সাহারা খাতুন জনগণের নেতা ছিলেন

পিবিএ,ঢাকা: আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরনো ও বহুমুখী রাজনৈতিক দলের হয়ে একেবারে মাঠের লড়াই-সংগ্রামের ভিতর দিয়ে তৃণমূল থেকে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে আসা সাহারা খাতুনের বাহুল্যহীন সাধারণ জীবনযাপন আর ক্লান্তিহীন রাজনৈতিক দৃঢ়তায় মুগ্ধ ছিলেন প্রবীণ-নবীন সব প্রজন্মের নেতাকর্মীরাই।

তাই সাহারা খাতুনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা হারানো’র ব্যাথা যেমন দলীয়প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও শোকাভিভূত করেছে; ঠিক তেমন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তাঁর লড়াইমুখর জীবনকেই স্মৃতির আয়নায় তুলে ধরছেন। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এমন জীবনকে, যে জীবন ছিল- সংগ্রামের, মাঠের ও মানুষের অধিকার আদায়ের।

গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের দিকে থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেমে যায় আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার জীবনপ্রদীপ। সাহারা খাতুন বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। জুনের শুরুতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে থাইল্যান্ডে নিয়ে গেলেও চিকিৎসকরা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি।

ছাত্রজীবনেই রাজনীতির মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন সাহারা খাতুন। সেই পা আর কোনোদিন রাজনীতি ছেড়ে যায়নি; বরং বিরূপ পরিবেশে নিজেকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলেন রাজনীতির মধ্যেই। দলে বা দলের বাইরে প্রভূত মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছিল তাঁর জীবন।

বছরের পর বছর মাঠের আন্দোলনে সাহারা খাতুনকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। দলের এই প্রভাবশালী নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিলেন সাহারা খাতুন। সেই থেকে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মাঠ ছাড়েননি। একজন নিরলস নির্ভীক, ত্যাগী নেত্রী ছিলেন। আন্দোলন, নির্বাচন আর সংগঠন- প্রতিটি কাজেই তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল।

১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমুর ভাষায়, “সাহারা খাতুন নিজেকে ‘জনগণের নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।’’

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) দেশে আসার পর, তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রামে কাজ করেছেন সাহারা খাতুন। নেত্রীর সঙ্গে গ্রেপ্তারও হয়েছেন এবং নেত্রীও তাঁকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন। দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন তাঁকে।

দল ও দেশের জন্য নিজেকে ‘শতভাগ উৎসর্গ’ করেছিলেন বলেই সাহারা খাতুন একজন ‘আদর্শবান রাজনীতিবিদ’ এবং ‘জনগণের নেত্রী’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সাহারা খাতুন সারাজীবন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

আইন পেশায় সাহারা খাতুনের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মামলার প্রয়োজনে সবার আগে পাওয়া যেত অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে। দুঃসময়ে আমাদের জন্য তিনি কী করেছেন সেটা বলার ভাষা আমার নেই। সব সময় রাজপথেই ছিলেন। টাকা-পয়সা ছাড়া নেতাকর্মীদের মামলা ফেইস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে খুবই খারাপ লাগছে।’

দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ছিলেন সাহারা খাতুন। তেমনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। সাহারা খাতুনকে ‘খালা’ বলে ডাকতেন মেয়র তাপস।

তাপস আরো বলেন, ‘আমি উনাকে খালা বলে ডাকতাম। তিনিও আমাকে সবসময় সন্তানের মতো গভীর মমতায় আগলে রেখেছেন। তিনি আইনজীবী সমাজের জন্য পথপ্রদর্শক, অভিভাবকতুল্য। তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছেন বহু আইনজীবী, অনেক রাজনৈতিক অনুরাগী। তাঁর মৃত্যুতে দেশের আইনজীবী পরিবার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অনতিক্রম্য শূন্যতা তৈরি হল, আমি হারালাম এক পরম আপনজন।’

‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অবিচল থেকে তিনি আজীবন জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত ও মহত্তম যোদ্ধা ছিলেন’, যোগ করেন মেয়র তাপস।

দলের একেবারে নবীন প্রজন্মের কাছেও ‘ডেডিকেশন’ দিয়ে নিজের মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন সাহারা খাতুন। জাদুমন্ত্রবলে কর্মীদের টেনে আনতেন মাঠে-ময়দানে। কর্মীরাও তাঁকে ভালবাসতে কৃপণতা করতেন না। নবীনদের কাছে এমন প্রবীণ-প্রজ্ঞ-পোড়খাওয়াদের চলে যাওয়া তাই মনে হয়, ‘রাজনীতির আরেকটি অধ্যায়ের সমাপ্তি’ বলে।

ঢাকায় এসে সাহারা খাতুনের সঙ্গে প্রথম মিছিলের স্মৃতিচারণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী উপ প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন। তাঁর মতে, ‘সাহারা আপাদের পরিশ্রমের ফসলই আজকের আওয়ামী লীগ।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন, ‘১৯৯৩/৯৪ সালে ৩০/৪০ জন নেতাকর্মী নিয়ে প্রচণ্ড রৌদ্রের মধ্যেও সাহারা আপা ক্লান্তিহীন মিছিল করতেন। মনে আছে রমিজ ভাই? ঢাকার কুড়িল-কুড়াতলী এলাকায় সাহারা আপার পিছনে আপনি নিয়মিত স্লোগান ধরতেন। কুড়িল মৃধা বাড়ি মেস থেকে আপনি, আমি, আমান ভাই, পলাশ ভাই, রিপন ভাইরা ছিলাম মিছিলের নিয়মিত কর্মী। মিছিল নিয়ে হেঁটে হেঁটে মতিঝিল পর্যন্ত চলে যেতাম। এতো দূর হেঁটেও আপা ক্লান্ত হতেন না। কুড়িল থেকে মতিঝিল যেতে যেতে একপর্যায়ে সেই ৩০/৪০ জনের মিছিলে হাজার নেতাকর্মীতে রূপ নিতো।’
পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...