আবদুল আউয়াল মিন্টু : রাজনৈতিক দিক থেকে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে একটি শতভাগ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে নিত্য-নিয়ত, প্রতিনিয়ত ঢাকঢোল বাজাচ্ছে। অথচ বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে যদি গণতান্ত্রিক না বলে ‘কতিপয়তান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত করত তাহলে সত্যি বলা হতো। শাসকগোষ্ঠী যেভাবেই আখ্যায়িত করুক না কেন, বর্তমান বাংলাদেশকে আমরা সহজেই আখ্যায়িত করতে পারি একটি ‘অগণতান্ত্রিক মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শাসিত দেশ’, অথবা চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বৈরতান্ত্রিক। কেননা জনগণের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব শাসনপ্রক্রিয়ার কোনো স্তরেই নেই। ক্ষমতার ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে জনগণের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। রাজনীতিতে মুষ্টিমেয় জনগণের অংশীদারিত্ব থাকলেও কিন্তু কোনো কার্যকর সরকারব্যবস্থা নেই। গত ৩০ বছরে ভালো-মন্দ, গ্রহণযোগ্য-অগ্রহণযোগ্য অনেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সত্যি; তবে ঘুরেফিরে মুষ্টিমেয় সেই কিছুসংখ্যক লোক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছেন।
দুঃখজনক হলো, বিগত ১২ বছরে মাত্র ‘মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি’ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সব কিছু পরিপূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। আগে নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তত দল বদল হতো। এখন আর সেই সুযোগও নেই। ফলে এক দিকে চিরাচরিত সেই পুরনো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অটুট ও অক্ষত অবস্থায় থমকে আছে। অন্য দিকে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন তারা একই চিন্তাধারা, একই রাজনীতি ও একই বাগাড়ম্বরে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশ শাসন করে যাচ্ছেন বটে, কিস্তু জনগণ শাসনের অকার্যকারিতায় অসহায় হয়ে পড়েছে। পরিণতিতে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা চরমে পৌঁছেছে। অতএব, সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো (সম্ভবত) খোদ গণতন্ত্র, নির্বাচন ও অনির্বাচিত সরকার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতায় আধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদেরা দীর্ঘ দিন ধরে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, নির্বাচিত সরকার মানেই গণতন্ত্র। প্রতিবার ক্ষমতায় এলে তারা একই ঢাকঢোল বাজায়। নির্বাচিত সরকার ও গণতন্ত্র, এ দু’য়ের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে- সেটা তারা বুঝলেও জনগণকে কোনোভাবেই বুঝতে দিতে চায় না। দেশের বিভাজক বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টি নিশ্চয়ই বোঝেন, তবে সরকার বদলের সাথে তাল মিলিয়ে এক পক্ষ বোঝা ও অপর পক্ষ না বোঝার ভান করেন। তাদের বৃহদংশ সাধারণত হালুয়া-রুটি যেমন নামীদামি সরকারি পদ-পদবি পাওয়ার আশায় সরকার বদলের সাথে সাথে সুর বদলে ফেলেন বা চুপ থাকেন অথবা অতীত গলধকর্মের জন্য চুপ থাকতে বাধ্য হন। দীর্ঘ দিন ব্যবসায়ী সমাজের নেতৃত্ব দেয়ার সুবাদে তাদের অনেকের সাথে আমার একটা সখ্য গড়ে উঠেছে। তারা যখন হঠাৎ করে সুর বদলে ফেলেন, তখন আমার কাছে এটাকে অনেকটা ‘বাউলগানের সুরেলা আওয়াজের’ মতো অনুভূতির জন্ম দেয়। যা হোক, এটা সত্যি যে গণতন্ত্রায়নের পথে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা গণতন্ত্রের একটা মূল শর্ত বটে। তবে সেটা প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। গণতন্ত্রের সাথে জড়িত আরো অনেক বিষয় আছে; যেমন- আইনের শাসন, জনগণের ক্ষমতায়ন, অধিকার, স্বাধীনতা ও সমতা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমতাভিত্তিক সমাজ, এসব বিষয় সবই গণতন্ত্রায়নের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
গণতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা ও সহিংসতা
অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকাল খোদ গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মধ্যেই স্বেচ্ছাচারিতা আর সহিংসতার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ শতকীয় বিশ্বব্যবস্থার ধরন এখন বদলে গেছে। ওই ধরন বলবৎ থাকাকালে যে মতবাদ কার্যকর ছিল সেটা হলো, ‘গণতন্ত্র মানে শান্তি’। অর্থাৎ গণতন্ত্র হলো দেশের অভ্যন্তরে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, যেসব দেশে পরিপক্ব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সাধারণত সেসব দেশের অভ্যন্তরে সহিংসতা-সঙ্ঘাত কম দেখা যায়। এর কারণ হলো, সেখানে মতপার্থক্য বা বিরোধ দেখা দিলে গণতান্ত্রিক উপায়ে তর্ক-বিতর্ক, বাগি¦তণ্ডা, আলোচনা-সমালোচনা শেষে আপসরফা বা সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের অহিংস উপায় খুঁজে বের করার অবকাঠামো বিদ্যমান। তা ছাড়া, গণতান্ত্রিক দেশগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী তত্ত্ব ছিল : ‘গণতন্ত্র হলো দেশের অভ্যন্তরে সামাজিক শৃক্সক্ষলা ও বাইরের দুনিয়ার সাথে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের সাথে শান্তি বজায় রাখার রক্ষাকবচ।’
কিন্তু একুশ শতকের প্রথমে এসে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যায়, খোদ উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন আর দেশের অভ্যন্তরে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। বরং দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের শিকড় পাকাপোক্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সাথে স্বেচ্ছাচারিতা ও সহিংসতার একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিকেরা এ বৈপরীত্যকে গণতন্ত্রের জন্য অশুভ সঙ্কেত ও অভিশাপ বলে গণ্য করছেন।
বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, আগের ধারণা ক্রমান্বয়ে বদলে যাচ্ছে। দুই গণতান্ত্রিক দেশ একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় কি হয় না- বর্তমানে এটি গণতন্ত্রের জন্য তেমন কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নানা সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে (বিশেষ করে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে) প্রতিষ্ঠিত নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলো, পরিপক্ব গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী সরকারশাসিত দেশগুলোর চেয়ে বস্তুত অনেক বেশি সহিংসতাপ্রবণ। নতুন গণতান্ত্রিক দেশে গৃহযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত, রাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ, অহেতুক মারামারি ও খুন-জখমের মতো ঘটনা বেশি ঘটার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় ভারতে অনেক বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেও তাই। বিভিন্ন পত্রিকার বরাত দিয়ে বলা যায়, ‘বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন খুন হয়েছে ১৫-১৬ জন। এদের অনেকের লাশ এখানে-সেখানে, নদীতে, জঙ্গলে, রাস্তা বা রেললাইনের ধারে পাওয়া যায়। খুন ছাড়া রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গুম, ডাকাতি, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, মলম পার্টির আক্রমণ, শাসকগোষ্ঠীর লাঠিয়াল বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন।’ রাজনৈতিক কারণে হত্যাকাণ্ড ছাড়াও এসব দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ততা, রাস্তাঘাটে যানবাহন ও নৌযান দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু ও আহতের হার অনেক বেশি। আশঙ্কাজনক হলো, এসবই দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। অতএব, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ছবি-চেহারা ও আকৃতি-প্রকৃতি এমন এক বিমূর্তি ধারণ করেছে; যার কোনো সদৃশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে এ পৃথিবীতে। আমার ধারণা, পাঠক বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদি ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত। তাই এ ব্যাপারে অতিমাত্রায় আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।
সমাজবিজ্ঞানীরা অপরিপূর্ণ গণতন্ত্র ও সহিংস অপরাধের মধ্যকার সম্পর্ক বা যোগসূত্র নিয়ে এখন আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে নেই। এ বিষয়ে সম্প্রতি তারা বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই শান্তির চেয়ে সহিংসতা বেশি ডেকে আনে এবং সহিংসতায় উৎসাহ ও প্ররোচনা জোগায়।’ বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে লগি-বৈঠার সহিংসতা, নির্বাচনোত্তর নির্যাতন ও সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত ইত্যাদি বিষয় প্রমাণ হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
ব্যালট অনেক দেশে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে। অর্থাৎ ব্যালটের মাধ্যমে বুলেটের অশান্তি ও সহিংসতা দূর হয়েছে। এটা মিথ্যে নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯০ সালে নিকারাগুয়ায় সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা স্যান্ডানিস্টা সরকারকে ব্যালটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে। কম্বোডিয়া, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, এমনকি নেপালকে অনুরূপ দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে। আবার এর বিপরীত উদাহরণও আছে। ১৯৬৭ সালে গ্রিসে নির্বাচনোত্তর অনিশ্চয়তার ফলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। আলজেরিয়ায় ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ইসলামী দলের জয় সুনিশ্চিত হলেও নির্বাচন বাতিল করার ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। থাইল্যান্ডে নির্বাচনোত্তর সামরিক অভ্যুত্থান জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। আলজেরিয়া, থাইল্যান্ড, উগান্ডা, রুয়ান্ডা ও ইরাক নির্বাচনের জের এখনো টানছে। তিউনিসিয়া ও মিসরকেও দৃষ্টান্ত হিসেবে টেনে আনা যায়। দুই দিকেই যেতে পারে, এমন উদাহরণও কম নয়। যেমন- কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও জিম্বাবুয়ে। দুই দেশেই নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে প্রধান দুই দল সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। তাতে অনেক নাগরিক হতাহত হন। পরে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপে প্রধান দুই দল সমঝোতায় এসে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে বর্তমানে ভোগদখল করছে। দীর্ঘ দিন ধরে গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশে নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাগুলোকেও দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
গণতন্ত্র ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা
গণতন্ত্রায়নের প্রাথমিক দিকে সহিংসতার যোগসূত্রের ব্যাপারে আরো একটা জোরদার যুক্তি হলো, নতুন গণতন্ত্র সব সময় জাতিগোষ্ঠীগত সঙ্ঘাত, রাজনৈতিক অপরাধ, সংঘর্ষ ও সঙ্ঘবদ্ধ বা সংগঠিত অপরাধের (ড়ৎমধহরুবফ পৎরসব) জন্ম দেয়। এগুলো গণতন্ত্রের ব্যাপারে মানুষের হৃদয়ের আকুতি ও অনুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত হানে। নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতারা ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ধর্ম-বর্ণ-জাতিগত পরিচয় ও আবেগকে অসদ্ব্যবহারে প্রলুব্ধ হন। সেই সাথে জাতিকে পরস্পরবিরোধী বা বিপরীত মতাবলম্বী দলে বিভক্ত করে দুই মেরুতে অবস্থান করতে প্রলুব্ধ করেন।
আর তা থেকেই সৃষ্টি হয় বিভক্ত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অযথা বিরোধ, বড় ধরনের সঙ্ঘাত ও সহিংসতা। অনেক সময় এ কারণে এসব দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলে, এমনকি গণহত্যা সংঘটিত হয়। ভারত, শ্রীলঙ্কা, রুয়ান্ডা, সুদান, বুরুন্ডি, পাকিস্তান, ইরাক, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, যুগোস্লাভিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন এর উদাহরণ। বাংলাদেশেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। যেমন- গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মীয় অনুভূতি বা মৌলবাদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ন্যায়বিচার বনাম ফাঁসির আদেশ ইত্যাদি। এগুলো রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার লক্ষণ। বাংলাদেশসহ এসব দেশের রাজনৈতিক সঙ্ঘাত পর্যালোচনায় সহজেই অনুমেয়, খোদ নির্বাচন ও গণতন্ত্রই সহিংসতায় ইন্ধন জোগায়। সাথে সাথে বিভেদ-বিভক্তির ধ্যানধারণা আরো গভীরতর করতে সহায়তা করে।
অন্য এক সমীক্ষায় দেখা যায়, একনায়কতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক দেশগুলো গণতন্ত্রায়নের পথে পা দেয়ার ক্রান্তিকালে শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছে করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অনেক অহেতুক পুরনো সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসে জন-অসন্তোষ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হতে পারে। যেমন- (ক) পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মলাটে হয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতাকে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর চেষ্টা করা; (খ) বিভিন্ন খুনের ঘটনাকে নতুন করে জাতির সামনে টেনে এনে বিভাজন ও সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা এবং (গ) স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার ঘোষক, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, ধর্মনিরপেক্ষতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে পরিকল্পিতভাবে সামনে নিয়ে এসে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসে ষড়যন্ত্র করে পুরো জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলা। এসবের ভেতর অনেক বিষয় আছে, যেগুলো শুধু নিজ দেশের অভ্যন্তরে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি করতে নয়, বরং প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলার একধরনের ষড়যন্ত্র।
এসব অহেতুক বিষয়কে ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী দেশে সহিংসতা ঘটানোর ষড়যন্ত্রে সদাসর্বদা ব্যস্ত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখা। ফলে বলা যায়, গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়াটি বিপজ্জনকভাবে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের (ট-ঞঁৎহ) মতো। প্রথমে নির্ধারিত পথে এগিয়ে যায়, পরে উল্টো মোড় নিয়ে বিপরীত দিকে প্রত্যাবর্তন করতে থাকে। গণতন্ত্রের শিকড় বিস্তারের আগে একনায়কসুলভ ও গণতন্ত্রের লেবাস পরা স্বৈরাচারী শাসকেরা ধারণা করেন, তারা দেশের নাগরিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ করে, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে দেশের অভ্যন্তরে সহিংসতার প্রবণতা কমানোর ক্ষমতা রাখেন। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অত্যাচার-নির্যাতন করে কিছু দিনের জন্য জনগণকে দমিয়ে রাখতে পারলেও সমতা ও স্বাধীনতাকামী জনগণ নতুন করে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে এবং নিজ অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে শাসকগোষ্ঠীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। তাতে সহিংসতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে এ সহিংসতার মূল উৎস হলো স্বৈরাচারীদের সমর্থক গোষ্ঠী। একই সাথে তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় কর্মরত কিয়দংশকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দলীয় স্বার্থে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে।
এ সময় এক দিকে শাসকগোষ্ঠীর চলতি স্বৈরাচারী ঐতিহ্য, অন্য দিকে গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য নাগরিকদের প্রচণ্ড চাপের মিথস্ক্রিয়ায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। তাতে অনেক সময় শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থা একই রূপ ধারণ করেছে। সরকার এক দিকে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করছে, অন্য দিকে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে জনগণ প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে দিন দিন সমাজে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে নেপাল, জিম্বাবুয়ে, কিরঘিজস্তান ও সাবেক যুগোস্লাভিয়াকে, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও ভারতের অনেক রাজ্যকে এসবের দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে। তা ছাড়া মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়াকে দৃষ্টান্ত হিসেবে টেনে আনা যায়। অবশ্য সমাজ যতই গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার কাছাকাছি আসবে, তখন সামাজিক সহিংসতা কমে আসে। কেননা স্বাধীনতা, সমতা, মানবিক মর্র্যাদা, সমতাভিত্তিক সমাজ কাঠামো ও সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক বিলিবণ্টনের মতো বিষয়গুলো হলো গণতন্ত্রের মূলতন্ত্র বা ন্যূনতম শর্ত।
গণতন্ত্র ও সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ গোষ্ঠী
আজকাল ‘সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ গোষ্ঠী’ বিশেষত আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে মাদক, ফেনসিডিল, ইয়াবা ইত্যাদির চোরাচালান, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, জাতিগত উগ্রবাদ, ঋণের নামে সরকার সমর্থকদের ব্যাংক থেকে টাকা লুণ্ঠন, এমনকি ক্ষমতায় আসীন সরকারি দলের মদদপুষ্ট বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও গোষ্ঠী সমাজের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা সম্ভব হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক এক পক্ষকে সুযোগ দিতে গিয়ে অন্য পক্ষের অধিকার খর্ব করা ও অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়কে কাজে লাগিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধচক্র আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। তাদের জন্য আইন প্রযোজ্য নয়। তারা সাধারণ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারগুলোর মর্মান্তিক পরাজয় ঘটিয়ে তাদের অধিকারের জায়গাতেই অপরাধ বেড়ে ওঠায় জনগণ একসাথে অনেক দিক থেকে নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে।
যেমন- রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট এসব সংগঠন, পুলিশকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে এবং বিচার বিভাগকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে অকার্যকর করে ফেলেছে। একই সাথে সাধারণ জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট শাসকগোষ্ঠীর কর্মী বাহিনী জনগণকে ভয়ভীতি ও দৈহিক নিরাপত্তার হুমকিতে রেখেছে। আঙুল ফুলে কলাগাছের মতো হয়ে যাওয়া এই গোষ্ঠী গণতন্ত্রের নামে রাজনীতিকে ব্যবহার করে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সাধারণ জনগণের দৈহিক নিরাপত্তাকে সব সময় ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ অবস্থা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করতে পারলে বর্তমানের এই অসহনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা সুগম ও প্রশস্ত হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
লেখক : সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই