সেন্টমার্টিন যেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য

বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ-ই প্রকৃতি প্রেমিক। মন খারাপের দিনে কিংবা মনকে কিছুটা আন্দোলিত করতে সময় পেলেই তারা ছুটে যান প্রকৃতির কাছে। প্রাকৃতিক রূপ-সৌন্দর্য্য উপভোগের যতগুলো স্পট রয়েছে, তার মধ্যে সেন্টমার্টিন অন্যতম। প্রকৃতি যেন তার রূপ-যৌবন উন্মুক্ত করে দিয়েছে এখানে। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন সেন্টমার্টিন। যে কোনো ছুটির দিনগুলোতে এখানে বেশি ভিড় দেখা যায় ভ্রমণ পিপাসুদের। পর্যটন এলাকার ১৭ কিলোমিটার দ্বীপের চার পাশে নীল বর্ণের পানি। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ মানুষের জীবনকে সত্যিকারভাবে রাঙ্গিয়ে দেয়। তাই সুযোগ থাকলে ঘুরে আসুন স্বপ্নদ্বীপ সেন্টমার্টিন।

https://www.youtube.com/watch?v=DxhBqqoz6B0&t=1s

যা আছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে: দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ। টেকনাফ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় সেন্টমাটিনের অবস্থান। ১৭ কিলোমিটার জুড়ে এ দ্বীপ। সৈকতের মূল আকর্ষণ প্রবাল পাথর, সমুদ্র তীরে সারি সারি নারিকেল গাছ, নীল জলরাশি। এ দ্বীপের অপর নাম নারিকেল জিঞ্জিরা। রাতে দ্বীপটির সৌন্দর্য্য বেড়ে যায় বহুগুণে। তবে নারিলেকের দাম কিন্তু চরা। ডাব প্রতি পিস বিক্রি হয় ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। এই দ্বীপটির আদি নাম জিঞ্জিরা। চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যাতায়াতের সময় বিশ্রামের জন্য বেছে নেওয়া হতো এই দ্বীপ। ১৮৯০ দশকে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে প্রথম বসবাস শুরু করে। এরা সবাই মাছ শিকারে বের হতেন। মাছ শিকার করেই চলতো তাদের জীবন। প্রথমে মাত্র ১০টি পরিবার এখানে বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে এখানে বসবাস করছে এক লাখের বেশি মানুষ। তবে এখন সেখানে বেশির ভাগ মানুষই বাঙালি। সেখানে গড়ে উঠেছে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বেলা ১২টায় সেন্টমার্টিন: কক্সবাজার থেকে জাহাজ কর্ণফুলি এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৭টায় ছেড়ে ১২টায় পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিন। জাহাজ থেকে প্রথমে দ্বীপের ব্রীজে পা রাখার পরে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য দেখে হন মুগ্ধ সবাই। কিছু দূর যেতে না যেতেই পায়ে চালিত রিকশার স্টপিজ। দর কষাকষি করে রিকশায় উঠে হোটেলে পৌঁছে যাবেন অনায়াসেই। পূর্ব থেকেই বুকিং করা হোটেলের কক্ষে জিনিসপত্র রেখে দলবেঁধে সবাই বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। অপরূপ দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন আসছেন হাজার হাজার মানুষ। নাফ নদীর মোহনার পাশ জুড়েই সাম্পান আর অতিথি পাখির কিচির-মিচির শব্দ মুগ্ধ করে সবাইকে। মনে রাখতে হবে, পানি থেকে শুরু করে যে কোনো কিছু কেনার সময় দাম-দর করে নিতে হবে। লজ্জা পেলে ঠকতে হবে। হোটেলে খাবার খেতে গেলে অব্যশই অর্ডার দেওয়ার আগে প্যাকেজ জেনে নিতে হবে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও টি-শার্ট পড়ে ছাপিয়ে পড়তে পারেন দ্বীপের সী-বিচে। পুরো বিচ জুড়ে শুধু মানুষ আর পায়ের কাছে ঢেউ। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে কিছু জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকা একটি বাড়ি। নাম সমুদ্র বিলাস। এটি প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আহমদের বাড়ি। যে কারণে ব্যতিক্রম একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার আছে এতে। এখানে খালি পায়ে বিচে নামা নিষেধ। নামলেই পা মচকানো কিংবা ছিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে প্লাস্টিকের জুতা ব্যবহার করা জরুরি। যা বিচের আশপাশে কিনতে পাওয়া যায়। আর বিচে ঘুরতে গিয়ে তা স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে ক্যামেরাবন্দি করবেন না, তা তো অসম্ভব। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা হাতে ফটোগ্রাফার অনেক পেয়ে যাবেন বিচে। তবে চুক্তি করে না নিলে ঠকতে হতে পারে। ছবি প্রতি ৩ টাকা খরচ করে বিভিন্ন স্টাইলে ক্যামারা বন্দী হচ্ছেন অনেকেই। সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়েও বিচে ঘোরা যাবে। সাইকেল ঘন্টা ৫০ টাকা আর মোটরসাইকেল ঘন্টা ১২০ টাকা ভাড়া গুনবে হবে।

ছেড়া দ্বীপে এক ঘন্টা: ফজরের আজানের ধ্বনি কানে যেতেই ঘুম ভেঙে যায়। আর ভোরেই না উঠলে বঞ্চিত হতে হবে সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছেড়া দ্বীপ দর্শণ। কারণ সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেড়া দ্বীপে যাওয়া শুরু করে স্পীডবোট কিংবা ট্রলার। বেলা বাড়লে রোদের তাপ বেড়ে যায়। তখন সৌন্দর্য উপভোগের চেয়ে শারীরিক অস্বস্তিই বেশি লাগে। যে কারণে অনেকেই সঙ্গে বমির ট্যাবলেট, স্যালাইন, পানি রাখেন। আর সকাল সকাল গিয়ে বেলা বাড়ার আগে চলে আসাই ভালো। সেন্ট মার্টিন থেকে স্পীডবোটে ছেড়া দ্বীপে যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিট। জনপ্রতি ভাড়া সাড়ে ৩’শ থেকে ৪শ’ টাকা। আর জেটি বোটে ভাড়া জন প্রতি ২৫০ টাকা। কিন্তু সময় লেগে যায় ৫০ মিনিট। তাই ভাড়া একটু বেশি গেলেও বেশির ভাগ মানুষই যান স্পীডবোটে। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে পাথর আর পাথর। ছেড়া দ্বীপ সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি। যা দেখে মনে হবে আলাদা কোনো দেশ। কারণ ছেড়া দ্বীপে সব সৌন্দর্য্য সমুদ্রের পানির রং নীল। মনে রাখতে হবে ছেড়া দ্বীপে পাথরে পা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্লাস্টিকের জুতা ব্যবহার করতে হবে। স্পীডবোট ছেড়াদ্বীপের ২শ’ ফিট আগে মাঝ সমুদ্রে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে ডিঙ্গি নৌকায় করে দ্বীপে যেতে হয়। নৌকায় ১০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। ছেড়া দ্বীপে পা দিতেই যেন পাথরের মেলা। অনেকেই ভয় পায় ঢেউ দেখে। কোমড় সমান ঢেউ চলে আসে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই চলে যায়। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্পীডবোট থেকে নামার এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরতে হবে। কেননা যে স্পীডবোট নিয়ে যায়, সেটাতেই ফিরতে হয়। তাই বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হয়। দ্বীপটি খুবই ছোট, তাই ৪০ মিনিটের মধ্যেই ঘুরে দেখা যায়। সেখানে গেলে খাবার কিছু সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। কারণ সেখানে ডাব ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।

গভীর রাতে সেন্টমার্টিন: রাত যতই গভীর হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৌন্দর্য্য তত যেন বেড়ে যায়। যেন এক মজার রাজ্যে। চাইলে গভীর রাতেও নেমে পড়তে পারেন সমুদ্রে। গোছল করে নিতে পারেন টলটলে স্বচ্ছ পানিতে। পানির রঙ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। রাতের নির্জনতা জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। জ্যোৎস্না রাত হলে আরো ভালো। সারারাতই দোকান খোলা থাকে। গভীর রাতেও যা মন চায় খাওয়া যাবে। নিরাপত্তার দিক থেকে কোনো প্রকারই সমস্যা নেই। গভীর রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সমুদ্রের পাড়ে বসে বাতাসের হিমেল হাওয়ায় মনটা সতেজ হয়ে উঠে। তবে একা একা নয়, সঙ্গী থাকলেই ভালো হয়। সেখানে সব ধরনের সেবা খুব সহজেই পাওয়া যায়। সব সেবা যেন হাতের মুঠোয়।

সেন্টামার্টিন নিয়ে যা বলেন আগত পর্যটকরা: কথা হয় ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনে ঘুরতে আসা লিজা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছুটির ফাঁকে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে এসে খুবই ভালো লাগছে। অনেকের মুখে সেন্টমার্টিনের গল্প শুনেছি। সত্যিই মনোমুগ্ধকর। নিরাপত্তা ছিলো জোরদার। পুলিশ সব সময় টহলে থাকে। যে কারণে কোনো ধরনের ভয় লাগে না। ছোট এই দ্বীপের সৌন্দর্য্য যতই দেখছি ,মুগ্ধ হচ্ছি।

শিশু পুত্র আরস বলেন, ভালোই লাগছে সেন্টমার্টিন। পানিতে নেমেছিলাম। ঢেউ দেখে প্রথমে ভয় পেলেও পড়ে আনন্দে ভিজেছি।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ নুর আহমদ বলেন, সেন্টমার্টিন ছোট দ্বীপ হলেও আমরা সব সময় পর্যটকদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকি। এখানে কোনো মেয়ে পর্যটকদের উত্ত্যক্ত করা হয় না। যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সেন্টমার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মুস্তাকিম হোসাইন বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সব সময় সাদা পোশাকে পুলিশ থাকে। রাতে প্রস্তুত থাকে মোবাইল টিম। যাতে করে ভ্রমণ পিপাসুদের চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে। এছাড়া সমুদ্রের পাড়ে রাত-দিন ২৪ ঘন্টার জন্য থাকে টহল টিম। তাই দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ পিপাসুদের নিরাপত্তা দিতে সব সময় প্রস্তুত থাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাই নিবিঘ্নে চলাচল করতে পারন পর্যটকরা। সাধারণত কোনো প্রকার সমস্যার খবর আসে না।

আরও পড়ুন...