়াতি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। রিজেন্টের মালিকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
পুলিশ, ডিবি ,র‌্যাব ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় একবার গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এর কয়েক বছর আগেই হাসপাতালের অনুমোদন নিয়েছিলেন তিনি।
আইনশৃংখলা বাহিনীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এবার ভিন্ন কৌশলে চলা শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন সরকারি দফতরে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এসব কিছু কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। যাতে সবাই বুঝতে পারে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চলাফেরা রয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট মালিক সাহেদ বিভিন্ন অপকর্ম করছেন। এ বিষয়ে কেউ কিছু বললেই দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে আরও জানা যায়, গত চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। এজন্য গাঁটের টাকা খরচ করে বিভিন্ন টক শো’তে অংশ নিতেন বলেও জানা গেছে। টক শো’তে বিরোধী রাজনীতিকদের বিষয়ে বেশি বেশি সমালোচনা করা সাহেদের বিরুদ্ধে একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও শোনা গেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকাও খুলেছেন তিনি। নিজেকে সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। এসবই ছিল তার বিভিন্ন অপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচানোর ঢাল।
র‌্যাবের‌ একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা গনমাধ্যমকে জানান, সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তারা প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন। এর বেশির ভাগই প্রতারণা মামলা। কারণ প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার মূল কাজ। এজন্য করোনা মহামারি চলাকালেও স্পর্শকাতর একটি বিষয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে বিবেকে বাধেনি তার।
এদিকে, রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের অপকর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। প্রতারণা করাই যার মূল কাজ, সেই ব্যক্তি কীভাবে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন, কীভাবে কথিত বুদ্ধিজীবী সেজে টক শো’তে অংশগ্রহণ করতেন, তার প্রমোটার কারা–এসব নিয়ে চলছে আলোচনা।
পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...