গল্পটা বলি। ২০ জুলাই বিকেল। মোহাম্মদপুর। কারফিউ চলছে। কিন্তু সকাল থেকেই মোহাম্মদপুরে আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। আন্দোলকারীদের মধ্যে কেউ কেউ গাড়ি ভাংচুর করছে, কেউ টায়ার পুড়িয়ে উল্লাস করছে। বলে রাখা ভালো মোহাম্মদপুরে আন্দোলকারীদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল আশেপাশের সাধারণ মানুষ। শিক্ষার্থীও ছিল, কিন্তু সংখ্যাটা আনুপাতিক হারে অনেক কম। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছালাম বেলা তিনটায়।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড। গাড়ি থেকে নেমে যখন দেখি অবস্থা বেগতিক, তখন নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রেস লেখা ভেস্ট পড়ে দাঁড়ালাম, পুলিশের পেছনে। সেখানে আরো কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। সেখানে আমি আর মানবজমিনের শরিফ রুবেলসহ আরেকজন ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম ,ঠিক তখনই কানে নিচে দিয়ে কি যেন একটা গেলো ভয়ঙ্কর শব্দ করে। পরে দেখলাম এক পুলিশ সদস্য অস্ত্র নাড়াচাড়া করছেন, তখন মিস ফায়ার হয়েছে। ধরেই নিলাম , আনাড়ি পুলিশ। কোনোরকম কাজ চালানোর জন্য রাজারবাগ থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। ভাগ্যিস সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি।
দফায় দফায় সংঘর্ষ করে পুলিশ সদস্যরা প্রায় ক্লান্ত। কেউ পানি খাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।। আবার কেউ কেউ অনেক জুনিয়র পুলিশ সদস্য টেলিভিশনে বুম দেখে আগ বাড়িয়ে কথা বলছে আমার সঙ্গে। লাইভ করছি কীনা জিঙ্গেস করছে। তবে পুলিশ সদস্যদের পিছনে যেহেতু দাঁড়িয়েছি, তাদের মধ্যকার অনেক কথাই কানে আসছে। তারা কি বলছে, তাদের মনোভাব কি সবই বোঝার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে দুই তিন জন পুলিশ সদস্য নিজেদের মধ্যে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে বকাঝকা করছে, যাকে গালি বলে। তাদের অভিযোগ সেনাবাহিনী কেন, অ্যাকশনে যাচ্ছে না। যদি অ্যাকশনেই না যায়, তাহলে তারা মাঠে নামছে কেন , এখানে আসছে কেন। এই ধরনের কথাবার্তা।
পুলিশের এই বিশ্রামের ফাঁকে আন্দোলনকারীরা সামনের দিকে আগাচ্ছে। ঢিল ছুড়ছে। পুলিশের দাবী আন্দোলনকারীদের টার্গেট বিআরটিসির বাস টার্মিনালে আগুন দিবে তারা। তাই যে করেই হোক এদিকে আসা বন্ধ করতে হবে। তাই পুলিশ সদস্যরা বরাবরের ন্যায় ফাঁকা গুলি ছুড়ছে, চাইনিজ গুলি ছুড়ছে। বলে রাখা ভালো চাইনিজ গুলি মানে তাজা বুলেট। এই গুলি শরীরে পড়লে জীবন নাশ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এই গুলি খেয়ে কয়েকজন আহত হতেও দেখেছি তখন, গুলি খেয়ে সদ্য জবাই করা মুরগির মতো কাতরাতেও দেখেছে অনেককে। একদিকে পুলিশ গুলি ছুড়ছে, অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা ঢিল তো ছুড়ছেই , সেই সঙ্গে পুলিশকে তাদের বাবা মা নিয়ে যাচ্ছে তাই গালি দিচ্ছে। এর মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য গুলি ছুড়া বন্ধ করেছে পুলিশ। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়েছে।
এখন আবার সেনা সদস্যদের এন্ট্রি। সকাল থেকেই এলাকায় সেনাসদস্যরা ছিলেন। তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বার বার কথা বলেছেন। যখনই সেনাসদস্যরা তাদের কাছে গিয়েছেন, আন্দোলকারীরা শান্ত ব্যবহার করেছেন। তার বিপরীত যখন পুলিশ সদস্যরা যখন গিয়েছেন , তখন আন্দোলকারীরা উগ্র আচরণ করেছেন।
তখন আনুমানিক ৫.২০ বাজে। তখন মাথার উপর থেকে সুর্যটাও সরে গেছে প্রায়। তবে সেনা সদস্যরা না সরে গিয়ে ধীরে ধীরে আগাচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্যাট সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে আগানোর আগে , নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্যাট ও সেখানকার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বার বার সেনাবাহিনীর কাছে গিয়েছে, কথা বলেছে। তাদেরকে হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টার ফল , তারা সামনের দিকে আগাচ্ছেন। সেনাবাহিনী যত সামনের দিকে আগাচ্ছে পুলিশ সদস্যরা তত পিছনের দিকে অর্থাৎ সেনাবাহিনীর পিছন পিছন অবস্থান নিয়েছে। আর পুলিশের পিছনে অবস্থান নিয়েছে বিজিবি। যদি বলি এখনকার মিশনটিতে তিনটি স্তর করে আগানো হচ্ছে। আর বিপরীত পাশের রাস্তায় আর্মড পুলিশ।
সেনাবাহিনীর একজন হ্যান্ডমাইক দিয়ে আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। এই ফাঁকে এক কিশোর স্টেপ ডাউন হাসিনা প্লেকার্ড নিয়ে সামনের দিকে আগাচ্ছে। এর মধ্যে সেনাসদস্যরা তার দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছে। তাকে বার বার সরে যেতে বলা হচ্ছে, কিন্তু ওই কিশোর সরছে না। বরং আরো এগিয়ে আসছে। কি দৃশ্য! কি সাহস! একেই বলে বিপ্লব ।পরে অবশ্য কিশোরটি বাধ্য হয়ে পিছনে ফিরে গেছে। তার সাহস দেখে বাকি আন্দোলকারীরা তাকে জড়িয়ে ধরেছে, তাকে উৎসাহ দিচ্ছে।
যেটা বলছিলাম , সেনাবাহিনী যখন হ্যান্ডমাইকে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে, তখন আন্দোলকারীরা বলছিলেন এই মূহূর্তে দরকার , সেনাবাহিনীর সরকার। আবার কেউ কেউ পুলিশকে গালি দিয়ে সেনাবাহিনীকে বলছিলেন , পুলিশে সরিয়ে রাখার জন্য। আর না হয় তারা সরবে না। এসব কথা বলে আন্দোলকারীরা তখন সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে আসছিলেন। ঠিক তখনই সেনাবাহিনী ফাঁকা গুলি ছুড়ছিলেন।
এই যখন অবস্থা। তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল ভালো ছবি। যেহেতু ইন্টারনেট নেই, একটি অ্যাজ লাইভ দেয়া যেতে পারে। সহকর্মী সাজু ভাইকে বলছিলাম ক্যামেরায় ফ্রেম দেয়ার জন্য। শুরু করলাম অ্যাজ লাইভ। একে একে করে পুরো ঘটনা বলছিলাম, এর মধ্যে সেনা সদস্যরা
অ্যামবুশ হয়ে পড়লেন। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি অ্যামবুশ হয়ে তারা আসোলে কি করছেন। (মাটি শুয়ে পজিশন নিয়ে ) তখনও অ্যাজ লাইভে বলে যাচ্ছিলাম, সেনাবাহিনী ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। সেনাবাহিনীর যখন এই অবস্থা , তখন পুলিশ সদস্যরা রাস্তার পাশে গলিগুলোতে গুলি ছুড়ছিলেন, এতে কয়েকজন আহতও হয়েছেন। যদিও তখনই মনে হয়েছিল, গলিতে গুলি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। গলির দৃশ্য উৎসুক জনতা ভীড় ছিল মাত্র।
এখনো আমি অ্যাজ লাইভে আছি। সেই সাথে সেনাসদস্যরা অ্যামবুশ হয়ে এক এক করে গুলি ছুড়ছেন আন্দোলনকারীদের উপর। এই যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র। তারপরও অ্যাজ লাইভে বলে যাচ্ছিলাম সাউন্ড বুলেট মারছে সেনা সদস্যরা। প্রায় নয় মিনিট বিশ সেকেন্ড এজ লাইভ করছিলাম, পুরো সময়টাই অ্যাকশনে ছিল সেনাসদস্যরা। লাইভ শেষ করলাম। এবার ধীরস্থির ভাবে পুরো ঘটনাটি জানার জন্য এক জায়গায় দাঁড়ালাম। একজন সেনা সদস্যদের সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করলাম। দেখি কি বলে। কিন্তু খাতিরের ফাঁকেই আবার অ্যামবুশ হয়ে পড়লেন সেনা সদস্যরা। একে একে গুলি ছুড়তে থাকলেন । কিন্তু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না আন্দোলন। এর মধ্যে দুই থেকে তিনটি কিশোর মাটি লুটিয়ে পড়েছে, তাদের পায়ে গুলি লেগেছে। কি আর্তনাত! তখন একজন সদস্যকে বলতে শুনা যাচ্ছিলো, স্যার,দুটা ডাউন!
এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার থেকে শুরু করে একটি কিশোরের পায়ে গুলি লাগা পর্যন্ত সেই ফুটেজও আমার কাছে রয়েছে। আন্দোলন দমাতে এই যখন অবস্থা। বিশেষ করে কিশোরদের পায়ে গুলি লেগেছে, তখন অনেক সেনা সদস্যদের দেখেছি মোরালি ডাউন হয়ে যেতে । তাদের আক্ষেপ দেখেছিলাম সেই দিন। ভীষণ মন খারাপ হয়ে পড়েছিল তাদের। তাদের সঙ্গে যখন আলাপ করছিলাম, তখন তাদের অনেককেই দেখেছি , আহতদের সঙ্গে তাদের সন্তানদের তুলনা করতে। এরপর ঘন্টাখানেক সেনাসদস্যরা তারা তাদের ফায়ার বন্ধ রেখেছিল।
মনে আছে ? বলছিলাম এক সেনাসদস্যের সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করছিলাম। চলুন তার সঙ্গে এবার একটু কথা বলার চেষ্টা করি। ওই সেনা সদস্য বলছিলেন , তারা অ্যামবুশ( শুয়ে পজিশন ) হয়ে গুলি করছিলেন, কারন তারা যদি দাড়িয়ে গুলি করতেন , তাহলে অনেক মানুষ স্পট ডেট হয়ে যেতো, বুকে গুলি লাগতো। তাই তারা শুয়ে গুলি করেছেন যেন আন্দোলনকারীদের পায়ে লাগে, মানে জীবন অন্তত বেঁচে যায়। যাদের পায়ে গুলি লেগেছে তাহলে তাদের কী হবে? তারা স্বাভাবিক জীবনে নাও ফিরতে পারে, হাড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে, পা’টাও কেটে ফেলে দেয়া লাগতে পারে।
আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছিলাম, কি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন। তাদের অনেকেই বলেছিলন দেশে তৈরী রাইফেল ও এলএমজি, ব্যবহার করা হয়েছিল । লাইভ এমও( তাজা বুলেট) আরেকটি সাউন্ড গ্রেনেডের মতোই একটি বুলেট ব্যবহার করা হয়েছিল।
কথা বলতে বলতেই মাগরিবের আজান। একদল আন্দোলনকারী রাজপথেই নেমে পড়ে নামাজ পড়তে। ইমামও ঠিক। সবাই মিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেখানেই নামাজ শেষ করেছে। এরপর আবার হ্যান্ড মাইক দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বলছিলেন , তারা যেন সরে যায়, কিন্তু নাছোড়বন্দা আন্দোলনকারীরা কোনোভাবেই সরছিলেন না। আবার সেনাবাহিনীর ফাঁকা গুলি করতে করতে সামনের দিকে আগাচ্ছিলেন,তারপর পুরো এলাকা ছত্রভঙ্গ । তখও সেনাবাহিনী লাইভ বুলেট(তাজা বুলেট) দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখেছি আমি। সবাই দিক বেদিক ছুটাছুটি করছে। যেহেতু অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, রাতও তখন সাড়ে আটটা। তখন কেউ হতাহত হয়ে কীনা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সেনাবাহিনী সেই দিন কেন গুলি চালিয়েছিলেন? বিকেল তিনটার পর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকা পুরোটাই ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পুলিশ , বিজিবি, আর্মড পুলিশ। কাউকেই মানছিলেন না আন্দোলনকারীরা। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা তাজা বুলেট মারছিলেন আন্দোলনকারীদের ওপর। তারপরও দমাতে পারেননি তাদের । অনেক মারা যাওয়ার খবর শুনা যাচ্ছিলো, কিন্তু যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে শুরু থেকেই এই ঝামেলার মধ্যে যেতে চাননি সেনাবাহিনী সদস্যরা। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে এমনটাই মনে হচ্ছিলো আমার। কিন্তু সেখানকার পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখেছি, ক্ষনে ক্ষনে সেনাসদস্যদের কাছে যেতে। তাদের বোঝাতে। তাতেও রাজি হচ্ছিলো না তারা। তখন একজন উর্ধ্বতন এক সেনাসদস্যকে দেখেছিলাম বার বার ঘাড় নেড়ে না বলতে। তারপর ওই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তাদেরকে মাঠে নামানো হয়। এবং গুলি ছুড়ার অনুমতি দেয়া হয়। পুরো সময়টায় ওই মেজিস্ট্র্যাটকে কখনো সেনাবাহিনীর সামনে, কখনো পিছনে, কখনো ঊর্ধ্বতন সেনাবাহীর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।
লেখক : মোহাম্মদ ওমর ফারুক, অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।