পিবিএ ডেস্ক: ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছে দিনের তাপমাত্রা।আর তাপমাত্রা বাড়লে আমাদের শরীরেও তার প্রভাব পড়ে। দেহের উত্তাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়তে থাকে। তবে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থার নাম ‘থার্মোস্ট্যাট’। পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে দেহের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে এই থার্মোস্ট্যাট পদ্ধতি নিজস্ব ব্যবস্থায় ত্বকে আরও বেশি করে রক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্ত থেকে তাপ বাইরের পরিবেশে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। একইসঙ্গে শরীর বাড়ায় ঘামের ক্ষরণ। কারণ ঘাম বেরলেই শরীর থেকে লীন তাপ বেরিয়ে যাবে এবং শরীর ঠান্ডা হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে হিট লস। মুশকিল হল, থার্মোস্ট্যাট পদ্ধতিরও তো একটা সীমাবদ্ধতা আছে। পরিবেশ মারাত্মক রকমের উষ্ণ হয়ে পড়লে হিট লস বা তাপ ছাড়ার থেকে তাপ গ্রহণের মাত্রা বেশি হয়ে যায়। এর ফলেই দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতা।
তাপমাত্রা বাড়লে যা হয়:
পরিবেশের তাপমাত্রা, স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় বাড়তে শুরু করলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে—
অস্বাস্তি বাড়ে
কোনও কাজে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়
কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হয় এমন কাজ করতে বেশ কষ্ট হয়।
তাপমাত্রা যত বাড়ে ততই অন্যান্য গুরুতর সমস্যা হতে শুরু করে। যেমন—
হিট ইডিমা:
আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা শরীরের ধর্ম। কিন্তু যাঁদের শরীর আবহাওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে তাঁদেরই বেশি সমস্যা হয়। হিট ইডিমা হল, গোড়ালিতে একধরনের ফোলাভাব। অবশ্য শীতল আবহাওয়ায় দু’তিনদিন থাকলেই আপনাআপনিই এই ফোলাভাব কমে যায়।
হিট র্যাশ: খুব গরম আবহাওয়ায় থাকতে শুরু করলে ত্বকে লাল লালা দানা দানা আকারের র্যাশ বেরতে শুরু করে। র্যাশ বেরনোর সঙ্গে ত্বকে জ্বালাভাবও থাকতে পারে। মুশকিল হয় যখন ঘর্মগ্রন্থির মুখগুলি ময়লা জমে বন্ধ হয়ে যায়। ত্বকের মৃত কোষ এবং স্টেফ এপিডারমাইটিস নামের জীবাণু ত্বকের লোমকূপের মুখ বন্ধ করে দেয়। উষ্ণ আবহাওয়ায় প্রতিনিয়ত শরীরে ঘাম তৈরি হতে থাকে। কিন্তু ঘর্মগ্রন্থির মুখ বন্ধ থাকায় সেই ঘাম বের হতে পারে না। ফলে ঘর্মগ্রন্থির মুখটি লাল ফুসকুড়ি বা দানার আকারে ফুলে ওঠে, যাকে আমরা ঘামাচি বলি। সাধারণত পিঠে ও ঘাড়ে ঘামাচি দেখা দেয়।
হিট ক্র্যাম্পস:
এককথায় শরীরের বিভিন্ন পেশিতে ব্যথা ও টান ধরার সমস্যা। সাধারণত ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে নুন বেরিয়ে যাওয়ার কারণে মাসলে টান ধরে। এই কারণেই, গ্রীষ্মকালে দীর্ঘক্ষণ বাইরে রোদে ঘোরাঘুরি করলে পেশিতে টান ধরে।
হিট এগজশ্চন: মারাত্মক রকমের ঘাম হলে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় জল এবং নুন বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরে দেখা দেয় অপরিসীম ক্লান্তি, দুর্বলতা। সঙ্গে থাকতে পারে ঘোলাটে দৃষ্টি, মাথা ঘোরা, দুর্দমনীয় তৃষ্ণা, বমি বা বমিভাব, মাথা যন্ত্রণা, ডায়ারিয়া, মাসল ক্র্যাম্প, শ্বাসের টান, প্রবল শারীরিক অস্বস্তি, হাতে ও পায়ে অসাড়ভাব। এই সমস্যার একমাত্র চিকিৎসা হল ঠান্ডা জায়গায় রোগীকে স্থানান্তরিত করা। একইসঙ্গে রোগীকে দিতে হবে ঠান্ডা শরবত, ফলের রস, ওআরএস ইত্যাদি।
হিট সিনকোপি:
খর বেলায় ভোটের লাইনে, খোলা মাথায় দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কারও মাথা ঘুরছে? আর হঠাৎ চেতনা লোপ পেয়েছে? এমন হলে বুঝতে হবে রোগী হিট সিনকোপি-এর সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। সাধারণত, উষ্ণ পরিবেশে, ব্রেনে প্রয়োজনের তুলনায় রক্ত কম সরবরাহ হলে এমন সমস্যা দেখা দেয়। আসলে উষ্ণ পরিবেশে ঘাম হবেই। আর ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় তরল বেরিয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ কমতে শুরু করে। তার উপর, দীর্ঘক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকার ফলে রক্ত পায়ের দিকে চলে যায়। দরকার মতো রক্ত ব্রেনে পৌঁছতে পারে না। এই সমস্যা সমাধানে সাধারণত রোগীকে শীতল পরিবেশে কিছুক্ষণ রাখলেই তিনি সুস্থ বোধ করেন।
এবার আসা যাক সবচাইতে মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী সমস্যায়, যার নাম হিট স্ট্রোক।
হিট স্ট্রোক:
কোনও ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তুলনায় বেশি হলেই বিপদ। ওই ব্যক্তির হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
হিট স্ট্রোক দু’ধরনের হয়। ক্লাসিকাল এবং এক্সারশিওনাল।
ক্লাসিকাল হিট স্ট্রোক-এর ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘক্ষণ প্রবল রোদে উষ্ণ পরিবেশে ঘোরাঘুরি করার পরে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং ওই ব্যক্তি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ক্লাসিকাল হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে আক্রান্তের দেহে ঘাম হয় খুব সামান্য অথবা ঘাম হয় না বললেই চলে। সাধারণত বাচ্চা এবং দীর্ঘস্থায়ী কোনও অসুখে ভুগছেন এমন মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
অন্যদিকে এক্সারশনাল হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে প্রবল ঘাম দেখা যায়। সাধারণত উষ্ণ পরিবেশে দীর্ঘসময় ধরে কায়িক শ্রম করার ফলে এই ধরনের হিট স্ট্রোক হয়।
হিট স্ট্রোক খুব মারাত্মক ধরনের শারীরিক সমস্যা। বিশেষ করে ব্রেন, কিডনির ও হার্টের প্রবল ক্ষতি হয় হিট স্ট্রোকে।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণ:
দেহের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে থাকে
ত্বকের রং লাল হয়ে যেতে পারে
যন্ত্রণার চোটে মাথা দপদপ করে
রোগীর আচরণে পরিবর্তন হয়। রোগীকে দিশেহারা লাগে। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা দেখা দেয় রোগীর মধ্যে। কথা জড়িয়ে যায়। প্রলাপও বকতে পারেন বমি হতে পারে দেখা যেতে পারে খিঁচুনি, এমনকী রোগী কোমায় চলে যেতে পারেন।
করণীয়:
খর দুপুরে কোনও ব্যক্তি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে প্রথমেই তাঁকে বাঁচানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ হিট স্ট্রোক হল আপৎকালীন পরিস্থিতি। ব্যবস্থা নিতে সামান্য দেরি হলে রোগীর প্রাণহানি ঘটা আশ্চর্যের কিছু নয়। তাই—
রোগীকে রোদ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শীতল স্থান বা ছায়ায় শোওয়ান
যথাসম্ভব অতিরিক্ত জামাকাপড় খুলে দিন
রোগীর দেহ শীতল করার জন্য গায়ে ঠান্ডা জল ঢালতে পারেন। খুব ভালো হয় কোনও বড় টবে ঠান্ডা জলে শুইয়ে দিতে পারলে। সঙ্গে ফ্যান চালিয়ে দিন। রোগীর মাথায়, ঘাড়ে, কানের নীচে, ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে রাখুন। সারা গায়ে আইস প্যাক ঘষতে পারেন। একটু সুস্থ হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
অধিক উষ্ণতায় অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি কাদের বেশি—
স্থূলকায় মানুষের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয়। ফলে গ্রীষ্মকালে মোটা মানুষের বেশি কষ্ট হয়।
৪৫ বছর এবং তাঁর ঊর্ধ্বের বয়সের মানুষের। কারণ এই বয়সের পর থেকে শরীরে বিভিন্ন ধরনের অসুখ বাসা বাঁধতে শুরু করে। বিশেষ করে, শরীর ফিট না থাকলে তাপমাত্রার হেরফেরে খুবই কষ্ট হয়।
হার্টের রোগ, হাঁপানি এবং ফুসফুসের অসুখ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপে ভোগা রোগীর ঝুঁকি বেশি।
কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা তাপমাত্রার হেরফেরে বেশি কষ্ট পান।
গ্রীষ্মের সমস্যা থেকে বাঁচতে কী করবেন?
গরমের দিনে বাইরে বেরিয়ে কাজ করার থাকলে সকাল সকাল কাজ সারার চেষ্টা করুন। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত কোনও কাজ করতে যাবেন না।
খর প্রহরে রোদে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে, সঙ্গে রাখুন ছাতা, জলের বোতল। খুব ভালো হয় বোতলে নুন চিনির জল গুলে নিয়ে যেতে পারলে। আরও ভালো হয় জলে ওআরএস গুলে নিয়ে গেলে। একলিটার জলে ১ প্যাকেট ওআরএস গুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন।
হালকা রঙের সুতির জামকাপড় পড়ুন যাতে ঘাম হলে সহজেই তা বাষ্পীভূত হতে পারে। বেশি জামাকাপড় পরে থাকা মানেই ঘাম বাষ্পীভূত হতে পারবে না। শরীর ঠান্ডাও হবে না।
এখন সকলেই সানবার্নের শিকার হচ্ছেন। সানবার্ন হলে তা কিন্তু ত্বকের তাপনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমিয়ে আনে। তাই রোদে বেরতে হলে সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করুন।
এসি থেকে হুট করে উষ্ণ পরিবেশে বা উষ্ণ পরিবেশ থেকে হুট করে এসি-তে ঢুকবেন না। ছায়াঘেরা জায়গায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে শরীরের উষ্ণতা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিন।
গ্রীষ্মের সময় খোলা পার্কিং লটে বদ্ধ গাড়িতে বেশিক্ষণ থাকবেন না। বিশেষ করে বাচ্চা এবং বয়স্কদের এই পরিস্থিতিতে রাখা উচিত নয়। বদ্ধ গাড়ি খুব দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
মদ্যপান করে কখনওই গ্রীষ্মের দিনে বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে যাবেন না। কারণ অ্যালকোহল শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়।
লিখেছেন কোলকাতা থেকে সুপ্রিয় নায়েক
পিবিএ/এএইচ