করোনাকালে যুবকদের মানবসেবা সর্বত্র প্রশংসিত

সামাজিক রুপান্তরে যুব নেতৃত্ব প্রয়োজন

মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা): সমাজের কর্মক্ষম অংশ হচ্ছে যুবক সমাজ। কোন পরিবর্তনের জন্য যে ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োজন তা যুবকরাই সরবরাহ করতে পারে। সামাজিক রুপান্তর একমাত্র যুবকদের দ্বারাই সম্ভব। সম্প্রতি কোভিড-১৯ এর প্রভাব চলাকালিন সময়ে সরকারের পাশাপাশি যুবকদের সক্রিয় ভুমিকার কারণে দেশে খাদ্য সঙ্কট ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের গোসল, দাফন, আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন সেবায় ডাক্তার-নার্সের পাশাপাশি জড়িত ছিল যুবকরা। ২০২০ ও ২০২১ সালে সরকার ঘোষিত লকডাউনে যুবকদের মানবসেবামূলক কার্যক্রম সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুব সমাজ। করোনা ভাইরাস সংকটকালীন সময়ে মানবসেবামূলক কাজে যুবকরা নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। দাঁড়িয়েছে অসহায় ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের পাশে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সব আন্দোলন-দুর্যোগের সময় প্রথম এগিয়ে এসেছিল যুব সমাজ। বরাবরের মতো করোনা মহামারীতেও তারা এগিয়ে এসেছে এবং উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।

সরেজমিন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত কুমিল্লার জেলার মধ্যে করোনায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়। এ উপজেলার যুবকদের উদোগে গঠিত ৩০টিরও অধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের গোসল, দাফন, শ^াসকষ্ট রোগীদের হাসপাতালে নেয়াসহ বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটি সংগঠনগুলো হলো-চৌদ্দগ্রাম প্রবাসী সূর্য সন্তান, আনন্দ সংঘ, স্বপ্নপূরণ ফাউন্ডেশন, পাঁচরা জনকল্যাণ সংস্থা, কাজী এনাম ফাউন্ডেশন, চেতনা ব্লাড ডোনেশন, মানবতার ডাক সামাজিক সংগঠন, ফেলনা হেলথ ফোরাম, লুদিয়ারা নেজামিয়া নূরানী মাদ্রাসা, পথশিশু পুনর্বাসন ও সহায়তা ফাউন্ডেশন, মানবতার পাশে আমরা ও অসহায় ফাউন্ডেশন। এভাবে সারাদেশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে মানবসেবামূলক কাজ করেছে যুবকরা। দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েসহ স্বজনরা যখন কাছে আসছে না, ঠিক তখনই স্বজনের ভুমিকা পালন করেছে যুবকরা। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষের সেবা করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যুবকদের মানবসেবামূলক কাজে সহযোগিতা করেছে শিক্ষার্থীরা। সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কার দুরীকরণেও যুব সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুবকদের ২৪ শতাংশ কৃষিতে, ৩০ শতাংশ শিল্পে এবং ৪৬ শতাংশ সার্ভিসে রয়েছে। এর মধ্যে ২১.০৯ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ১৫.৫৯ শতাংশ হাউসহোল্ডে, ৩.৩৮ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে, ০.৭৬ শতাংশ এনজিও, ৫৮.২৪ শতাংশ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং ০.৯৫ শতাংশ অন্যান্য সেক্টরে কর্মরত রয়েছে। কিন্তু যুবকরা পিছিয়ে রয়েছে নেতৃত্বে। দেশে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের মধ্যে যুবক রয়েছে মাত্র ২ জন। এরমধ্যে বাগেরহাট-২ আসনের সাংসদ শেখ সারহান নাসের তন্ময় ও নড়াইল-২ আসনের সাংসদ মাশরাফি বিন মুর্তজা। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য যা একেবারেই নগন্য। নির্বাচনে তরুণ প্রার্থী কম হওয়ার মূল কারণ তরুণেরা রাজনীতিবিমুখ। এর জন্য বয়স্করাই দায়ী। হানাহানি, মারামারি, ঘৃণা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এবং নিশ্চিহ্নের রাজনীতির কারণে তরুণেরা রাজনীতিকে ভয় পান। বিশেষত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তরুণেরা রাজনীতিতে আসতে চান না। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন জরুরি। এছাড়াও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন ও প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে যুবদের সুযোগ বৃদ্ধি করলেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব।

যুবকদের গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উপকারভোগী আবদুল মান্নান, লতিফ মিয়া ও সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে টাকা সংগ্রহ করে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে তা অসহায়দের মাঝে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করেছে যুবকরা। তারা সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও করেছে। স্বজনদের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে যুবকরা বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়েছে। তাদের এ সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত খুশি’।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন পূরণ ফাউন্ডেশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা মোঃ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকারের একার পক্ষে কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি আমরা(যুবকরা) একত্রিত হয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে করোনা আক্রান্ত ও শ্বাসকষ্ট রোগীদেরকে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও প্রয়োজনমতো খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছি। আমাদের মতো সারাদেশে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রবাসী যুবকদের দেয়া অর্থায়নে এ সেবা অব্যাহত রেখেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও যুবদের অগ্রাধিকার থাকলে সুন্দর ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। সরকারের নিকট গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টরে যুবদের অগ্রাধিকার দেয়ার দাবিও করেন তিনি’।

সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবি ও আন্তর্জাতিক সমাজকর্ম গবেষক ড. নয়ন বাঙালী বলেন, প্রতি বছর ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়। এ দিবসে যুবকদের বিভিন্ন ভালো কাজের উৎসাহ দেওয়া হয়। সকলকে মনে রাখতে হবে, যুবকরা সমাজ পরিবর্তনের দূত হিসেবে কাজ করে। তাদের হাত ধরেই আসে পরিবর্তন। গুজব প্রতিহত করনে, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও দূরীভুত করতে যুবকরা অগ্রণী ভুমিকা পালন করে। তাদের শক্তি, সাহস, বুদ্ধি ও মেধা পুরোপুরি ব্যবহার করা গেলে দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। ভিন্ন চিন্তা করা ও উদ্ভাবনের সাহস, অসম্ভবকে আবিষ্কার, অগম্য পথে গমন করার সাহস, যন্ত্রণা দূর করা ও জ্ঞানকে শেয়ার করার সাহস অদ্ধিতীয়ভাবে শুধু যুবকদেরই আছে। যুবকদের পৃথিবী হবে দারিদ্র, অসাম্য, শোষণ ও প্রতারণা মুক্ত। সেখানে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, ভাষা, লিঙ্গভেদে কোন বৈষম্য থাকতে পারবেনা। ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ঐকান্তিকতা ইত্যাদি দিয়ে যুবকগন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। তাই যুবকদের দিয়ে সীমাহীন চিন্তা মাথায় রেখে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ তৈরির আন্দোলন গড়তে হবে-এই হউক ব্রত।

আরও পড়ুন...