পিবিএ,ঢাকা: নাজমু্ন নাহার। ফ্লাগ গার্ল বা বাংলাদেশের পতাকাবাহী হিসেব যিনি এক নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে এ পর্যন্ত ১২৫টি দেশ পাড়ি দিয়েছেন তিনি, যা এ পর্যন্ত আর কোন নারী তো নয়ই, কোন পুরুষও করতে পেরেছেন বলে আমরা শুনিনি। কিন্তু এখানেই থামতে চান না তিনি, লক্ষ্য তার বিশ্বজয়। বাকি পঁচাত্তরটি দেশেও বাংলাদেশর পতাকা উড়াতে চান তিনি। এবং অবশ্যই সেটা ২০২১ সালের মধ্যে। যখন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্ধ-শতাব্দি বছরে পদার্পন করবে।
বাংলাদেশের ফ্লাগ গার্ল নাজমুন নাহারের বিশ্বজয়ের এই অভিযাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে প্রতিবেশি দেশ ভারত সফরের মধ্য দিয়ে। ঊনিশ বছরের পথ পরিক্রমায় সর্বশেষ সংযোজন ছিল নাইজেরিয়া। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটি তিনি ভ্রমণ করেন চলতি বছরের (২০১৯) জানুয়ারীতে। ইতোমধ্যে অর্ধ-পৃথিবীরও বেশি, ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছেন তিনি; তাও সম্পূর্ণ একা! পাড়ি দিয়েছেন কখনো সাহারার মরুভূমি, কখনো বিপদসঙ্কুল আফ্রিকান জঙ্গল আবার কখনো বা সমুদ্রের তলদেশে গিয়েছেন। নাজমুন নাহার বেশিরভাগ দেশই ভ্রমণ করেছেন সড়ক পথে একা একা! এ তালিকার মধ্যে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও যুগোস্লাভিয়ার প্রতিটি দেশ! এ ছাড়াও তিনি সড়ক পথে সফর করেছেন ইউরোপ ও এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ! পর্যাপ্ত অর্থও ছিল না তার কাছে, পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা, বিপদেও পড়েছিলেন কয়েকবার, মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি! কিন্তু হাল ছাড়েননি। কীভাবে পাড়লেন তিনি?
সেই গল্পই আজ শোনালেন নাজমুন নাহার। শুক্রবার (২৬) এপ্রিল উত্তরাস্থ ফটো নিউজ এজেন্সি পিবিএ’র অফিসে এসেছিলেন বিশ্বজয়ী এই পরিব্রাজক। আলাপচারিতায় তিনি জানান, ভ্রমণ ছিল তাঁর আজন্ম স্বপ্ন। তাঁর রক্তের মধ্যেই ছিল এই স্বপ্নের বীজ। কেননা তাঁর দাদাও ছিলেন একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। তিনি ছিলেন একজন ইসলামিক স্কলার, মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ তিনি হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি পড়াশোনা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে। পৃথিবীর মানচিত্র এক সময় ছিল তাঁর অধ্যয়নে এবং স্বপ্নের মধ্যে। এখন তার হাতের মুঠোয়! ছোটবেলা থেকেই যে নারী স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা হাতে ঘুরবেন সারাবিশ্ব- আজ তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে! তারপরও স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ধ্যান, সাধনা আর প্রার্থনার। যা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁকে সাহস যুগিয়েছে, শক্তি যুগিয়েছে। স্বপ্নকে সাথে নিয়ে সাধণা, ধ্যান আর প্রার্থনার মাধ্যমেই এতটা পথ পাড়ি দিতে, স্বপ্ন পূরণ তথা বিশ্বজয়ের কাছাকাছি চলে আসতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
নাজমুন নাহার বলেন, ‘ছোটবেলায় বাড়ির পাশের মাঠে পাখি ধরতে চাইলেই পাখি উড়ে যেত আকাশে। তখন আমার মনে হতো আমিও যদি এভাবে উড়তে পারতাম। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা, আমি যদি বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারতাম। ছোট থেকেই আমি মানচিত্র দেখলে তাকিয়ে থাকতাম। কোন দেশের সঙ্গে কোন দেশ লেগে আছে তা দেখতাম। কোথাকার মুদ্রার নাম কি? রাজধানী কোনটা? এগুলো দেখে দেখে ভেতরে আকাঙ্খা তৈরি হতো যে একদিন আমি বিশ্বভ্রমণে যাব। এভাবে আমার স্বপ্নই ছিল বিশ্ব ভ্রমণ করা। ছোটবেলায় স্বপ্নের মধ্যেও পাখিদের মতো উড়তাম। সেই ইচ্ছাই আজকে আমাকে এখানে নিয়ে আসছে।’
দেশ ভ্রমণের রেকর্ড
বাংলাদেশের পতাকা হাতে তিনি বিশ্ব শান্তির এক অনন্য দূত হিসাবেও কাজ করে যাচ্ছেন সারা বিশ্বে! ২০০০ সালে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়! সে সময় তিনি ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে যান। এটিই তাঁর জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন! বিশ্বের আশিটি দেশের ছেলেমেয়ের সামনে তখন তিনি প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন! সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার বিশ্ব যাত্রার শুরু! এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ৯৩তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেছেন নিউজিল্যান্ড! এই দুর্দান্ত সাহসী নারী একে একে বাংলাদেশের পতাকাকে পৌঁছান সর্বোচ উচ্চতায়! বাংলাদেশের এই নারী ২০১৬ ও ২০১৭ সালে টানা ঘুরেছেন ৩৫টি দেশ! ২০১৮ সালে তিনি পৃথিবীর মানচিত্রের ৩২ টি দেশ সফর করেছেন!
২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ঘুরেছেন পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার ১২টি দেশ! ২০১৮ সালের ১ লা জুন নাজমুন একশ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে! তিনি বাংলাদেশের পতাকা হাতে জাম্বিয়ার সীমান্তবর্তী লিভিংস্টোন শহরে অবস্থিত পৃথিবীর বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ব্রিজের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে জিম্বাবুয়েতে পৌঁছান! ইতিহাসে তার শততম দেশ ভ্রমণের সাক্ষী হয়ে রইলো ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত! যে জলপ্রপাতটির অর্ধেক বহমান জাম্বিয়ায়, বাকি অর্ধেক বহমান রয়েছে জিম্বাবুয়েতে! এরপর ২০১৮ সালের অক্টবরে ১১০ তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেন মধ্যে এশিয়ার ইরান!
সম্প্রতি ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সড়ক পথে ঘুরেছেন পশ্চিম আফ্রিকার ১৫ টি দেশ, এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে সাহারা মরুভূমি ও উত্তর আটলান্টিকের পাশ ঘেঁষে যাওয়া সব দেশ গুলোর নাম! ১৮ নভেম্বর ২০১৮ সুইডেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ গ্রান্ড ক্যানারিয়া হয়ে তিনি শুরু করেছিলেন মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মালি, গিনি বিসাও, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, বুরকিনা ফাসো, গানা, টগো, বেনিন, নাইজার ও নাইজেরিয়া ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ যাত্রা! নাজমুন নাহার এবারের যাত্রা শুরু করেছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার রাজধানী নোয়াকচট থেকে! শেষ করছেন নাইজেরিয়ার লাগোস শহরে! এর মাধ্যমে তার শেষ হলো পশ্চিম আফ্রিকার সাহারা মরুভুমি ও গোল্ড কোস্ট লাইনের প্রতিটি দেশ ভ্রমণ!
নাজমুনের বিশ্বজয়ের পথে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে! বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী এই নারী এ তাঁর বিশ্বভ্রমণের দেশ জয়ে কোনো বাঁধাই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি! লাল সবুজের পতাকা হাতে সাহারার তপ্ত মরু থেকে শুরু করে সমুদ্রের তলদেশ, পর্বত শৃঙ্গ, শহর, বন্দর, আফ্রিকার দুর্গম জঙ্গল সব জায়গায় যার পদচিহ্ন পড়ছে একে একে! সব কঠিনকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের এই নারী সম্প্রতি কয়েক হাজার মাইল সড়ক পথে পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সব কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে এক অনন্য মাইল ফলক গড়েন। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহারের দেশ ভ্রমণের এই অনন্য রেকর্ড বিশ্বের ইতিহাসে সৃষ্টি করবে এক নতুন দিগন্ত!
ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি:
পৃথিবীর ইতিহাসে নাজমুনের মতো এমন নারী বিরল যিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে হাজার হাজার মাইল বাই রোডে একা একা ভ্রমণ করছেন নিজ দেশের পতাকা হাতে! দিনে রাতের অন্ধকারকে একাকার করে পর্বতে, সমুদ্রের তলদেশে, দুর্গম জঙ্গলে, বন্যপ্রাণীর পাহাড়ে, অজানা আদিবাসীদের এলাকায় কোথাও যেতে ভয় পায়নি এই নারী! বুকে তার লাল সবুজের শিহরণ, দুচোখে তার বিশ্ব, সে আমাদের লাল সবুজের পতাকা কন্যা নাজমুন নাহার! একজন নারী হিসেবে একাই শতাধিক স্বাধীন দেশ ঘুরে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নাজমুন নাহার।
তার এই মাইলফলককে সম্মাননা দিয়েছেন জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়েনা! জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে পেয়েছেন ফ্ল্যাগ র্গাল উপাধি!
তারপর ফ্ল্যাগ গার্ল খ্যাত নাজমুন নাহারকে নিয়ে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মিডিয়া ‘জাম্বিয়া ডেইলি মেইল’ এর বিশেষ ক্রোড়পত্রে ৩ জুন ২০১৮ প্রকাশিত হয় একটি ফিচার স্টোরি! খ্যাতনামা সাংবাদিক মার্গারেট সামুলেলা তার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন নাজমুনের জীবনদর্শন, বাংলাদেশের পতাকার সম্মান, ভ্রমন মাইলফলকের কাহিনী ও তার মোটিভেশনাল কার্যক্রমের কথা! এছাড়াও বিখ্যাত সাংবাদিক আলেক্স ইয়ামাহের লেখায় ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ লাইবেরিয়ার বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ‘নিউ ডেমোক্র্যাট’ পত্রিকার হেড লাইনে প্রকাশিত হয় নাজমুন নাহারকে নিয়ে একটি ফিচার স্টোরি, সেখানে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার বিশ্ব ভ্রমণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করার বৃত্তান্ত! নাজমুন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে এভাবেই গৌরবের সাথে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে! তাঁর ভ্রমণের ঝুড়ি এখন শতক ছাড়িয়ে চলছে একের পর এক! স্বপ্ন তার পুরো বিশ্বভ্রমণ করার!
সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ:
বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার এই দুর্বার দেশ জয় কতটা কঠিন ও বিপদসংকুল অভিযাত্রা ছিলো তা নিয়েই তিনি বলেন- `পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণের সময়ও আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি! মৃত্যুকে জয় করে আজ আমার বেঁচে থাকা এই মৃত্যুঞ্জয়ী আমি বাকি সব দেশ ভ্রমণের স্বপ্ন দেখছি এখনো!’
নাজমুন নাহার বলেন, `কোটি প্রাণের লাল সবুজের পতাকা হাতে পূর্ণ হলো দেশ ভ্রমণের আরেকটি ঐতিহাসিক রেকর্ড! ১২৫ দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের পতাকাকে নিয়েছি সর্বোচ্চ উচ্চতায়! গত তিন মাসের সড়ক পথের কঠিন সফর শেষ হলো! ১৩ জানুয়ারী রোববার বিকেল পাঁচটায় বাদাগরি হয়ে নাইজেরিয়ার সীমান্তবর্তী সেমে বর্ডার ক্রস করে নাইজেরিয়ায় উড়াই বাংলাদেশের পতাকা!’
`এ ভ্রমন যাত্রায় অনেক কষ্ট হলো, কিন্তু শিখেছি অনেক, দেখেছি অনেক! পনেরো দেশে সড়ক পথে কয়েক শত শত ঘন্টার জার্নি একা একা! ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়েছি, কখন টানা ২৬ ঘন্টা না খেয়ে ছিলাম, মাটির মধ্যে, জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের সাথে ঘুমিয়েছি! কখনো ইয়াম আলু, কখন হোয়াইট অরেঞ্জ খেয়ে থেকেছি!’
`পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে! কিন্তু আমি সবই আমার মানসিক শক্তি আর পজিটিভ চিন্তা দিয়ে মোকাবেলা করেছি!’
দুরূহ পথ সাধ্য করেছেন নাজমুন নাহার! বলা চলে হার না মানা বাংলাদেশের এই সাহসী নারী!
তিনি বলেন- ‘ বাংলাদেশের লাল সবুজের এই পতাকা আমার কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি! এই পতাকা আমাকে ছায়া দিয়েছে অনেক! বাংলাদেশের এই লাল সবুজের পতাকা বহন করার জন্য আমি সব কষ্টকে মাথা পেতে নিয়েছি!’
সিয়েরা লিওন থেকে লাইবেরিয়া আসার পথে রাস্তার মধ্যে সারা পথে ১১ টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছিল, এ ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প কোনো পথ ছিল না! শুধু তাই নয়, রাস্তা কোথায় ভয়ঙ্কর উঁচু, খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল, কোথাও ভয়ানক ধুলোমাখা, কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল পালা সরিয়ে আসতে হয়েছিল, বাইক ছাড়া ওই সব রাস্তা পার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না! সিয়েরা লিওনের বউ শহর থেকে বর্ডার শহর জেন্ডামা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘন্টার এই পথের স্মৃতি আমার ভ্রমণ যাত্রার ইতিহাসে একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিলো!
নাজমুন নাহার বলেন, বাংলাদেশের পতাকা হাতে যখনি আমি নতুন কোনো দেশের সীমান্তে পা দিয়েছি তখনই আমার সাথে যেন জেগে উঠেছে ষোলো কোটি প্রাণ!
বিশ্ব মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন নাজমুন নাহার! মৌরিতানিয়ার সাহারা মরুভূমিতে তপ্ত মরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ধারালো বালির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছিলেন! সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার পথে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পথ হারিয়ে তিন ঘন্টা জঙ্গলে হাঁটার পর অচেনা গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় পথ খুঁজে পাওয়া!
সেন্ট লুই’তে একাকী পথ হারিয়ে আট কিলোমিটার পায়ে হেটে অন্ধকার পথ পারি দিয়ে এক ভয়ানক পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে আবু নামক এক যুবকের সহযোগিতায় বাস স্টেশন খুঁজে পাওয়া! গিনি কোনাক্রি তে যাওয়ার পথে মধ্য রাতের অন্ধকারে আঠারো ঘন্টা জঙ্গল পথে আটকে থাকা এক বিভীষিকাময় রাত্রিকে হার মানিয়েছে!
কোনাক্রিতে পৌঁছার পর লোকাল ফ্যামিলির সাথে থাকার সময় প্রচন্ড হিট এ মধ্য রাতে হার্ট এটাক হওয়ার মতো অবস্থা গিয়েছিলো! সেই রাতে আমি আরেকবার মৃত্যু পথ থেকে বেঁচে উঠেছি! মনে পড়ে আইভরি কোস্টের মান শহরের এক ভয়ঙ্কর মুহূর্তের কথা! গেস্ট হাউস থেকে আমাকে ঘুরানোর জন্য ওমর নামে একটি ছেলেকে বাইক সহ ঠিক করে! পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বাইক, ছেলেটির সাথে আমি বাইকে করে শহরের আসে পাশে সব জায়গা ঘুরলাম, কিন্তু ফেরার পথে যখন আমরা গেস্ট হাউস এর সামনে পৌঁছালাম ছেলেটি হটাৎ জোরে রাস্তার পাশে ব্রেক করে, আমি পড়ে গিয়েছিলাম বাইক থেকে কিন্তু আমার কিছুই হয়নি, ছেলেটির পায়ের আঙুলের একটি অংশ কেটে যায়!
একটি ভয়ঙ্কর ও সুন্দর মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ!
নাজমুন নাহার বলেন, বাংলাদেশের পতাকাকে উড়াচ্ছিলাম আইভরি কোস্টের আবিদজান সমুদ্র সৈকতে! সৈকতের পানির দূরত্ব থেকে একটু দূরেই অবস্থান করছিলাম! সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাটঁছিলাম, ছোট ছোট ডেউ আসছিলো! হটাৎ আছড়ে পড়লো একটা বড় ভয়ঙ্কর ডেউ আমার দিকে! আমি ভেসে উঠলাম পানির সাথে, পাড়ের দিকে হাতড়ে কোনো ভাবে ডেউয়ের তোড় সামলে উঠে! কিন্তু আমাকে ভয়ঙ্কর ডেউয়ের তোড়ে নিয়ে কিছুটা মৃত্যুর সন্দিক্ষণে নিয়ে আবার বাঁচিয়ে দিলো তৎক্ষণাৎ!
বিপদসংকুল জায়গা গুলোতে কখনো কখনো কোনো হৃদয়বান ব্যাক্তি ভোরের অন্ধকারে আমাকে সীমান্ত এলাকা পার করে দিতে সাহায্য করেছে! যেখানেই যার সাথে পরিচয় হয়েছে কোনো সমস্যায় পড়েছি কেউ আমাকে বিপদে ফেলেনি বরং সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন! বিভিন্ন শহরে প্রায় তেরোটি লোকাল ফ্যামিলির সাথে থেকেছি, যা আমাকে আফ্রিকার জীবন যাত্রার নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে! খুব কাছ থেকে তাদের সংষ্কৃতিকে জানতে পেরেছি! তারা যত গরীবই হোক না কেন যেখানেই গিয়েছি সবাই হাসিমুখে বলেছে- ‘ইউ আর ওয়েলকাম’! আমার মতো সকল বিদেশী মুসাফিরের প্রতি তাদের ভালবাসা-সম্মান আন্তরিকতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি!
কিন্তু এই পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ না করলে আমার দেখা হতো না মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতা! অনেক দুর্গম জায়গায় দেখেছি শিশুর শরীর ধুলোমাখা, পরনে কাপড় নেই, খাবারের অভাব, কিশোরীর শরীরে এক টুকরো কাপড় ওই দৃশ্য আমাকে কাঁদিয়েছে! আরও কাঁদিয়েছে যখন ওদের ইতিহাসকে খুব কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ওদেরকে যখন একসময় জাহাজে করে ছোট ছোট বাক্সে ভরে কৃতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন দেশে, মরে গেলে জাহাজ থেকে ফেলে দেয়া হতো! সেই নির্মমতার স্বীকার হয়েছিল এই আফ্রিকানরা!
তাদের অনেক জীবনের অনেক গল্প! আমাকে উৎসাহ দিয়েছে ওদের জীবন যাত্রা! ওরা অনেক কঠিন পরিশ্রম করে! আমি বুরকিনা ফাসো, ঘানা, টোগো, বেনিনে দেখেছি অনেক মেয়েরা পেছনে বাচ্ছাকে বেঁধে বাইক চালাচ্ছে, তার মাথায় আবার বোঝা, তার জীবন থেমে নেই! চলছে! আমি ভাবতে শিখছি বার বার আমরা সবাই এক পৃথিবীর মানুষ!
পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে! কিন্তু আমি সবই আমার মানসিক শক্তি আর পজিটিভ চিন্তা দিয়ে মোকাবেলা করেছি! এ পর্যন্ত ভ্রমণের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তের মোকাবেলা করি পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে!
অনেক মানুষ আছে যাদের পরনে কাপড়ে পাঁচ ছয়টা ফুটো থাকে, অনেক বাচ্চারা খেতে পারে না, অনেক এলাকায় খবর পানি নেই, কি ভয়নাক জীবন যাপন করে তারা, তবুও তারা হার মানেনি, একটু খাবারের জন্য অনেক কঠিন পরিশ্রম করে! আমিও কাছ থেকে দেখেছি তাদের জীবনের কিছুটা চিত্র! অনুভব করেছি করেছি পৃথিবীর ভিন্ন পারে জীবন যাত্রা!
স্বপ্ন তার পুরো বিশ্বভ্রমণ করার:
নামজমুন নাহার বলেন, জীবনের আরেক নাম মুগ্ধতা। এর পিছনে ছুটতে ছুটতে মুগ্ধতা প্রেমী মানুষেরা মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করে নিতে পারেন নির্বিবাদে। কিন্তু মুগ্ধতার নেশা তাদেরকে বিচ্যুত করতে পারে না।
সেই মুগ্ধতার ফেরিওয়ালা নাজমুন নাহার। তিনি একে একে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন বিস্ময়, ফেরি করছেন বাংলাদেশের পতাকা। সকল বাধা, ভয়-শঙ্কা, মৃত্যুসহ সব পিছুটানকে দু’পায়ে দলে দুর্বার আকর্ষণে নদী, সাগর, পাহাড়, উপত্যকার বাধাকে উপেক্ষা করে ছিনিয়ে এনেছেন কাঙ্ক্ষিত বিজয়, লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন দিগন্ত জুড়ে। পেয়েছেন ‘ফ্লাগ গার্ল’ উপাধি।
যাকে নিয়ে এতো ভূমিকা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা সেই বিশ্বজয়ী পতাকার ফেরিওয়ালা তরুণীর নাম নাজমুন নাহার। এদেশে জল-হাওয়ায় যার পদচারণা, বেড়ে ওঠা।
জীবনের সব চাওয়া পাওয়াকে তিনি মিলিয়েছেন দেশ ভ্রমণ ও সেখানে দেশের পতাকা উড়ানোর মধ্যে। আর জীবনের এই কঠিন ব্রতটিকে সঙ্গী করেই তিনি যেতে চান আরও অনেক দূর, ফেরি করতে চান লাল সবুজের পতাকাটিকে। তিনি বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী নারী হিসেবে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন! তার বিশ্ব ভ্রমণ যাত্রার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক বিরল ইতিহাস!
পিবিএ/এএইচ