পিবিএ স্পোর্টস ডেস্ক: রবিবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট পেতে যাচ্ছে নতুন এক চ্যাম্পিয়নকে। বৃষ্টিতে বিঘ্নিত, একঘেয়েমিতে আক্রান্ত, দীর্ঘায়ুতে ক্লান্ত ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত একটা কাজের কাজ করে যাচ্ছে। উপহার দিচ্ছে ষষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে।
সকালে মনে প্রশ্ন এলো, ‘হাসি হাসি পরব ফাঁসি’ কিংবা ‘মরিবার হলো তার সাধ’ এগুলোই সেমিফাইনালের থিম সং হয়ে গেল নাকি! নইলে টস জিতে এই আগ্নেয়গিরিতে সবাই কেন ব্যাট নিচ্ছে? নিচ্ছে, কারণ বিশ্বকাপে ম্যাচ জেতার অব্যর্থ সাকসেস গাইড বেরিয়ে গিয়েছিল। আগে ব্যাট করো। ১০-১২ ওভার জানের ওপর দিয়ে যাবে। এরপর ধ্বংসস্তূপ পুনর্নির্মাণ করো। ব্যস হয়ে যাবে। অস্ট্রেলিয়াও সেই মডেলে এগোল। এগোল না, আসলে মুখ থুবড়ে পড়ল। আর সেই থোবড়ানো মুখের অস্ট্রেলিয়ার ওপর স্টিম রোলার চালালেন জেসন রয়। এমনই যে মনে হলো তিনি অন্য উইকেটে খেলছেন। যেখানে এমনকি বেয়ারস্টো পর্যন্ত এক শ স্ট্রাইক রাখতে পারছেন না, সেখানে তার ব্যাটে ঝড়। ডানা মেলে উড়তে থাকে বল গ্যালারির দিকে। মাটিতে থাকা শটগুলোতে যে জোর তার কোনো কোনোটাতে হাত লাগাতে গেলে সাহস লাগে। অস্ট্রেলিয়ার সাহস হয়তো ছিল, তবে ছিল না রয়কে ঠেকানোর মন্ত্র। স্টার্ক-কামিন্স চেষ্টা করলেন। শরীরমুখী শর্ট বল। কিন্তু রয়ের যে ব্যাট আছে সেটা সময়ে এত চওড়া হয়ে গেল যেন পুরনো দিনের যোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য ঢাল। ঢাল, আবার তলোয়ারও। তাতে অস্ট্রেলিয়ান অহং এমন কাটা পড়ে গেল যে ম্যাচটা একেবারে নো ম্যাচ। বেয়ারস্টো সঙ্গ দিলেন, পরে রুট-মরগানও যথেষ্ট তৎপর থাকলেন। কিন্তু অর্জুন আসলে রয়। বাকিদের কাজ বিশেষ কিছু ছিল না। ৬৫ বলে ৮৫ রানের ইনিংসটায় ঔদ্ধত্য এতটাই। আউটও হলেন না। ধর্মসেনা দিয়ে দিলেন। ধর্মসেনা যা সাধারণত করে থাকেন।
তবে তাতে হাহাকার হলো না। কারণ কাজ হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডের এই দলটি তৈরি হয়েছে ব্যাটিং শৌর্যের সমীকরণ মেনে। এর মধ্যেও আলাদা ওদের ওপেনিং জুটি। হেলস-রয় শুরুতে বোলারদের শেষ করে দেবেন। ভগ্ন মনোবলের প্রতিপক্ষদের ধুলোয় মেশাতে মরগানদের আর সমস্যা হয় না। সমস্যা দেখা দিল বিশ্বকাপের আগে হেলস ছিটকে পড়ায়। কিন্তু শূন্যতাটা অনুভূতই হয় না, কারণ বেয়ারস্টো যেন তাঁরই কার্বন কপি। কিন্তু যখন রয় থাকেন না তখন শূন্যতাটা এমন হাঁ করে যে তাতে আরেকটু হলে ইংল্যান্ড বাদই পড়তে বসেছিল। ভারতের সঙ্গে ফিরলেন তিনি। ফিরতেই সেই ব্যাটিং শৌর্যেরও প্রত্যাবর্তন। ইংল্যান্ড হয়ে উঠল সেই ইংল্যান্ড; যাদের বিপক্ষে বোলিংটা খোলে না। ওটাকে ধ্বংস করে।
ম্যাচকে ঘিরে ইতিহাস জেগে ওঠে। পুরনো বৈরিতা নতুন পোশাক ধারণ করে আবির্ভূত হয়। কিন্তু তাহলেও অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচ নিয়ে সেই আগুনে উত্তেজনা নেই। পত্রপত্রিকা বা খেলোয়াড়দের আচরণে যে যুদ্ধংদেহি আওয়াজ, সমর্থকদের মধ্যে এর রেশ নেই। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশই যেন। আর তাতে করে কাল এজবাস্টনে যেন হারিয়ে যেতে বসা চিরন্তন ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির স্বাদ পেলাম। ইংল্যান্ড দারুণ বল করছে, আর্চার-উড-ওকসদের জন্য সমর্থকরা হাততালি দিচ্ছে। কিন্তু আবার ঠিকই একই রকম হাততালি স্মিথের জন্য। মিথের বীরদের মতো একাই একটা দল হয়ে চালিয়ে গেলেন। আর কী সে চালানো! একেকবার তো মনে হচ্ছিল, স্মিথ মনে হয় অন্য উইকেটে, অন্য বোলারদের খেলছেন। বল যখন অন্যদের খাবি খাইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি শট খেলার জন্য এত সময় পাচ্ছেন যেন বল ব্যাটে আসতে ভয় পাচ্ছে। অথবা দেখাচ্ছে বিনয়ী শ্রদ্ধা। এই স্মিথকে আগের অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচে ইংলিশ সমর্থকরা দুয়ো দিয়েছিল ওঁর কীর্তির জন্য। কাল তাদেরই টুপিখোলা অভিনন্দন। ক্রিকেটীয় কীর্তি কখনো কখনো এত বড় যে রাজ্যের অপকীর্তি তার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। কালকের স্মিথের ব্যাটে একসঙ্গে চলল কলঙ্কমোচন এবং দলকে রক্ষা। প্রথমটা হলো, দ্বিতীয়টা পুরো হলো না। সেভাবে সঙ্গী পেলেন না যে। প্রথমে ক্যারি সঙ্গ দিলেন, পরে খানিকটা স্টার্ক। শেষে তাই মরিয়া চেষ্টায় রান আউটে শেষ হলো ৮৫ রানের অনন্য সংগ্রাম। তাতে অস্ট্রেলিয়ার সম্মানটা প্রাথমিকভাবে রক্ষা পেল। পরে অবশ্য তা দু শ পেরিয়ে ২২৩ পর্যন্ত গেল। যাকে তখন মনে হচ্ছিল লড়ার স্কোর। সৌজন্য জেসন রয়, মনে হলো কয়েক মুঠো রান। ভাবা যায়, ইংল্যান্ড ম্যাচটা জিতেছে প্রায় ১৮ ওভার হাতে রেখে, মাত্র ২ উইকেটের ব্যয়ে।
সবাই এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে ভালোবাসছে সেটা ওদের দুর্ধর্ষ ব্যাটিংয়ের জন্য। বিশ্বকাপে জোফরা আর্চার যোগ হয়ে বোলিং ইউনিটেও এমন রং দিলেন যে ইংল্যান্ড আর একমাত্রিক দল নয়। একমাত্রিক বলতে, আগে ধারণা ছিল ওরা শুধু রান করতে পারবে। ব্যাটিং সহায়ক উইকেট না হলে সাড়ে তিন শ-চার শ করতে পারবে না। কিন্তু এখন অন্য ছবি। সুযোগে ওদের পেসাররাও হূদ্যন্ত্র বন্ধ করে দিতে পারেন যেকোনো ব্যাটিংয়ের। কাল শুরুতে আর্চার আর ওকস যেমন করলেন। ক্যারির তো রক্তই বের হয়ে গেল। এই রক্তারক্তি করার মতো বোলিংয়ে ১৪ রানেই নেই ৩ উইকেট। ওয়ার্নার-ফিঞ্চ দুজনেই ফিরে গেছেন। এই বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়ান সাকসেস ফর্মুলাই দাঁড়িয়েছে এই সহজ শর্তের ওপর ভর করে। ওয়ার্নার বা ফিঞ্চ কেউ একজন সেঞ্চুরি করবেন। তাতে বড় স্কোর। বাকিটার জন্য তো স্টার্করা আছেনই। কিন্তু দুজনই ব্যর্থ হলেন এমন দিনে এসে যেদিন না পারলে আগের সব পারাগুলো ঢাকা পড়ে যায়। মূলত আর্চার-ওকসের সঙ্গে ওয়ার্নার-ফিঞ্চের এই খণ্ডযুদ্ধের ফলেই আসলে একরকম ম্যাচের ঠিকানা ঠিক হয়ে যায়।
কিন্তু রক্তস্নাত ক্যারি আবার দাঁড়ালেন। জুটি গড়ে ফেলছেন স্মিথের সঙ্গে। মনে হলো, অবিশ্বাস্য একটা গল্প তৈরি হচ্ছে পাল্টা লড়াইয়ের। ১৪ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর ১০৩ রানের জুটি তো সেই স্ক্রিপ্ট ধরেই আগাচ্ছে। মর্যাদা হারানো স্মিথ ব্যাটে মর্যাদা ফিরে পাচ্ছেন, রক্তমাখা ক্যারি লড়ছেন রক্ত মুছে—ক্রিকেট রোমান্টিকের মন তখন চনমনে। এই তো সে চায়।
কিন্তু রোমান্টিকতা যেমন ক্রিকেটে আছে, তেমনি আছে খেয়ালি অনিশ্চয়তা। এবং ব্যাটসম্যানের খেলা হয়ে গেল বলে যাঁরা খুব আফসোস করেন তাঁরা এটা ভুলে যান, ব্যাটসম্যানরা যতই সুবিধাভোগী হোক শেষ পর্যন্ত ওদের জন্য এটা এক বলের খেলা। আদিল রশিদদের জন্য তা নয়। তাই আগের কয়েক ওভার ভুল লাইন-লেংথে বল করে বিস্তর মার খাওয়ার পরও তিনি নায়ক। সেই বলটাও ছিল মারার। ফ্লিকও চমৎকার করেছিলেন ক্যারি। কিন্তু বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ। বীরগাথা আর ব্যর্থতায় কয়েক হাতের পার্থক্য। আবার এতক্ষণের বিবর্ণ রশিদ এখন ধারালো। স্টয়নিসকে ওই ওভারেই ফিরিয়ে দিয়ে স্কোর বানালেন ৫ উইকেটে ১১৮। বদলে গেল গতিপ্রকৃতি। স্মিথ রইলেন। তবে অস্ট্রেলিয়া আর ঠিক রইল না। আর পরে হলো রয়ের রথে পিষ্ট।
তাই সেই ফাইনাল, যে ফাইনাল ক্রিকেটীয় ভাবনায় স্বপ্নের ফাইনাল হয়তো নয়, তবে নতুনত্বের ফাইনাল। মিলবে দেখা নতুন চ্যাম্পিয়নের।
পিবিএ/বাখ