পিবিএ,ঢাকা:
>> ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারপ্রতি আড়াই হাজার টাকা দেয়ার কথা
>> ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৩ পরিবারের মাঝে সমুদয় অর্থ বিতরণ
>> মোট বিতরণ হয়েছে ৮৭৯ কোটি ৫৮ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৫ টাকা
>> তথ্য হালনাগাদ হচ্ছে, সবাইকে দেয়া হবে টাকা : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের কাছে নগদ আড়াই হাজার করে টাকা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু কার্যক্রম উদ্বোধনের তিন মাস পার হলেও সব পরিবারের কাছে ওই অর্থ পৌঁছায়নি।
জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নেতৃত্বে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তত্ত্বাবধানে যে তালিকা করা হয়েছিল, তা ছিল অনিয়ম, অসঙ্গতি ও ভুলে ভরা। যে কারণে মহৎ একটি উদ্যোগ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের (আগস্ট) ১০ তারিখ পর্যন্ত মোট ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৩টি পরিবারের অনুকূলে আড়াই হাজার করে মোট ৮৭৯ কোটি ৫৮ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৫ টাকা বিতরণ করতে পেরেছে সরকার। এখনও ১৫ লাখের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে এ অর্থ পৌঁছায়নি।
অথচ গত ১১ মে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার জন্য এবং সমুদয় টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানোর খরচসহ মোট এক হাজার ২৫৭ কোটি টাকা ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ১৪ মে এ অর্থ সহায়তা প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুজিববর্ষে করোনায় ক্ষতিগ্ৰন্ত ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান কর্মসূচির বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একই দিন এ প্রতিবেদনের অনুলিপি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে টাকা পৌঁছে দিতেই একটু দেরি হচ্ছে। পুরো ৫০ লাখ পরিবারকেই এ আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। যাদের কাছে এখনও টাকা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি তাদের তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংগৃহীত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সেন্ট্রাল এইড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিএএমএস) সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করে তিনটি ধাপে অর্থ বিভাগে মোট ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ১৫৪ জনের তালিকা পাঠানো হয়। অর্থ বিভাগ এই তালিকা হতে যাচাই-বাছাই করে যোগ্য বিবেচিত ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৩ জনের অনুকূলে জি-টু-পি (গভর্নমেন্ট টু পাবলিক) পদ্ধতিতে মাথাপিছু দুই হাজার ৫০০ টাকা হারে ইতোমধ্যে ইএফটি’র মাধ্যমে মোট ৮৭৯ কোটি ৫৮ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৫ টাকা প্রদান করেছে।
এর মধ্যে মোবাইল অ্যাকাউন্ট সচল না থাকায় কিংবা স্থগিত থাকায় দুই হাজার ৩৩১ জনের মোট ৩৪ লাখ চার হাজার ৪০০টাকা ফেরত এসেছে। অর্থাৎ ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার ২২টি পরিবারের মাঝে এ অর্থ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। প্রক্রিয়াটি প্রধানমন্ত্রীর কর্যালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে।”
অর্থ বিভাগ বলছে, “প্রাপ্ত তালিকার ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ১৫৪ জনের মধ্যে যোগ্য প্রার্থী বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনকৃত মোবাইল নম্বর দ্বারা সৃজিত মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে বিবেচনায় নেয়া হয়। এক্ষেত্রে কিছু কিছু তথ্য অসামঞ্জস্য থাকায় তা সংশোধনের জন্য মাঠপর্যায়ে তালিকাটি পুনরায় পাঠানো হয়। তথ্য পুনঃসংশোধনের ক্ষেত্রে উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনকৃত অথচ সচল নয় এমন কোনো মোবাইল নম্বর অর্থ বিভাগের অনুরোধে মাঠ প্রশাসনের উদ্যোগে সক্রিয় করা হয়।
এছাড়া, উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনকৃত কোনো মোবাইল নম্বর না থাকলে মাঠ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে ১০ টাকা আমানত সম্বলিত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থাও গ্রহণ না করা হয়। এসব কার্য গ্রহণের মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য পুনঃসংশোধন করে পাঠানোর কারণে এসব সুবিধাভোগীকে নগদ সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয়।”
অর্থ বিভাগ আরও বলছে, আড়াই হাজার টাকা এককালীন দেয়ার জন্য ঢাকা বিভাগের জন্য কোটা ছিল ১২ লাখ ১৬ হাজার পরিবারের। এর মধ্যে সাত লাখ ২২ হাজার ২১৭টি পরিবারকে এ অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগের দুই লাখ ৬৭ হাজার কোটার বিপরীতে দুই লাখ ৫৩ হাজার ৩৮১টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের নয় লাখ ২৫ হাজার কোটার বিপরীতে ছয় লাখ ৭০ হাজার ৩১২টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া রাজশাহী বিভাগের পাঁচ লাখ ৮৪ হাজার কোটার বিপরীতে চার লাখ ৩১ হাজার ২৯৫টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে। রংপুর বিভাগের ছয় লাখ এক হাজার কোটার বিপরীতে চার লাখ ৫১ হাজার ৫১৩টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে। খুলনা বিভাগের ছয় লাখ ৫২ হাজার কোটার বিপরীতে চার লাখ ৭৪ হাজার ৬৩টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে। বরিশাল বিভাগের চার লাখ ২০ হাজার কোটার বিপরীতে দুই লাখ ৫৪ হাজার ২০৪টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে এবং সিলেট বিভাগের তিন লাখ ৩৫ হাজার কোটার বিপরীতে দুই লাখ ৫৪ হাজার ২০৪টি পরিবারকে অর্থ দেয়া সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, “কয়েকবার তালিকা হালনাগাদের পরও প্রাপ্ত তালিকায় অনিয়ম ও অসঙ্গতি থাকায় ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০১ জনকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। অথচ তালিকাটি করা হয়েছিল ডিসিদের নেতৃত্বে এবং ইউএনওদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে।
তালিকা থেকে বাদ পড়া ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০১ জনের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন পাঁচ হাজার পাঁচজন, সরকারি পেনশনভোগী ছিলেন এক হাজার ৬৫০ জন, অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত ছিলেন এক লাখ ৭৯ হাজার ২৬৭ জন, পেশায় গড়মিল ছিল এক লাখ নয় হাজার ৮৮২ জনের, মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্যে গড়মিল ছিল ৭৬ জনের।
এছাড়া এক হাজার ৬৫০ জন ছিল পাঁচ লাখ টাকার অধিক সঞ্চয়পত্রের মালিক, তিন লাখ ১৪ হাজার ৩৬৯টি পরিবারের ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির তথ্য একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত কর হয়। ভুল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল ১৮ হাজার ২২৬ জনের, এনআইডি, মোবাইল ও জন্ম তারিখ সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৬১ জনের, এনআইডির বিপরীতে মোবাইল সিম নিবন্ধিত ছিল না ছয় লাখ ৯০ হাজার ৪৬৪ জনের।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগেও বিভিন্ন সময় ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম দেখা গেছে। এবার করোনাকে কেন্দ্র করে এমন অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র উপকারভোগীদের ত্রুটিপূর্ণ তালিকার কারণে তিন মাস পার হলেও সবার কাছে প্রাপ্ত টাকা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।’
পিবিএ/এসডি