তুষার আবদুল্লাহ : তুষার আবদুল্লাহ অবশেষে নির্বাচন কমিশন আত্মশুদ্ধির পথে বুঝি হাঁটতে শুরু করলো। মানুষ শেষ পর্যন্ত নিজ বিবেকের কাছে গিয়ে নতজানু হয়। আত্মপ্রতারণারও একটি সীমারেখা থাকে। কোথাও না কোথাও থামতে হবেই। বা থামতে হয়। নির্বাচন কমিশন কি সেই মাইলফলকে পৌঁছে গেছে? প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের বক্তব্য আপাতত সেই সংকেতই দিচ্ছে। শুক্রবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছেন– রাতে ব্যালট বাক্স ভরার প্রবণতা রোধেই নির্বাচন কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমের দিকে ঝুঁকছে। তার বক্তব্যে আরও ছিল, ‘সমাজে নানারকম অসাধু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জালিয়াতির চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের জালিয়াতি প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে আবার একটি আইন বা নিয়ম তৈরি হয়। সমাজে একটার পর একটা অনিয়ম অনুপ্রবেশ করে, আবার সেটি প্রতিহত করতে একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। আমরা এখন চিন্তা করছি ইভিএম শুরু করে দেবো, তাহলে সেখানে আর জালিয়াতি করার সুযোগ থাকবে না।’
তিনি বললেন, ‘জনগণ দেশের মালিক, তারা ভোট দিতে যাবেন এবং আমরা যারা দায়িত্বে থাকবো, আমরা নির্বাচন পরিচালনা করবো। ভোটাররা ভোট দেবেন, ভোট দিয়ে চলে যাবেন, কোনও সমস্যা থাকবে না।’
এ যেন অচেনা প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটের সময়ও তাকে এমন করে পাননি ভোটাররা। যে কথা বিএনপি নেতারা ৩০ ডিসেম্বরের পর বলাবলি করছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা অভিযোগ করে আসছেন। অধুনা মহাজোট থেকে নির্বাচন করে নির্বাচিত রাশেদ খান মেনন যে কথা বলছেন, সেই সুর খানিকটা পাওয়া গেলো সম্মানিত সিইসি’র জবানীতে। যার কমিশন সারাদিন ভোটারের অপেক্ষায় থাকা ভোটকেন্দ্রগুলোতেও রেকর্ড সংখ্যক ভোটের পরিসংখ্যান দিয়ে আসছিল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের মতবিরোধ আগারগাঁও কমিশন ভবনে আটকে রাখা যায়নি। জগতের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। ভোট পরবর্তী সময়ও তাদের মধ্যকার শীতল লড়াইয়ে উষ্ণতা ফেরেনি। এখন উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন তারা কথা বলতে শুরু করেছেন, তখন অনেক সুবচন ও আত্মশুদ্ধিমূলক বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে। যেমন, সুনামগঞ্জে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বললেন, ‘কোনও নির্বাচনে পূর্বরাত্রে ভোট বাক্সে ব্যালট ভরে দেওয়া। ভোটের পরে ভোটগণনার সময় কোনোরকম অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না’। সিইসির মতো তিনিও পূর্বরাতে ভোটবাক্সে ব্যালট ভরে দেওয়ার কথা তুললেন। অবশ্য তারা কবে কোন নির্বাচনে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, সেই উদাহরণ তুলে ধরেননি। অভিজ্ঞতা যে তাদের হয়েছেই বা হতেই হবে তা নয়। সাধারণ ভোটাররা বিষয়টি ইতিবাচক ভাবে দেখছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, নির্বাচন কমিশনের চোখ ৩৬০ ডিগ্রির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এবং তারা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষায় সচেতন হয়ে উঠছেন হয়তো। তারই অংশ হিসেবে ভোটাররা যে দেশের মালিক সেই উপলব্ধিটুকুও ফিরে পেতে চলেছেন।
নির্বাচন কমিশনের এই আত্ম উপলব্ধি যদি হয় সাময়িক, তাহলে ভোটার এবং রাষ্ট্র দুঃখ পাবে। ভোটার এবং রাষ্ট্র সেই কবে থেকে দেখে আসছে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সরকারের চাল-কৌশলের কিভাবে হেরে গেছে। এখানে নির্বাচন কমিশন ব্যবহৃত হয়েছে যদি বলি, এবং তাতে কমিশন কষ্ট পাওয়ার আগে ভোটার মাত্রই বেদনায় নীল হবেন। কারণ ভোটাররা কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বারবার এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিই ভরসা রাখতে চেয়েছে। নিজেরা নানা মত, প্রতীকে বিভক্ত হলেও অহংকার করতে চেয়েছে নির্বাচন কমিশনের ব্যক্তিত্বের। কিন্তু কমিশন খুব কমই ভোটারদের অহংকারে উজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। সামনের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি বা বড় বিরোধী দল মাঠে না থাকায়, আওয়ামী লীগের মধ্যেই পক্ষ –বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। ভোটাররাও যে খুব মজে গেছে ভোট নিয়ে তা বলা যাবে না।
তবে অংশগ্রহণমূলক ভোটের সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলোও নিকট ভবিষ্যতে প্রকৃত অংশগ্রহণ মূলক ভোটের মাঠে ফিরবে। ফিরতে তাদের হবেই। কারণ প্রকৃত রাজনীতির স্বাদ পেতে হলে সেখানে ফেরা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। ক্ষমতা তখনই উপভোগ্য হয়, যখন সেখানে রাজনীতি থাকে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য, বিএনপির বয়সও রাজনীতির মাঠে কম হয়নি। উভয় দলে রাজনীতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেতারও ঘাটতি নেই। ক্ষমতামুখি উচ্চফলনশীলদের দমিত করে তারা প্রকৃত রাজনীতির মাঠে সমবেত হবেনই। তখন নির্বাচন কমিশনকে আপন শক্তিতেই জ্বলে উঠতে হবে। দেখাতে হবে ব্যক্তিত্বের ঝলক। নির্বাচন কমিশন সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছে, এই বিশ্বাস রাখতে চাই আবারো।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি