শফিকুল ইসলাম খোকন: ছোটকাল থেকে কয়েকটি কথা শুনতাম ‘রক্ষক যখন বক্ষক’, ‘শ্রমিক কখনো মালিক হতে পারেনা’ ‘সেবক কখনো, মালিকের উপর উঠতে পারেনা’ ইত্যাদি। এসব কথাগুলোর সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে মিলও থাকে। আবার আমাদের দেশে আরও একটি কথা প্রচলন রয়েছে সেটি হলো ‘দেশের মালিক জনগণ’। সংবিধানেও সেটি বলা আছে। আসলে কি বাস্তবে দেশের মালিক কি জনগণ? না, শুধু কাগজ কলমেই একথাটি অঙ্কিত রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সরকারী কর্মকর্তারা হচ্ছে জনগণের সেবক। সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ আর সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনগণ হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। আর সেই মালিক যখন সেবক হয়, আর সেবক যখন মালিক হয় তখন কি বলা যেতে পারে? সেবকের জায়গা কিভাবে মালিকের স্তরে বা তার উপরে হয়? আমরা দেখেছি ভিআইপি বা ভিভিআইপি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং যাদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তারা কারা? সংবিধান অনুযায়ী কি তারা ভিআইপি? ফেরি পারাপার হতে না পারায় তিতাস ঘোষ নামে এক কিশোরের মৃত্যূর বিষয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলও ঠিক একই কথা বলেছেন- ‘সেবকরা কীভাবে ভিআইপি হয়?’ আমি তার সাথে একমত পোষন করে বলছি, একটি জীবনের চেয়ে ওই যুগ্ম সচিবের মর্যাদা কি বেশি হতে পারে? আমি মনে করি না। একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবনের চেয়ে ওই ‘ভিআইপি’ সরকারি কর্মকর্তাই গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাদের কাছে। একটি জীবনের চেয়ে সে যেই হোকনা কেন স¦য়ং প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিও হয় ওই জীবনের বাঁচানোকে গুরুত্ব দিবেন। তাহলে কেন এরকমের অমানবিক আচরণ? উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে মানুষের সাথে এ রকমের আচরণ কতটুকু সমিচীন? এমন প্রশ্ন শুধু আমার নয়, হয়তো গোটা দেশের আপমর জনসাধারণের;
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, একজন অতিরিক্ত সচিবের গাড়ির অপেক্ষায় ফেরি পার হতে তিন ঘণ্টা দেরি হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা এক রোগীর মৃত্যু হয়। স্বজনদের অভিযোগ, ঘাটের বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তা, পুলিশ সবার কাছে অনুরোধ করার পরও ওই কর্মকর্তা না আসা পর্যন্ত কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ফেরি ছাড়েনি। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল তবু ফেরি চালু করা যায়নি। পরে প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর অতিরিক্ত সচিবের গাড়ি আসলে “ফেরি কুমিল্লা” যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায়। নদী পার হওয়ার আগেই রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারা যায় ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ (১৩)। বিষয়টি গভীরভাবে ভেবেন দেখুন? চোখ বুঝে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন- আগে রোগী না ভিআইপি? অ্যাম্বুলেন্স আটকে কি ভিআইপি চলাচল করবেন? পৃথিবীর কোনও দেশেই রোগীর চেয়ে ভিআইপিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আর একজন যুগ্ম সচিব কি ভিআইপি? সরকারি চাকুরেরা আবার ভিআইপি হন কীভাবে? একজন সরকারি চাকুরে তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের চাকর নাইবা বললাম। তবে এটি বলতে পারি তিনি জনগণের সেবক। হ্যাঁ, তিনি একজন শিক্ষিত ও উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা তাকে আমরা গুরুত্ব দিব এবং দিতেও হবে। কারণ তারা দেশের জন্য কাজ করছেন। তার অর্থ এই নয় একটি জীবনের চেয়ে তাদের মুল্য বেশি দিতে হবে। তবে কোনোভাবেই শাসক হতে পারেননা। তাদের অবহেলার কারণে মৃত্যূ মানা যায়না। নাগরিকদের সার্ভিস দেওয়াই তার কাজ। নাগরিকদের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হয়। তাই তাদের মনে রাখা উচিত তারা নাগরিকদের চাকর, চাকুরে। যদিও নৌ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সংবাদটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়- দাবি করে বিবৃতিতে ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রণালয় জানায়, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ফেরিতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সেবায় নিয়োজিত। বিআইডব্লিউটিসি বর্তমানে প্রবল স্রোতের মধ্যেও ফেরি সার্ভিস চালু রেখেছে। তারা সব সময় অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য যানবাহন পারাপারে জরুরি সার্ভিস দেয়।
আমরা দেখে আসছি বা আমাদের পুর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের দেশে বড় বড় অথবা যে কোন ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি করা হয়। ঠিক এটিও তার বিপরীত নয়; ঔ যুগ্ম সচিবের এ ঘটনা নিয়েও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব শাহনওয়াজ দিলরুবা খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্য রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম। কমিটি আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে। তদন্ত হবে, প্রতিবেদন জমা হবে, তারপর…। ইতিপুর্বে যতগুলো তদন্ত হয়েছে তার কয়টি আলোর মুখ দেখেছে অথবা কয়টির আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? আমরা চাইনা গতানুগতি তদন্ত হয়ে প্রতিবেদন শেষ, এরকম যেন না হয়। সঠিক তদন্ত করে আলোর মুখ দেখতে চাই, অপরাধী যেই হোকনা কেন তাকে আইনের আওতায় আনতেই হবে। উনি (যুগ্ম সচিব) যদি ভালো কাজ করে থাকেন কখনো তাহলে তাকে স্যালুট, আর ওনার অবহেলার কারণে যদি তিতাসের মৃত্যূ হয় তাহলে তার প্রতি ধিক্কার; সম্প্রতি দেশে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সবই অমানবিক। এটিও তার বাইরে নয়। বিগত দিনে এরকমের বহু ঘটনাই আমাদের দেখতে হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই- বাংলাদেশ মানবতায় বিশ্বাস করে, বাংলার মানুষ মানবিক, বাংলার প্রধানমন্ত্রী মানবতার প্রশংসরা কুড়িয়েছেন। কিন্তু সেই দেশে এ রকমের অমানবিক কাজ পরিহার করতে হবে, আমাদের মুল্যবোধকে চাঙ্গা করতে হবে, অহংকার মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা মানুষ হতে পারবো বা মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারবো।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।