চোখ দুটো ঝিম ধরে আসছে। কাপের পর কাপ চা নিঃশেষ হয়ে চলেছে। দূর থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হবে। কবির হাসান লেখালেখি পেশায় নতুন নাম লিখিয়েছেন। খুব বেশি জনপ্রিয়তা না পেলেও তাঁর পাঠকের সংখ্যা নেহাতি অল্প নয়। বেশ কিছুদিন যাবত তিনি লেখার কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছেনা। বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে পড়েছেন লেখকদের এমন এক সময় আসে যখন কলম আর স্বাচ্ছন্দ্যে চলেনা। একটু পর পরই থেমে যায়। সেই সময়কে ‘রাইটার্স ব্লক’ বলে। তারও হয়েছে এখন একই দশা।
কবির হাসান রোজ সকালে এক গ্লাস গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খায়। যথারীতি আজও পানি গরম করে ফ্রিজের ঢাকনা খুলে দেখে একটা লেবুও অবিশিষ্ট নেই। তাই কোন উপায় না পেয়ে থলে হাতে নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। তাঁর বাড়ি জেলা শহরে। বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব পাঁচ টাকার ভাড়া। কিন্তু তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে সেই ভাড়া এখন দশ টাকায় এসে ঠেকেছে। রাস্তায় নেমে চারপাশের লোকদের ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
হাতে ঝাটা, মুখে বিড়ি, মাথার চুল উসকো খুসকো অর্ধবয়স্ক একটি লোক রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে। এখনো দোকানপাট তেমন খুলেনি। তিনজন বোরখা পরিহিত মহিলা দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে। তাঁরা হয়তো কিছুক্ষণ আগেই ঢাকা থেকে এসেছে। রাতের বাসগুলো খুব ভোরে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে যায়। অল্পকিছু চায়ের দোকান ও ওষুধের ডিসপেনসারি সারারাত খোলা থাকে। দোকানের কর্মচারীগুলো বসে ঝিমাচ্ছে। বেশ ভারি স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে একটা ছেলে পড়তে যাচ্ছে। ছেলেটির চোখমুখে এখনো ঘুমের ভাব লেগে আছে। কবির হাসান তন্ময়ভাব কাটিয়ে রিকশা খোঁজার দিকে মনোনিবেশ করলো। তবে আজ মনে হয় রিকশা পাওয়া যাবেনা। সে রিকশা চালকদের নিয়ে একটা গল্প লিখবে বলে ভেবেছিলো। কিন্তু লেখাটা কিছুতে শুরু করা হচ্ছেনা। একজন অর্ধবয়স্ক লোক রিকশা চালিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি রিকশা চালককে
ইশারা দিয়ে ডাকলো,
এই খালি।
চালকটি হাসিমুখে তাঁর দিকে এগিয়ে আসলো।
কই যাবেন?
নতুন বাজার। যাবে?
বিশ টাহা ভাড়া।
বলো কি? এতো ভাড়া নাকি? পনের টাকা দিবো যাবে?
জি উইঠা বসেন।
কবির হাসান বেশ আয়েশ করে রিকশায় উঠে বসলো। রিকশা চলতে শুরু করেছে। সদর হসপিটালের সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাঁর বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠলো। এটাকে রাস্তা না বলে ছোটখাটো একটা ডোবা বলা যেতে পারে। কবির হাসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, এটা কোন কথা! একটা ব্যস্ততম রাস্তা যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের যতায়াত। সেই রাস্তার এই বেহাল অবস্থা! আমরা কোন দেশে বাস করছি? যারা এইসব তদারকির দায়িত্বে থাকে তাঁরা কি গাজা খেয়ে সারাদিন ঘুমায় নাকি?
রিকশা চালকটি এতক্ষণে বেশ কৌশলে ঝাঁকি কাটিয়ে ভাঙা রাস্তাটি পার করে বললো, কি আর কবো বলেন? দেশের অবস্থা এখন ভালো না। যে হারে জিনিস পত্তর দাম বাড়তাছে। আমাদের সোজাসুজি গুলি করে মারবার পারতেছে না তো তাই না খাওয়ায়ে মারবার চেষ্টা করতাছে।
ভোর বেলা বেশ ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। চারিদিকে আবছা অন্ধকার ভাবটা এখনো কাটেনি। কবির হাসানের মাথায় বেশ কিছু লেখার বিষয় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। কিন্তু কিভাবে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা এখনো ভেজা। কবির হাসান খুব মন দিয়ে রিকশা চালকের পোষাক দেখতে লাগলো। মাজায় গামছা বাঁধা, শতছিন্ন লুঙ্গি, শার্টির জায়গা জায়গা পটি দেয়া। কালো প্লাস্টিকের জুতোয় ফাটল ধরেছে। পোষাক দেখা শেষ হলে রিকশা চালানোর কৌশল এমনকি রিকশাটিকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
বয়স্ক চালকটি অকস্মাৎ কাশতে শুরু করলো। খুব কষ্টে কাশি থামিয়ে সে বললো, বুঝলেন বাবাজী ক্ষমতা হইলো একটা তাজ্জব জিনিস। কেউ এইডারে ছাড়তে চাইনা। আমাগোর এই শহরের দায়িত্বে যে মেয়র আছে। হে দশ বছর ধইরা এই শহররে চুইষা খাইছে। এহেবারেই যে কিছু করেনি তা কিন্তু না, করছে সামান্যই। নির্বাচন আইলেই তাঁর কাজ কর্মের নমুনা বেশি দেখবার পারা যায়। মেলা সময় ধরে গদিতে থাকলে খাইতে খাইতে যা বাঁচে তাই দিয়া আমাগোর জন্য কিছু কাজ করে। কিন্তু নতুন কেউ গদিতে বইলে হে দশ বছর ধইরা খাইতে পারে নাই আগে খাইবো। খাইতে খাইতে বদহজম হইয়া হাগতে হাগতে কাহিল হইয়া পড়লেও খাওয়া বন্ধ করবার নাম নিবো না। সত্যি কথা হইলো বাপধন আমাগোর গরিব মানসের কোন দিকেই শান্তি নাই।
হাসান কবির মনোযোগ সহকারে কথা গুলো শুনছিলো। তিনি এবার বেশ গম্ভীর মুখে বললেন, তোমার অভিব্যক্তি গুলো বেশ তাৎপর্যবহ। এটা নিয়ে লেখালেখি করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু লিখতে পারবো না। আমি এখনো বেকার। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। এই সময় রাজনীতি নিয়ে সরকার বিরোধী কিছু লিখলে আমার চাকরির আশা ছাড়তে হবে। এত বছর ধরে লেখাপড়া শিখলাম। এখন যদি সরকারি চাকরি না পায় তাহলে লোকে কি বলবে? আর নিজেকেই বা বোঝাব কিভাবে।
বাজার নিকটে চলে এসেছে। রিকশাটি বাজারের পাশে থামলো। পনের টাকা ভাড়া ঠিক হলেও তিনি বিশ টাকায় দিলেন। টাকা হাতে নিয়ে বয়স্ক লোকটি বললো, আপনারা শিক্ষিত মানুষ। আপনারাই যদি এখন চুপ কইরা থাকেন তাইলে আমরা যাই কই।
কবির হাসান পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর চিন্তাজগতে আকস্মিক ভাবে আলোড়ন খেলে গেল। সারাজীবনে অর্জিত আত্মদর্শন তাঁর বিবেকের কাছে কড়া নাড়তে লাগলো। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে কিছু শব্দ বেরিয়ে আসলো ‘আমি কি সুশিক্ষিত’?