চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের চারজনকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে তাদের আটক করা হয়। তারা হলেন- পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার হোসাইন আহমদ (২২), কুমিল্লা সদরের নিহাল আব্দুল্লাহ (১৯), একই এলাকার আল আমিন (২২) ও খুলনা ডুমুরিয়া এলাকার নওমুসলিম আল আমিন।
চট্টগ্রাম র্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. নুরুল আবছার বলেন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী কিংবা কাছের কারও দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনে তারা যোগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ভিডিও দেখানো, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়া হয়। এরপর তাদেরকে সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তোলা হয়। অভিযুক্তরা কথিত হিজরতের উদ্দেশে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হন। এরপর গহীন পাহাড়ে ভারী অস্ত্র চালানো, বোমা ও অন্যান্য সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
আটককৃতদের বরাতে র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার চারজনকে প্রথমে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে রেখে পটুয়াখালী, ভোলার চর এলাকা, ঢাকা ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাখা হয়। প্রথমে তাদেরকে শারীরিক কসরত, জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করা হয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে সমতল থেকে পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে তারা পার্বত্য অঞ্চলের বাকলাই পাড়া হয়ে কেটিসি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছায়। পার্বত্য অঞ্চলে তারা বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, বোমা তৈরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
আটককৃতরা জানায়, বিভিন্ন সময় কেএনএফের নাথান বম, বাংচুং, রামমোয়, ডিকলিয়ান, পাহল ও কাকুলীসহ অনেকেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আসতেন। কেএনএফের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে ওই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। র্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা সংগঠনের আমিরের নির্দেশে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করেন। তারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে সাইজামপাড়া, মুন্নুয়াম পাড়া, রোয়াংছড়ি, পাইক্ষং পাড়া, তেলাং পাড়াসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন। চার দিন আগে তারা সমতলে আসার উদ্দেশে গহীন পাহাড় থেকে হেঁটে বান্দরবানের টঙ্কাবতী এলাকায় আসেন। পরে সিএনজিযোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে আসার পথে পটিয়া বাইপাস এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় আরও ৪/৫ জন পালিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব নিখোঁজদের উদ্ধারে নজরদারি বৃদ্ধি করে। উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র্যাব ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পায়। এর সদস্যরা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে বলে জানতে পারে। এরপর গত বছরের ৩ অক্টোবর থেকে পার্বত্য এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করে র্যাব। ২০ অক্টোবর রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের সাতজন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
তাদের থেকে তথ্য পেয়ে বিভিন্ন সময়ে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। গত ১১ জানুয়ারি বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়ি থেকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ২৩ জানুয়ারি কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে সংগঠনটির শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের থানচির রেমাক্রী ব্রিজ এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, গোলাবারুদ ও নগদ ৭ লাখের অধিক নগদ টাকাসহ জঙ্গি সংগঠনের ১৭ জন এবং পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিন জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
বিভিন্ন সময়ে র্যাবের পরিচালিত অভিযানে ইতোমধ্যে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ মোট ৫৫ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়।
তাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, এ সংগঠনের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, দাওয়াতি কার্যক্রমের প্রধান মাইমুন, সংগঠনের উপদেষ্টা শামীম মাহফুজ, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিব এবং ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির, অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশার।
চট্টগ্রাম র্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. নুরুল আবছার বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের আমির আনিসুর রহমানের সঙ্গে কেএনএফের প্রধান নাথাম বমের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে নাথাম বম জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র ও রশদ সরবরাহ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করত। অব্যাহত অভিযানের ফলে জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকজন সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে বের হয়ে সমতলে আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ তথ্য পেয়ে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও চট্টগ্রাম র্যাবের অভিযানে চট্টগ্রামের পটিয়া বাইপাস এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চারজনকে আটক করা হয়।
তিনি আরও বলেন, পটিয়া থেকে আটক হোসাইন রাজধানীর একটি মাদ্রাসায় পড়তেন। তিনি ২০২১ সালে সিরাজের মাধ্যমে সংগঠনে যোগদান করে। আল আমিন কুমিল্লার একটি মাদ্রাসায় পড়তেন। তিনি ২০২১ সালে এক সহপাঠীর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ফাহিম নামে একজনের মাধ্যমে সংগঠনে যোগদান করে। নওমুসলিম আল আমিন স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তিনি ২০১৮ সালে স্থানীয় এক ইমামের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি রাজধানীতে চলে আসেন এবং সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেন। তিনি সিরাজের মাধ্যমে সংগঠনে যোগ দেন। এছাড়া আটক নিহাল আব্দুল্লাহ এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০২০ সালের শেষের দিকে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে কুবা মসজিদের গ্রেপ্তার হওয়া ইমাম হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে সংগঠনে যোগদান করেন।
চারজনই জঙ্গি সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বাকলাই পাড়া হয়ে পাহাড়ে কেটিসিতে যায়। সেখানে তারা বিভিন্ন বিভিন্ন ভারী অস্ত্র চালানো, বোমা প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সামরিক কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বলে জানান চট্টগ্রাম র্যাবের এ কর্মকর্তা।