অবৈধভাবে সাগরপথে নৌকা উল্টে মারা যাচ্ছে তরুণরা

স্বপ্নের দেশ ইউরোপ যাত্রায় স্বপ্নভঙ্গ

মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা): ইউরোপ। আছে অনেক টাকা। এ কারণে উচ্চবিলাসী জীবন যাপনের আশায় স্বপ্নের দেশ ইউরোপ যেতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে পাড়ি জমাচ্ছে শত শত তরুন। এদের মধ্যে কেউ কেউ যাত্রা পথে সাগর বা জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করছে। তাদের অনেকের খবর পায় না পরিবারের কেউ। এক কথায়-স্বপ্নের দেশ ইউরোপ যাত্রা পথে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে অসংখ্য তরুনের। অবৈধ পথে যাওয়ার সময় কতজন মৃত্যুবরণ করেছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশী তরুণদের মৃত্যুর খবর প্রচার হলেও কার সন্তান মারা গেছে-অনেক সময় সে পরিচয় নিশ্চিত হতে পারে না পরিবার। দীর্ঘদিন খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা তরুনের আশা ছেড়ে দেন।

চলতি বছরের গত ২ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অভিবাসন বিষয়ক অনুষ্ঠানে বুড়িচং উপজেলার বাসিন্দা জার্মান ফেরত মোঃ সবুজ তাঁর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি স্থানীয় একজনের মাধ্যমে ২০০৪ সালে বয়স বাড়িয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে। এরপর এক দালালের খপ্পরে পড়ে সাড়ে ৮ লাখ টাকা করে মৌখিক চুক্তিতে তিনিসহ এলাকার ১৮ জনের একটি টিম ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সড়ক ও সাগর পথে তারা বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুর্কি, গ্রিস, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, অষ্ট্রিয়া এবং সর্বশেষ জার্মানিতে পৌঁছান। এরমধ্যে ১৮ জনের টিমটি ইরান পৌঁছার পর বিভিন্ন দেশের শতাধিক তরুণ ওই টিমে যোগ দেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনিসহ কয়েকজন জার্মানিতে পৌঁছতে পেরেছেন। ১৮ জনের টিমের ১২ জন বেঁচে ছিলেন। অন্যদের সম্পর্কে দালালরা তাদের কাছে কিছুই স্বীকার করেনি। অনেককে টাকার দাবিতে নির্যাতন করতে দেখেছেন মোঃ সবুজ।
মোঃ সবুজ আরও উল্লেখ করেন, জার্মানিতে এক বাঙালির অধীনে একটি কোম্পানীতে কাজ করতেন। সে দেশের ব্যাংকে তার মোটা অঙ্কের টাকা জমা ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জার্মানির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই বাঙালীর দেয়া তথ্যে তাকে আটক শেষে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে স্বপ্নের দেশ ইউরোপ যাত্রা করে অসংখ্য তরুণের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। সড়ক ও সাগর পথে মারা যাওয়া তরুণদের বাড়িতেও খবর দিচ্ছে না কেউ। অবৈধপথে ইউরোপ যাত্রা না করে দেশে থেকে কিছু করা অনেক ভালো বলেও তিনি দাবি করেন। অপরদিকে দালালদের খপ্পরে না পড়ে বৈধপথে প্রবাসে পাড়ি দিতে সকলের প্রতি আহবান জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চীনের বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে আলবেনিয়ায় কাজের জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্ট ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের আলবেনিয়া বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েই বৈধভাবে আলবেনিয়া গেছে। কিন্তু সেখানে যে কোম্পানির কাজ দেওয়ার কথা ছিল তা তারা পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে দালালদের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করছে। গত এক বছরে ১৩ হাজার বাংলাদেশিকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আর বৈধ পথে আলবেনিয়া গেছে এক বছরে ৫৮ জন। ইউরোপের সব দেশেই যাওয়ার প্রতিটি পথ ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় ও জঙ্গল পেরিয়ে বসনিয়ার জঙ্গলে আশ্রয় নিচ্ছে শত শত তরুন। এখন বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া হয়ে গ্রিস অথবা চেক রিপাবলিক ও ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশি তরুণরা ইউরোপে যাওয়ার জন্য প্রধানত ভূমধ্যসাগর বা সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুটই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। এই রুটে সবচেয়ে বেশি ৯ হাজার বাংলাদেশি গেছেন ২০১৭ সালে। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে এই প্রবণতা কিছুটা কমলেও চলতি বছর আবার জুলাই পর্যন্ত আড়াই হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছে। স্বপ্নের দেশ ইউরোপ যেতে প্রতারণার শিকার হয়ে শত শত বাঙালি তরুণ বসনিয়া ও গ্রিসের জঙ্গলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। পথে পথে ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার জঙ্গলে থেকে তারা চেষ্টা করছেন ইউরোপের দেশ ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন কিংবা পর্তুগালে পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া পুলিশের বাধা ও নির্যাতনে তারা আবারো ফিরে যাচ্ছেন জঙ্গলে। আর এই জঙ্গলই এখন ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব বাংলাদেশি তরুনদের। এছাড়াও বাংলাদেশি শরণার্থীদের অনেকে সিরিয়ান কিংবা পাকিস্তানি অথবা আফগান শরণার্থীদের হাতে ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের শিকার হন। অনেককে নির্যাতন করে পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালচক্র।

বাংলাদেশের সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দেশে কিছু দালাল বিভিন্নভাবে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের ইউরোপের ভয়ংকর যাত্রায় উদ্বুদ্ধ করছে। অবৈধভাবে তরুণরা ইউরোপ যেতে পারছে না। মৃত্যুঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচারকারীদের গুলিতে ৩০ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ২৬জন বাংলাদেশি। ওই হামলায় আহত হয় আরও ১২ জন বাংলাদেশি। এ ঘটনায় ২৬টি মামলা হয়। সিআইডি ১৫টি মামলার তদন্ত করছে। এসব মামলার ৪৪ আসামিকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে গ্রিসে বা ইতালিতে আসার জন্য নৌকায় উঠে এখন পর্যন্ত শত শত বাংলাদেশি সাগরে ডুবে মারা গেছে। আবার অনেকে হত্যারও শিকার হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদনও করেছে। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত বিদেশে পলাতক দালালদের গ্রেপ্তারে শিগগিরই ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হবে।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) চেয়ারম্যান সাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘তরুনদের উচিত দালালদের খপ্পরে না পড়ে বৈধপথে প্রবাসে যাওয়া। এতে
নিজের ও পরিবারের সম্মান বাড়বে এবং অর্থনৈতিক উন্নতিও হবে। গ্রামাঞ্চলে থাকা দালালদের আইনের আওতায় নিয়ে আসলেই অবৈধপথে ইউরোপ যাত্রা বন্ধ হবে। বাঁচবে বাংলার শত শত তরুন।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের হেড শরীফুল হাসান বলেন, ‘দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে অবৈধপথে ইউরোপ যাত্রা ঠিক নয়। প্রবাসে যেতে আগ্রহী তরুণদেরকে সকল কাগজপত্র যাচাই করে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত’।

আরও পড়ুন...