মা হলো ‘পাগলিটা’, বাবা হলো না কেউ!

পিবিএ,ঢাকা: ঢাকার শাহজানপুরে গ্রিনলাইন বাসের কাউন্টারের পাশের এক সরু গলিতে প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলেন এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী। এই দৃশ্য উৎসুক অনেকেই ভিডিও করছিলেন। কিন্তু তাঁর সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে ‘এক পাগলী’ ছটফট করছে মর্মে স্থানীয় লোকজন শাহজাহানপুর থানায় খবর দেয়।

খবর পেয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান এক সরু গলির পাশে ছোট একটি ময়লা এবং বালির স্তূপের পাশে প্রসব বেদনায় এক নারী ছটফট করছেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগে আতিকুর রহমান জানতেন না ঘটনা কী। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলেন প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন এক নারী।

সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু কোলে নিয়ে এসআই আতিকুর রহমান। ছবি : সংগৃহীত

ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর দু-মিনিটের ভেতরে ওই নারীর মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে একটি ফুটফুটে শিশু। জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটির কোমর থেকে নিচের অংশটুকু গিয়ে পড়ে বালুর ওপর। মাথার দিকটা পড়ে ময়লার স্তূপে। আর শিশুটির পিঠের অংশটুকু বালুর সঙ্গে লেপ্টে থাকে। এরপর শিশু ও তার মাকে রক্ষা করার মিশন শুরু করেন এসআই আতিকুর রহমান।

এই যখন অবস্থা তখন আশপাশের অনেক মানুষ দৃশ্যটির ভিডিও ধারণ করছিল। কেউ কেউ তুলছিল ছবিও। সেখানে অনেক উৎসুক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অনুরোধ করার পরও সদ্য জন্মগ্রহণ করা শিশু ও তার মায়ের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি কেউ। তবে সেখানে উপস্থিত এক নারীকে সহযোগিতার জন্য জোরালো অনুরোধ করেন আতিকুর রহমান। তখন দ্রুতই এগিয়ে আসেন তিনি।

এরপর পুলিশের গাড়িতে থাকা একটি তোয়ালের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা নারীর কাছে দেন এসআই আতিক। সেই তোয়ালে দিয়ে সদ্য ভূমিষ্ঠ ছেলে শিশুটিকে সুরক্ষা দেন নারীটি। তখন মাটিতে পড়ে থাকা একটি প্লাস্টিকের বস্তার সুতা দিয়ে বাচ্চাটির নাভি বেঁধে দেন আতিকুর রহমান। শুধু তাই নয়, সহযোগিতায় এগিয়ে আসা নারীকে সঙ্গে নিয়ে শিশুটির সমগ্র শরীর মুছে দিলেন তিনি।

সে সময় ওই মা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিলেন। তাঁর শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। শিশুটির সুরক্ষা নিশ্চিত করার পর আশপাশের দোকান থেকে পরিত্যক্ত কার্টন সংগ্রহ করে ওই মাকে ভালো স্থানে রাখার ব্যবস্থা করলেন আতিকুর রহমানসহ ওই নারী। পাশের দোকান থেকে মধু কিনে নিয়ে এলেন এসআই। তারপর শিশুটির মুখে সেই মধু দিলেন তিনি।

মা ও শিশু দুজনকেই বাঁচিয়ে রাখার জন্য হাসপাতালে নেওয়ার চিন্তা করেন এসআই। ঘটনাস্থলটি সরু গলিতে হওয়ায় সেখানে পুলিশের গাড়ি ঢোকাতে পারেননি এসআই আতিক। কিন্তু মায়ের সারা শরীরে রক্ত লেগে থাকায় হাসপাতালে নিতে এগিয়ে আসেনি কোনো রিকশা বা ভ্যান। কোনো উপায় না পেয়ে মা ও শিশুকে হাসপাতালে নিতে বল প্রয়োগ শুরু করেন আতিকুর রহমান ও তাঁর দল। জোর করার পর একটি ভ্যান যেতে রাজি হয়। তখন আরো দুই নারীর সহযোগিতায় মা ও শিশুকে ভ্যানে উঠান আতিকুর রহমান।

এরপর ভ্যানে করে মাকে ও কোলে নিয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছায় এসআই। হাসপাতালের গাইনি বিভাগের ৪৬ নম্বর বেডে এবং বাচ্চাটিকে শিশু ওয়ার্ডের ১ নম্বর বেডে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তির সময় অভিভাবকের নামের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু স্বীকৃত কোনো অভিভাবক না থাকায় আতিকুর রহমানই হন মা ও শিশুটির অভিভাবক।

শিশুটির জন্ম হয় বুধবার বিকেল ৫টা ৬ মিনিটে। বৃহস্পতিবার পুরো ঘটনাটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন এসআই আতিকুর রহমান।

আতিকুর রহমান বলেন, ‘গতকাল হাসপাতালে নেওয়ার পর শিশুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে গেলেও এখনো শিশুটির মা অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালেই আছেন। এরপর আমি যোগাযোগ করি সমাজসেবা অধিদপ্তরে। তারপর বিকেলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন আজিমপুরের ছোট মনি নিবাসে শিশুটিকে রেখে আসি। শিশুটির নাম দেওয়া হয়েছে আকাশ তালুকদার। শিশুটির মাকে ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে আসার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাব। দেখা যাক কী করতে পারি আকাশ তালুকদারের মায়ের জন্য।’

শিশুটির নাম আকাশ তালুকদার রেখেছেন কেন এমন প্রশ্নে এসআই আতিক বলেন, ‘শিশুটির মা পাগলি। সে শিশুটির লালন-পালন করতে অক্ষম। সুতরাং এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শিশুটিকে দেখভাল করার মতো আকাশ-মাটি ছাড়া তো আর কেউ নেই। এই পৃথিবীই শিশুটির অভিভাবক। এই সম্পূর্ণ আকাশের মালিকানা তার, সম্পূর্ণ ভূমির মালিকানা তার। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও তার। সেজন্য আকাশ রাখা হয়েছে। আর তালুকদার শব্দটা যোগ করার কারণ হলো, আমরা ছোটবেলায় শুনেছি তালুকদারগোষ্ঠীর লোকজনের অনেক জমি-জমা থাকত। সে যেহেতু সমগ্র ভূমির মালিক তাই তালুকদার রেখেছি।’

 

পিবিএ/জেআই/হক

আরও পড়ুন...