পিবিএ,খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উপজেলা সদর মাইসছড়ি নুনছড়ি এলাকায় ১৪৮১টি সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়চূড়ার পবিত্র তীর্থস্থান আন্তর্জাতিক মানের ‘দেবতা পুকুর’ উদ্দেশ্যে উঠতে হয়। আদিবাসীর পাহাড়ি মারমা ভাষায় নেহ: কায়ইং এবং ত্রিপুরা ভাষায় মাতাই পুখুরী। বাংলায় দেবতা পুকুর। সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা ১লা বৈশাখে মানস করা পূজা, পর্বন এবং শরিল গোসল মাধ্যমে শুদ্ধ করে প্রথম বছরের স্বাভাবিক ভাবে চলার গতি সূচনা করে সাধারন এলাকাবাসীরা। অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে পুরানো প্রবাদ বাক্য ছিল দেবতা পুকুরে ভাল মনের অধিকারী হয়ে মনোসিদ্ধে ”যাহা মনে চাইতো-তাহাই পূরন হয়ে আসতো”। এক কথায় আলাদিনের চাড়াকের গল্পের মতোই সত্যিই ভাবে মিলে যেতো।
এখন তা প্রাকৃতিক হওয়ার পরিবর্তনের ফলে সাধারন মানুষ যারা যে কোন চাইতে যেতো, তারা কথা দিয়ে কথা না রাখায় মিথ্যা আশ্রয়ে ঢুকে পড়ায় বাস্তবে তা আর হয়না বা পায়না। পাহাড়চূড়ার অপরূপ এক পবিত্র প্রাকৃতিক পুকুর। পর্যটকদের কাছে এটি যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের কাছে যার যার ধর্মীয় বিশ্বাসের অত্যান্ত পবিত্র জায়গা। সেখানে গেলে মনের বাসনা চাওয়া পূর্ণ হয়। এমনটাই বিশ্বাস করেন সনাতন(হিন্দু) ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।
স্থানীয় আদিবাসী ত্রিপুরাদের মতে, পাহাড়ের উপরের এই পুকুরের পানি কখনো কমে না এবং পানি পরিষ্কারও করতে হয় না। তাই স্থানীয় নাম নেহ: কায়ইং বা মাতাই পুকুরী বা দেবতা পুকুর। বছরের অধিকাংশ সময় পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায় এ পুকুরকে কেন্দ্র করে।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ১০কিলোমিটার দূরে মাইসছড়ির নুনছড়িতে প্রায় এক হাজার ফুট উপরে অবস্থিত স্বচ্ছ পানির অপূর্ব প্রাকৃতিক পুকুর। ত্রিপুরা ও মারমা অধ্যুষিত নুনছড়ি গ্রামের কিছুটা মাটির পথ যাওয়ার পর শুরু হয় সিঁড়িপথের যাত্রা। এই পুরো যাত্রা পাহাড় দেখার ষোলআনা পূর্ণ করে। পাহাড়ের বুকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখা যাবে সুবজ পাহাড়ের ভাঁজ, মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। স্থানীয়দের সংগ্রামী জীবনও দেখা যাবে এখানে।
হাটি-হাটি পা-পা করে সচরাচর পাহাড় বেয়ে উঠতে কষ্ট হলেও এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ আগে একাধিক পাহাড়ের মাটির পথ বেয়ে পুকুরে যেতে হতো। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পথ ধরে যাতায়াত ছিল কষ্টের। তবে ২০১৫সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড নুনছড়ি থেকে দেবতা পুকুর পর্যন্ত তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের সুবিধার জন্য সিঁড়িসহ অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়। সেখানে একটি শিবমন্দিও ও বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করা হয়।
সারা বছর কমবেশি তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের উপস্থিতি থাকলেও বিশেষ করে বাংলা নববর্ষ বা বৈসাবি’র প্রথম দিনগুলোতে হাজারো তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকের দেখা মেলে এখানে। কথিত আছে স্থানীয় বাসিন্দাদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল দেবতা স্বয়ং এ পুকুর খনন করেন। পুকুরের পানিকে স্থানীয় লোকজন দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করেন। প্রচলিত আছে যে, এ পুকুরের পানি কখনো কমে না।
স্থানীয় পর্যটক জয় দে ও সম্প্রীতি ত্রিপুরা বলেন, সুযোগ পেলেই আমরা দেবতা পুকুরে ঘুরতে যাই। আগে পুকুরে পৌঁছাতে দেড় থেকে দু’ঘণ্টা সময় লাগতো। কিন্তু এখন সিঁড়ি বেয়ে ৪৫মিনিটের মধ্যে পৌঁছানো যায়। এছাড়া বিশ্রামের জন্য সিঁড়িপথের বিভিন্ন স্থানে বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বয়স্করাও ঝিড়িয়ে ঝিড়িয়ে সহজে যেতে পারবেন। দেবতা পুকুর পৌঁছাতে ১৪৮১টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় বলেও জানান তারা।
ঢাকার ট্র্যাভেল গ্রুপ ‘আমার টাকায় আমি ঘুরি গ্রুপ’র অ্যাডমিন কুমু নেসা ও পার্থ দাশ বলেন, দেবতা পুকুরের পুরো যাত্রাপথ এক কথায় অসাধারণ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। তারপর সবুজ পাহাড়ে ঘেরার মাঝখানে স্বচ্ছ পানির পুকুরটি দেখতে মনোমুগ্ধকর।
অপর পর্যটক নুরুজ্জামান তালুকদার ও মো: টিটু বলেন, যতটুকু জানি পাহাড়ে পানির থাকেনা, অনেক সমস্যা। বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ করতে হয়। সেখানে পাহাড়ের উপরে পানির এমন উৎসব সত্যিই অবিশ্বাস্য।
বর্তমানে খাগড়াছড়ির অন্যতম দু’টি পর্যটন স্পটের মধ্যে একটি দেবতা পুকুর ও অপরটি মায়ূং কপাল সিঁড়ি বা হাতির মাথা সিঁড়ি। দু’টোতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পর্যটকসহ সবার সুবিধার্থে সিঁড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে। হাতির মাথা লোহার সিঁড়ির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩শ ২০ফুট এবং দেবতা পুকুরের সিঁড়ির দৈর্ঘ্য প্রায় ২হাজার ৫শ ফুটেরও বেশি বলে জানান স্থানীয়রা।
সামনে চোখ জুড়ানো দিগন্ত জোড়া প্রকৃতির অপরুপ সুন্দর সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের চূড়া দেবতা পুকুর থেকে নেমে আসে ছোট ছোট ক্ষুদ্র কনার পানি ঝরনাধারা ছড়ায় পরে চেংগী নদীতে গিয়ে পড়ে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বহমান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২হাজার ৫শ’ ফুট উপরে অবস্থিত দেবতা পুকুর। পাহাড়ের পর পাহাড়ে সাজানো সবুজ অরণ্য দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে এ জনপদকে করেছে আলাদা। ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের ফলে স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। দেশের এ পাহাড়ি অঞ্চল পর্যটকদের কাছে বরাবরই দারুণ আকর্ষণীয়। এ জনপদ পর্যটকদের কাছে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি স্থানীয়দের কাছে ‘ভূস্বর্গ’পুরী এ টিলা হয়ে উঠতে উঠতে পাহাড়ের চুড়ায় পৌছলে দেবতা পুকুর’। এলাকার জনশ্রুতি আছে, শুদ্ধ মনে দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা-পার্বন দিয়ে যাহা খুজবে তাহা মনের বাসনা পূরন পান।
দেবতা পুকুরে যাওয়ার পথির মধ্যে মাইসছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্বের বিলের খাগড়াছড়ি নতুন বিমান বন্দরের জন্য ইতি মধ্যে ভুমি অধিগ্রহনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে ফেলেছেন জেলা প্রশাসন। দেবতা পুকুর, ভগবান টিলা ও রিছাং ঝরনায় যাতায়াতে অবকাঠামো উন্নয়নের কথা সরকার ভাবছে, তবে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পর্যটকদের যাতায়াতে অসুবিধা হয়। সাজেক অদুরে আরেক সাজেক ভগবান টিলা পর্যটকদের কাছে নতুন আর্কষণ হতে পারে। ট্রেকিং প্রিয় পর্যটকরা এটি ঘুরে আসতে পারেন।
সবুজে ঘেরা বাঁশের ঝোঁপ, নাম না জানা নানা ধরনের পার্থিব ডাক আর পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনার কলকল শব্দ মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য স্থান। দেবতা পুকুরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার দাবি উঠেছে স্থানীয়দের মধ্যে। তাদের মতে, দেবতা পুকুরকে আন্তজাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে ভিড় করবে দেশ-বিদেশের হাজারও ভ্রমণপিপাসু তীর্থযাত্রী ও পর্যটকরা। বদলে যাবে জেলা শহরে আর্থ-সামাজিক অবস্থা। ব্যাপক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হবে এলাকার সাধারন মানুষ। যা ইতোমধ্যে স্থানীয়দের ভ্রমণের উৎস হয়ে উঠেছে। দেবতা পুকুরকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে বেড়াতে আসা অনেকেই উপভোগ করছেন এর সৌন্দর্য।
মাইসছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজাই মারমা জানান, নেহ: কায়ইং বা মাতাই পুখুরী বা দেবতা পুকুর হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় তীর্থ স্থান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন জায়গা। সে জায়গায় পাশাপাশি হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। তীর্থ যাত্রীদের সমাগম প্রচুর ঘটে। বিশেষ করে অসুখ-বিসুখে মানস করা ব্যক্তিরা এ জায়গা এসে মনোবাসনা পুরন করে।
স্থানীয় ১নং খাগড়াছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান আম্যে মারমা জানান, এটি পাহাড়ের সনাতন(হিন্দু) ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের তীর্থযাত্রা ভগবানের আর্শীবাদই এ দেবতা পুকুর। স্থানীয়রা বেড়াতে আসলেও বাইরের পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। এখানে যাতায়াত অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও মোটামুটি যোগাযোগ সুবিধা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে রাস্তা উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণ আরো করা হলে পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের অন্যতম আন্তর্জাতিক স্পট হিসেবে জায়গা করে নিতে পারবে। তৈরি হবে মানুষের নতুন অপার সম্ভাবনাময় কর্মসংস্থান।
নুনছড়ির বাসিন্দা মিলকি মারমা বলেন, ‘সাজেকে বসে মেঘের খেলা দেখতে দলে দলে পর্যটকরা সাজেক ছুটছেন। এখানেও দলবেঁধে মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকে আসছেন। এখানকার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থিত ‘নেহ: কায়ইং’ বা দেবতা পুকুরকে ঘিরে এ জনপদে অর্থনীতির দুয়ার খুলে দিতে পারে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র।’
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সন্জিতা কর্মকার বলেন, দেবতা পুকুর সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান এবং ভূমি পাহাড় আমাদের সম্পদ। দেবতা পুকুর এক সম্ভাবনাময় রহস্যময় পাহাড়ের পানির স্তুপ। আন্তজাতিক মানের পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা ও উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে আরো বেশী প্রয়োজনীয় সম্ভাব্যতা যাচাই করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
সচেতন মহলের অভিমত, রুপওয়ে বা ক্যাবল কার সংযোগ স্থাপিত হলে দেবতা পুকুর টিলাটিকে আর্ন্তজাতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠা পাহাড়ের সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে-এমনটিই মনে করছেন স্থানীয়রা। পর্যটকদের যাতায়াতে অবকাঠামো অরো উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। আগত পর্যটকদের গাইড সুবিধাও দেবেন তারা। জেলাতে দিন দিন যখন বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যা; সাজেক ভ্যালী, মাটিরাঙ্গা আলুটিলা সুরংগ গুহা, রিছাং ঝরনা, তৈদুছড়া ঝরনা ও বাদুড় গুহার পরে দীঘিনালার সীমানা পাড়ায় সন্ধান মিলেছে প্রায় শত ফুট উঁচু ‘তুয়ারি মাইরাং ঝরনা’। যা ইতোমধ্যে পাহাড়ের পর্যটকদের কাছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে নতুন সন্ধান পাওয়া শত ফুট উঁচু এ দেবতা পুকুর, টিলা ও ঝরনা দেখতে স্থানীয় পর্যটনপিপাসু ছাড়াও বাইরে থেকে অনেকেই আসছেন। এসব পর্যটকদের নিরাপত্তা ও গাইড সুবিধা দিচ্ছে স্থানীয়রা।
পিবিএ/চাইথোয়াই মারমা/এসডি