আবীর আকাশ,পিবিএ: স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সমাবেশে কয়েকটি মিলিটারি-গ্রেডের গ্রেনেড হামলা আরেকটি ন্যাক্কারজনক ও কলঙ্কময় অধ্যায়। সেই হামলায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত ও স্প্লিন্টারের আঘাতে ৩শ’র বেশি জন আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। আহতদের মধ্যে অনেকের জীবনযাপন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও, কানে আঘাত পান, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত তিনি ভুগছেন বলে জানা যায়।
এ গ্রেনেড হামলার লক্ষ্যটি এমন ছিল: শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করা। এটি বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি ছিল। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা, কারণ এটি রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট ছিল এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যই এই হামলা চালানো হয়।
হামলাটি চালায় হরকাতুল জিহাদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন (হুজি)। এরসাথে বিএনপি’র তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান, সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি’র উপ-শিক্ষামন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জামায়াতে ইসলামের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এবং আইন প্রণয়নকারীরাও সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত ছিলো বলে আওয়ামীলীগ দাবী করেন। এছাড়াও কাশ্মিরভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক জিহাদ-ই ইসলাম, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং মিয়ানমার ভিত্তিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি গোষ্ঠি এর সাথে জড়িত থাকার দাবী জানানো হয় আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে।
এ গ্রেনেড হামলার মুল উদ্দেশ্য কি ছিলো?
হামলার সকল চার্জশিট, বাদীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নান এবং খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও তৎকালীন এপিএস -১ সাইফুল ইসলাম ডিউকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই আক্রমণের উদ্দেশ্য এমন ছিল:
বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপি’র তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমান, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা। এই কাজের জন্য হুজি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। অবশ্য, হুজিদের বিকৃত মতাদর্শের কারনে তাদের খুব বেশি জোরাজুরি করতে হয়নি। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের জন্য শেখ হাসিনাকে তারা ‘ইসলামের শত্রু’ বলে বিবেচনা করা হতো তৎ সময়ে। এসব সত্যতা নিয়ে অধ্যাবধি পক্ষবিপক্ষ আলোচনা সমালোচনা, যোগ অভিযোগ কিবা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানানো হয়েছে হামলার কয়েকদিন আগেই গুলশানে ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিলো। তারেক রহমান এবং তার অন্যান্য সহযোগীদের সাথে হুজি সন্ত্রাসীরা সেখানে সাক্ষাৎ করে নির্দেশনা গ্রহণ করে এবং সার্বিক প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করে। এই সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিব ও তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআই এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম ও ডিজিএফআই এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজর নূর চৌধুরীও সেই হামলার ঘটনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
জানা গেছে,তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে বিএনপি’র সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ হুজি আক্রমণকারীদের এবং বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। হাওয়া ভবনে ছাড়াও মোহাম্মদপুরের হুজি’র আস্তানায় এবং ধানমন্ডিতে বিএনপি’র উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে অন্যান্য পরিকল্পনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় তাজউদ্দীন নামের একজন হুজি সদস্য হত্যাকারীদের কাছে গ্রেনেড সরবরাহ করে।
এই হামলায় আরো একজন অভিযুক্ত আসামি পাকিস্তানী সন্ত্রাসী আবু ইউসুফ এক স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-জিহাদি (টিজেআই) এর নেতা মুজফফর শাহ গ্রেনেডগুলো তাজউদ্দিকে সরবরাহ করে। কিভাবে হুজিরা বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর থেকে সমর্থন নিশ্চিত করে সে বিষয়েও কথা বলেন।
অপারেশন: ‘লাইট স্ন্যাক্স ফর শেখ হাসিনা’
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে হামলার একদিন আগে, ২০শে আগস্ট হুজি হত্যাকারীরা, কাজল এবং আবু জান্ডাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার স্থান পরিদর্শন করেন। অপারেশনটির নাম ছিল ‘লাইট স্ন্যাক্স ফর শেখ হাসিনা’ (শেখ হাসিনাকে নাশতা করানো)। ২১শে আগস্ট, তারা বাড্ডায় একটি পুর্বনির্ধারিত বাড়িতে সাক্ষাৎ করে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে হামলাকারী কাজল ও আবু জান্দালের নেতৃত্বাধীন মোট ১২ জন ওই ঘটনায় অংশ নেবে। তারপর তারা একসঙ্গে নামাজ পড়বে এবং মধ্যাহ্ন ভোজ করবে। চূড়ান্ত বৈঠকের পর মাওলানা সাঈদ জিহাদের বক্তৃতা দেন। এরপর মুফতি হান্নান ১২ জন হামলাকারীর কাছে ১৫টি গ্রেনেড হস্তান্তর করেন।
সেদিনের চূড়ান্ত আলোচনা অনুযায়ী আসরের নামাজের পর তারা সবাই গোলাপ শাহ মাজারের কাছে ফিরে গেল। এরপর তারা ট্রাকের চারপাশে অবস্থান নেয় যেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুরু হলে আবু জানদাল প্রথম গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করে। তারপর, প্রত্যেকে নিজের গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ওই স্থান ত্যাগ করে। আগে থেকেই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ায় হামলাকারীরা দিবালোকে অপরাধ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
তদন্ত ও বিচারকাজ ২০০৪-০৬:
জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় সরকার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আক্রমণের পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলো এ কারণেই ক্ষমতায় থাকাকালীন ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িতদের সঠিক তদন্ত না করার পক্ষে ছিলো। প্রকৃতপক্ষে, তারা প্রক্রিয়াটির বিপরীতে কাজ করে তদন্তটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলো এবং আক্রমণকারীদের বিচার থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করেছিলো। ওই হামলার সব ঘটনাগুলো একদমই স্পষ্ট ছিল। সাধারণত, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সব ধরনের সভা সমাবেশে আওয়ামী লীগের নিরাপত্তা বজায় রাখতে কাজ করতো। এমনকি নিকটবর্তী ভবনগুলোর ছাদ থেকেও তারা নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করতো। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট, স্বেচ্ছাসেবকদের আশপাশের ভবনের কোন ছাদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরপরই, পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং যেসব নেতাকর্মীরা আহতদের উদ্ধার করছিলো তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ওই সময়ই তারা হামলাকারীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। হামলার পরবর্তী সময়ে সেখানে থেকে ঘটনার আলামত ও প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ওই এলাকা বন্ধ করা হলেও সেখানকার প্রমাণ ধ্বংস করতে ওই এলাকা সাবানমিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। এমনকি উদ্ধারকৃত গ্রেনেডগুলোও সংরক্ষণ না করে ধ্বংস করা হয়।
আওয়ামীলীগের পক্ষ হতে বলা হয়- শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য বিএনপি-জামায়াত সরকার বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে এক ব্যক্তি দ্বারা জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করে। অত্যন্ত হাস্যকরভাবে তদন্তকাজ শেষ করে এই কমিশন উপসংহার টেনেছিলো যে ‘বিদেশি ও স্থানীয় শত্রুরা’ এই হামলা চালিয়েছিল। দুই বছর পরে একই বিচারপতি জয়নাল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উন্নীত হন, সম্ভবত তার ‘রিপোর্ট’ এর জন্যই তাকে পুরস্কৃত করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিচার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটানোর মূল কৌশলগুলির মধ্যে একটি ছিল নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে জড়িত করা। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুদ্র অপরাধী জজ মিয়া, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মিথ্যা অভিযোগে জড়িত ছিল। ২০০৫ সালের ১০ জুন ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তারা জজ মিয়াকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তিন বছর পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। একই রকম আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন যার নাম পার্থ, যাকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বলা হয়। ওই নির্যাতনের কারণে এখনও পোস্টট্রমাটিক বিষন্নতায় ভুগছেন তিনি।
হামলাকারীদের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও আক্রমণকারী সন্ত্রাসী তাজউদ্দিন ছিলেন বিএনপি’র উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই। তারেক রহমানের নির্দেশে খালেদা জিয়ার ভাতিজা ও তার এপিএস -১ সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ অন্যদের বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এরা সবাই ডিজিএফআই এর মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। গ্রেনেড হামলার অন্যতম প্রধান আক্রমণকারী হুজি প্রধান মুফতি হান্নান। ২১শে আগস্ট হামলায় জড়িত থাকলেও বিএনপি-জামায়াত সরকারের ক্ষমতায় থাকায় হান্নান ও তার সহযোগী বিপুলকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিন্তু, অন্য মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তারা ২১শে আগস্ট হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
তথ্যসূত্র:বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন ও আওয়ামীলীগের নিজস্ব সাইট থেকে।
লেখক:আবির আকাশ,কবি প্রাবন্ধিক সাংবাদিক ও কলামিস্ট।