হাত-পা বেঁধে নুসরাতের শরীরে ঢালা হয় এক লিটার কেরোসিন

নুসরাত জাহান রাফি

পিবিএ,ঢাকা: সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির সারা শরীরে ঢালা হয়েছিলো পুরো এক লিটার কেরোসিন। প্রথমে তাকে নির্জন ছাদে পাঁচ দুর্বৃত্ত তাঁর পরনের ওড়নাটি দুভাগ করে হাত-পা বেঁধে চিত করে শুইয়ে ফেলে। এরপর এক লিটার কেরোসিন নুসরাতের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢালা হয়। তারপর ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পায়ে। আগুন যখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই পাঁচজন দুর্বৃত্ত সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।

রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার এই লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ঐ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম (২০)। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সে এই জবানবন্দি প্রদান করে। শাহাদাত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ওই মাদ্রাসার এবারের আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন নুসরাত। ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে তাঁকে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন লড়ার পর মারা যান নুসরাত।

শাহাদাত হোসেন ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ঘটনার দিন সকাল আটটার দিকে তিনি সোনাগাজী বাজারে আসেন। তখন তাঁর চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে তাঁকে একটি পুরোনো ও দুটি নতুন বোরকা দিয়ে যান। তিনি তাঁকে উম্মে সুলতানা পপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সঠিকভাবে কাজ করতে বলে বাজারে কেরোসিন কিনতে যান। এক লিটার কেরোসিন কিনে তিনি ‘ডাবল পলিথিনে’ করে নিয়ে আসেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ও মাদ্রাসাছাত্র জোবায়ের আহম্মেদ (২০) ও জাবেদ হোসেন (১৯) সাইক্লোন শেল্টারের (মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবন) নিচতলার শ্রেণিকক্ষে বসেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনের প্রত্যেকেই বোরকা এবং নেকাব ছাড়াও হাত ও পায়ে মোজা লাগিয়ে নিয়েছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে আগুন লাগানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহাদাত হোসেন বলেছে, ছাদে ওঠার পর উম্মে সুলতানা পপি প্রথমে নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে বলেন। ইসরাত তখন নিশাতকে ছাদে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়েও নুসরাতকে একই কথা বলেন। ইসরাত তখন জবাবে বলেছিলেন, ‘মামলা উঠাব না। আমার গায়ে কেন হাত দিল। ওস্তাদ তো ওস্তাদ। আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।’

জিজ্ঞাসাবাদে শাহাদাত বলেছে, নুসরাতের এই জবাব শুনে সে নিজে পেছন থেকে এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে ও অন্য হাত দিয়ে হাত ধরে। উম্মে সুলাতানা পপি তখন নুসরাতের পা ধরেন। আর শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে নুসরাতের শরীর চেপে ধরে। তিনজন মিলে নুসরাতকে তাঁরা ছাদের মেঝেতে ফেলে দেয়। এই সময়টাতে উম্মে সুলতানাকে তারা কৌশলে চম্পা বলে ডাক দেয়।

শাহাদাত বলেছেন, নুসরাতকে মেঝেতে শুইয়ে ফেলার পর জোবায়ের নুসরাতের ওড়না দুই টুকরো করে তাঁর হাত ও পা বেঁধে ফেলেন। জাবেদ তখন নুসরাতের সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেন। এরপর শাহাদাতের চোখের ইশারায় জোবায়ের তার পকেট থেকে দেশলাই বের করে কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর পাঁচজনই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। নামতে নামতেই তিনজন ছাত্র তাঁদের বোরকা খুলে শরীর কাপড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন। ছাত্রী দুজন মাদ্রাসায়ই তাঁদের পরীক্ষার কক্ষে চলে যান। আর বাকি তিনজন নিজেদের মতো করে পালিয়ে যান।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিঁড়ি দিয়ে ওই পাঁচজন যখন নামছিলেন তখন নুসরাতের আগুন, আগুন, বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার তারা শুনতে পায়। পা থেকে আগুন ধরানোয় প্রথমে নুসরাতের পায়ের বাঁধন খোলে। এরপর আগুন যখন ওপরে উঠে তার হাতের বাঁধন খুলে তখনই তিনি উঠে দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নুসরাতের মুখ শাহাদাত চেপে ধরায় সেখানে আর কেরোসিন ঢালা হয়নি। তাই পুরো শরীর পুড়লেও মুখে আগুন লাগেনি।

নুসরাত হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার শাহাদাত হোসেন ও নুর উদ্দিন রোববার ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ১১ ঘণ্টা ধরে ৫৭ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে তাঁরা ওই দিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরে।

এই দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে দেখা করতে ৪ এপ্রিল যাঁরা কারাগারে গিয়েছিলেন, অধ্যক্ষ তাঁদের সবার কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। এরপর তিনি আলাদাভাবে মাদ্রাসাছাত্র ও ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন (২০), যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম (২০) এবং আরেক ছাত্রের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। তিনি তাঁদের মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ দিতে বলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি শাহাদাতের সঙ্গে একা কথা বলেন। তখন তিনি চাপে কাজ না হলে প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশ দেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানিয়েছে, কারাগার থেকে ফেরার পর ওই দিন রাত সাড়ে ৯টায় মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে তিনি, নুর উদ্দিন, মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের প্রধান আবদুল কাদেরসহ পাঁচজন সভা করে। সেখানে কে বোরকা আনবে, কে কেরোসিন আনবে, কে কোথায় থাকবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় অধ্যক্ষের জেঠাসের (স্ত্রীর বড় বোন) মেয়ে উম্মে সুলতানা পপিকে দিয়ে নুসরাতের বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে এমনটা বলে তাঁকে ডেকে পাঠানো হবে।

সকাল পৌনে নয়টার দিকে নুসরাতকে ডাকতে যায় উম্মে সুলতানা। তখন তাঁরা নিচের শ্রেণিকক্ষ থেকে তৃতীয় তলার একটি কক্ষে এসে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পর উম্মে সুলতানা ও নুসরাত ছাদে ওঠেন। তাঁদের পিছে পিছে ওঠে তাঁর (শাহাদাতের) চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে। এরপর তৃতীয় তলা থেকে তাঁরা তিনজন ছাদে যায়।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপিই নুসরাতকে ডেকে নিয়ে আসে। কিন্তু নুসরাতের সামনে তারা তাকে কৌশল করে ‘চম্পা’ নামে ডাকেন। এ কারণেই ইসরাত তাঁর জবানবন্দিতে চম্পার কথা বলে গেছেন। উম্মে সুলতানাই যে চম্পা, সেটি জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে শাহাদাত হোসেন জানিয়েছে, আন্দোলন ও বোরকা কেনার জন্য সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম তাদের ১০ হাজার টাকা এবং এক শিক্ষক ৫ হাজার টাকা দেন। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা তিনি নূর উদ্দিনকে দেন। আর তিনটি বোরকা কেনার জন্য তাঁর চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে ও ওই মাদ্রাসার ছাত্রীকে দেন দুই হাজার টাকা।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে (৫৫) ঘটনার আগেই নুসরাতের শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনারও এজাহারভুক্ত আসামি। অধ্যক্ষ বাদে মামলার এজাহারভুক্ত গ্রেপ্তার বাকিরা হলেন, ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ও মাদ্রাসাছাত্র নুর উদ্দিন, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম, সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদ্রাসার ইংরেজির প্রভাষক আফছার উদ্দিন, মাদ্রাসাছাত্র জোবায়ের আহম্মেদ, জাবেদ হোসেন এবং উম্মে সুলতানা পপি।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...