সূরা ফাতিহার শিক্ষা এবং আজকের মুসলিম সমাজ

আল কোরআন: সৌভাগ্যের পরশ পাথর

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন: সূরা ফাতিহা মূলত একটি প্রার্থনা এবং একই সাথে এটি একটি অঙ্গীকারনামা। আবার এটি পবিত্র কোরআন মজিদের ভূমিকা বা মুখবন্ধও বটে। এই প্রার্থনা, অঙ্গীকারনামা বা ভূমিকাটির তেলাওয়াতের মধ্য দিয়েই কোরআন পাঠ শুরু করতে হয়। এই সূরাটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, নামাজে এটি পড়া বাধ্যতামূলক বা ওয়াজিব করা হয়েছে এবং প্রতি রাকায়াত নামাজে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা ছাড়া নামাজ শুদ্ধ হয় না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাতিহাতুল কিতাব (সূরা ফাতিহা) পাঠ করেনি তার নামাজ হয়নি। এ কারণে প্রতিদিন, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের প্রতিটি রাকায়াতে আমরা সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করে থাকি।

কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিদিনের নামাজে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে আমাদের পরওয়ার -দিগারের নিকট কী প্রার্থনা ও অঙ্গীকার করে থাকি তাকি আমরা জানি? সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসল্লিই নামাজে পঠিত সূরা সমূহের, বিশেষ করে সূরা আল ফাতিহার অর্থ. তাৎপর্য ও এর শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন নই। আর সচেতন নই বলেই তো আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীপ্রীতি আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে; ব্যক্তিপূজা, ব্যক্তি বিশেষের অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্য-অনুসরণ তথা দেবতাতন্ত্র আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে, আমাদের রাজনীতি এমনকি আমাদের ধর্মকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছে; সচেতন নই বলেই তো আমরা স্রষ্টার নৈকট্য ও দ্বীনের সন্ধানের জন্য, সিরাতুল মুশতাক্বিমের পথের দিশা জানার জন্য, হেদায়াত পাওয়ার জন্য আল্লাহর কালাম আল কোরআনের পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষ বা তথাকথিত পীর, দরবেশ, বুযুর্গ, আলেম ও মুরুব্বিদের কাছে ধর্ণা দেই, তাদের কথাকেই দ্বীন মনে করি, কোরআনের সাথে তাদের কারো কোন বক্তব্যকেই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি না বরং ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্য করতে যেয়ে তাদের বয়ানকে প্রকারান্তরে কোরআনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আর এ সবই আল্লাহর কালাম আল কোরআনের শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল।

আমাদের সমাজে কোরআনের শিক্ষা বা কোরআন চর্চা নাই বললেই চলে। যেটা আছে তার নাম হলো অর্থ না জেনে তেলাওয়াত। আমাদের এই তথাকথিত তেলাওয়াত আর কোরআন শিক্ষা কিন্তু এক জিনিস নয়। কারণ, সাধারণ ভাবে তেলাওয়াত বলতে যা বুঝায় তা হলো পড়া বা পাঠ করা। যেমন, আমরা বই পড়ি, গল্প পড়ি, উপন্যাস পড়ি, পেপার পড়ি ইত্যাদি। আমাদের এই বই বা পেপার পড়ার মাধ্যমেও কিন্তু আমরা কিছু শিখতে বা জানতে পারি। কিন্তু কোরআন তেলাওয়াতের নামে আমরা যা করছি, তাকে অর্থহীন আবৃত্তি করা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! কারণ এই না বুঝে তেলাওয়াতের মাধ্যমে কোরআনের কোন কথাই কিন্তু আমরা জানতে পারছি না। আল্লাহ বলেছেন যে, এই কোরআনটা হচ্ছে মানুষের জন্য একটি হেদায়াত, গাইড লাইন এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী জীবনবিধান। কিন্তু অর্থহীন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কোন কথাই তো জানতে পারছি না। আর জানতেই যদি না পারি তাহলে কোরআন যে পথের দিশা দিতে চায় তা আমরা কীভাবে গ্রহণ করব? সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমরা প্রতিদিন সকালে কোরআন তেলাওয়াত করছি ঠিকই, কিন্তু কোরআনের শিক্ষা সম্পর্কে আমরা বরাবরই অজ্ঞ ও মূর্খই থেকে যাচ্ছি।

মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা কিন্তু এই অর্থ না জেনে তেলাওয়াতেই সন্তুষ্ট। অর্থাৎ আমরা আমাদের এই অজ্ঞতাকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু অজ্ঞতার কাছে এই আত্মসমর্পন আমাদের জন্য যে কতটা ভয়াপবহ অভিশাপ ডেকে এনেছে তা কি আমরা বুঝতে পারছি? আমাদের এই অজ্ঞতার কারণেই কিন্তু কোরআনের শিক্ষা আজ আমাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়েছে, আর বড় হয়ে উঠেছেন পীর-বুযুর্গ বা ব্যক্তি বিশেষের বয়ান। এভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তাঁর কালাম আজ আমাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়েছে আর ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষ তথা মূর্খতা ও বেদায়াতই আজ আমাদের প্রভু হয়ে আমাদের ঘারে সওয়ার হয়ে বসে আছে।

অনুরূপ ভাবে, কোরআনকে অনুসারণের ক্ষেত্রে, ইসলামের যথার্থ অনুসরণের ক্ষেত্রে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে, দ্বীনের পথে চলার ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আজ আমাদের জন্য বড় আদর্শ নয়, আমাদের আদর্শ হচ্ছেন অমুক বাবা আর তমুক বুযুর্গ। এই বিভ্রান্তির কারণেই দ্বীনের সহজ-সরল রূপটি আজ আমাদের কাছ থেকে আড়াল হয়ে পড়েছে, আর দ্বীনের নামে বেদ্বীনি, বেদায়াত, শিরক ও মূর্খতা আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এই একই কারণে মুসলমানদের মাঝে আজ বহু দল, উপদল, বিভেদ ও বিশৃংখলা। কারণ কোরআন-হাদীস আমাদেরকে দ্বীনের যে শাশ্বত, সনাতন সিরাতুল মুসতাক্বিমের সন্ধান দেয় তার পরিবর্তে আজ আমাদের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বহু মত, বহু পথ, বহু তরিকা এবং দ্বীনের নামে মিথ্যার বহুরূপ।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের এই অজ্ঞতাকে লালন করা হচ্ছে। ধর্মীয় কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সমূহ, যারা সাধারণ জনগণের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ধর্মব্যবসা ও কর্তৃত্ব- আধিপত্য বজায় রাখতে চায়, তারা নানা অজুহাতে সাধারণ মানুষকে কোরআন থেকে, কোরআনের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। এক সময় হিন্দু ব্রাহ্মণেরা যেমন সাধারণ মানুষকে দেশি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়া থেকে নিবৃত করার জন্য রৌরব নরকের ভয় দেখাতো, আজও তেমনি বাংলা ভাষায় কোরআনের তাফসীর পড়া থেকে বিরত রাখার জন্য নানা ধরনের আজগুবি কথাবার্তা ছড়ানো হচ্ছে, যার কোন ভিত্তি কোরআন হাদীসে নেই। মূলত এসব মিথ্যা প্রচারণার এক মাত্র কারণ হচ্ছে, কোরআনের শিক্ষা যদি সহজ লভ্য হয়ে যায়, কোরআনের শিক্ষার যদি ব্যাপক প্রচার হয়, তাহলে দ্বীনের নামে যেসব মনগড়া নিয়ম-কানুন ও বয়ান চালু আছে সেগুলো বহাল থাকতে পারবে না। এ কারণেই দ্বীনের নামে লেবাসধারী, অনুমান নির্ভর মূর্খ বয়ানকারীগণ আল্লাহর নূরকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায়। তারা চায় অন্ধ আনুগত্য ও অজ্ঞতাকে জিইয়ে রাখতে যা শিরক ও পৌত্তলিকতার মূল ভিত্তি।

আসলে একটি সমাজে পৌত্তলিকতার উত্থান একদিনে হয় না। যে কাবাঘর ছিল তাওহীদের কেন্দ্রভূমি সেই কাবাঘরেই এক সময় মূর্তিপূজা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এবং তা একদিনে হয়নি। মূর্তি বা দেব-দেবীর পূজা নিঃসন্দেহে শিরকের চূড়ান্ত রূপ; কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয় ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের উপর দেবত্ব আরোপের মধ্য দিয়ে। মূলত, কোন মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষকে যখন অতিমানব মনে করা হয়, তখনই তার উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। এর প্রকাশ দেখা যায় ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে ইহুদি ও খৃষ্টানরা তাদের পূর্বপূরুষ মনে করে। মক্কার কুরাইশরাও কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এরই বংশধর এবং পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম বা সেবায়েত। আর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সারা জীবন তাওহীদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ও তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইসমাইল (আঃ) পবিত্র কাবাঘরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাওহীদের কেন্দ্র রূপেই। অথচ তাঁদেরই বংশধর মক্কার অধিবাসীরা পবিত্র কাবাঘরকে মূর্তিপূজার আখড়ায় পরিণত করেছিল। অন্যদিকে ইহুদিরা হযরত ওজাইরকে আর খৃষ্টানরা হযরত ঈশা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্রে পরিণত করেছিল। এটি একদিনে হয়নি। আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকে বড় করে তোলা তথা ব্যক্তিপূজার পথ ধরেই শত শত বছরের বিকৃতির এক পর্যায়ে পৌত্তলিকতার প্রকাশ্যরূপ মূর্তিপূজা আত্মপ্রকাশ করে।

যে শিরক তথা ব্যক্তিপূজার মূলোৎপাটনের জন্য ‘সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য’ এই ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর কালাম সূরা আল ফাতিহা নাযিল হয়, সেই ব্যক্তিপূজার অক্টোপাশে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, আমাদের ধর্ম ও রাজনীতির সবকিছু এখনও বাধা পড়ে আছে। আমরা মুসলমানরা প্রকাশ্য মূর্তিপূজা হয়তো করি না; কিন্তু ব্যক্তিপূজা ও দেবতাতন্ত্র এখনও আমাদের মন-মানসিকতাকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমাদের এই মনের কালিমাকে দূর করে বিশুদ্ধ তাওহীদের আলোকে আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করতে হলে আল্লাহর কালাম আল কোরআনকে, বিশেষ করে সূরা ফাতিহার শিক্ষাকে আত্মস্থ করা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন আল কোরআন এবং মহানবীর জীবনাদর্শের আলোকে তৎকালীন আরবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান পারিপার্শ্বিকতাকে মিলিয়ে সূরা আল ফাতিহার প্রতিটি ম্যাসেজকে বুঝার চেষ্টা করা এবং সে আলোকে সমাজ-সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...