পিবিএ ডেস্ক: শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও এজন্য দায়ী করা হচ্ছে দেশটির প্রায় অপরিচিত একটি ইসলামী দলকে; এর সঙ্গে বিদেশি গোষ্ঠীর যোগসূত্র রয়েছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। খবর রয়টার্সের।
সোমবার দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের মুখপাত্র রজিথা সেনারত্নে ‘রবিবারের এমন ভয়াবহ হামলা দেশের কোনো গোষ্ঠী চালিয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। তাদের সঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রয়েছে। তা না হলে এভাবে তারা সফল হতে পারতো না। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এমন হামলা হতে পারে না।’
সিনারত্নের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স বলছে, হামলায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত। স্থানীয় কোনো দল এভাবে হামলা চালাতে পারে না।
রয়টার্স জানায়, সিনারত্নে বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি না দেশের ভেতরের কোনো গোষ্ঠী এই হামলা চালিয়েছে। হামলায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এ ধরনের হামলা সফল হতো না।’
ইস্টার সানডের দিন রোববার একযোগে কয়েকটি চার্চ ও হোটেলে একযোগে চালানো এই হামলায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা। এতে ৩৫ বিদেশিসহ ২৯০ জন নিহত এবং পাঁচশ জন আহত হয়।
বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগাররা এক দশক আগে উৎখাত হওয়ার পর এমন ভয়াবহ হামলা আর দেখা যায়নি শ্রীলঙ্কায়। এই পরিস্থিতিতে সোমবার মধ্যরাত থেকে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে ভারত লাগোয়া দ্বীপরাষ্ট্রটিতে।
হামলার পর অভিযানে সন্দেহভাজন অন্তত ২৪ জনকে আটকের খবর দিয়েছে শ্রীলঙ্কা পুলিশ; তবে তাদের কারও পরিচয় জানা যায়নি।
এক সঙ্গে আটটি স্থানে আত্মঘাতী এই বোমা হামলা চালানোর জন্য শ্রীলঙ্কা সরকার ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত নামে একটি ইসলামী সংগঠনকে দায়ী করছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের মুখপাত্র মন্ত্রী রাজিথা সেনারত্নে সন্দেহভাজন হিসেবে এই দলটির নাম বলার আগে শ্রীলঙ্কার খুব মানুষই দলটির নাম জানত বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়।ধারণা করা হয়, শ্রীলঙ্কা তাওহীদ জামায়াত নামে উগ্রবাদী মুসলিমদের দল ভেঙে ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত দলটি গঠিত হয়েছে।শ্রীলঙ্কা তাওহীদ জামায়াতটি মোটামুটি পরিচিত হলেও দলটির নেতা আবদুল রাজিক ২০১৬ সালে বৌদ্ধবিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, পরে ক্ষমাও চান তিনি।
এই ধরনের হামলার আশঙ্কার তথ্য এপ্রিলের শুরুতে বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়েছিল বলে সেনারত্নে জানিয়েছেন।ওই গোয়েন্দা তথ্যে ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতকে নিয়ে ইঙ্গিতও করা হয়েছিল। তবে তা তখন আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
প্রায় অপরিচিত এই দলটিকে সন্দেহ করলেও তাদের সক্ষমতা নিয়ে অনেকের সংশয়ের প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এই হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসূত্র থাকার ইঙ্গিত করেন।
তার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইঙ্গিত করছে যে এই হামলার ঘটনায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পেছনে বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে।”
মন্ত্রী রাজিথা সেনারত্নেও বলেন, “আমরা মনে করি না যে এই হামলাগুলোতে শুধু আমাদের দেশের একটি গোষ্ঠীই জড়িত। আন্তর্জাতিক একটি চক্র রয়েছে, যাদের সহায়তা ছাড়া তারা (স্থানীয় সন্ত্রাসী) সফল হত না।”
এদিকে, হামলাকারীরা দেশী বা বিদেশী যারাই হোকনা কেন, তাদের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে এ ঘটনায় স্থানীয় সাধারণ মুসলমানরা বিব্রত ও আতঙ্কিত।২০১৮ সালের মার্চে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনহালা বৌদ্ধরা মুসলিমদের বাড়ি-ঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে হামলা চালিয়েছিলো। ক্যান্ডি এবং আশপাশের বেশ কিছু শহরে মসজিদে এবং মুসলিমদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কট্টর বৌদ্ধদের হামলার পর সাময়িক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে রোববারের হামলার সাথে মুসলিম একটি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কথা প্রকাশ হওয়ার পর স্বভাবতই অনেক মুসলিম উৎকণ্ঠায় পড়েছেন।
কলম্বোর সাংরি-লা হোটেলে দুজন আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল বলে শ্রীলঙ্কার ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তা আর্যনন্দ বেলিয়াংগা জানান। আত্মঘাতী অন্যরা হামলা চালায় তিনটি গির্জা ও অন্য দুটি হোটেলে। এর মধ্যে একটি গির্জা দেশটির অন্য প্রান্তে।
বিবিসির সাংবাদিক আনবারাসান এথিরাজন বলেন, এই হামলার মাত্রা, এর ধরন, সময় নির্ধারণ সবকিছু এর সঙ্গে বিদেশি যোগসূত্রের ইঙ্গিত দেয়। ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত জড়িত কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে তারা যদি জড়িত থাকেও তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জিহাদি কোনো গোষ্ঠী ছিল।
“এটা ঠিক যে গত বছর সিংহলি বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলিমদের সংঘাতের পর কিছু মুসলিম যুবক উগ্রপন্থার দীক্ষা নিয়েছে, সোশাল মিডিয়ায় তাদের বিদ্বেষমূলক প্রচারও রয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টানরা কেন হামলার লক্ষ্যবস্তু?” উত্তর খুঁজছেন বিবিসির এই সাংবাদিক।
শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ মুসলিম, খ্রিস্টান ৭ শতাংশ। দেশটির ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ, হিন্দু আছে ১২ শতাংশ।
তামিল টাইগাররা নির্মূল হওয়ার পর আত্মঘাতী হামলা আর না দেখার কথা উল্লেখ করে এথিয়ারাজন বলেন, “এই হামলার পর মুসলিমরাও হতভম্ব; তারা ভয়ের মধ্যেও রয়েছে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আল কায়দা কিংবা আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী এই হামলার পেছনে থাকতে পারে।
সেনারত্নে বলেছেন, হামলার পেছনে বিদেশি কোন চক্র ছিল, তা তদন্ত করছেন তারা।
“তারা কারা, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কাদের, কিভাবে তারা এখানে আত্মঘাতী হামলাকারী তৈরি করেছে, বোমাগুলোইবা কীভাবে তৈরি করা হল, তা আমরা তদন্ত করছি।”
এই তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাইবেন বলে জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে ভয়াবহ হামলার তদন্তে ইতোমধ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল।
প্যারিসভিত্তিক এই সংস্থাটি জানিয়েছে, ইতোমধ্যে তারা একটি দল কলম্বোয় পাঠিয়েছে, যদি আরও কিছু প্রয়োজন হয়, তাও দিতে তৈরি তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ঘটনার পর শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে টেলিফোন করার পর বলেছেন, “দুঃখজনকভাবে এখনও বিশ্বে এই শয়তানরা রয়ে গেছে।”
“এটা আমেরিকারও লড়াই,” বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পিবিএ/এএইচ