জীবনের জন্য গাছ

পিবিএ ডেস্ক: পৃথিবীতে মানুষ আসার আগেই উদ্ভিদের সৃষ্টি। আদিকাল থেকেই মানুষ ও প্রাণিকুল নিজেদের খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক সভ্যতা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে চাপ পড়েছে উদ্ভিদের ওপর। বিলুপ্ত হচ্ছে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল। আর এ প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিচ্ছে- অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়সহ বহুবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। হুমকিতে পড়ছে আমাদের প্রতিবেশ, পরিবেশ ও মানবজাতি। বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের ভারসাম্য রক্ষায় যে পরিমাণ বৃক্ষরাজি থাকা দরকার সে পরিমাণ না থাকায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি হুমকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মতো উপকূলবর্তী বদ্বীপগুলো।

পরিবেশ সুরক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বৃক্ষরাজি অনেক কম। তাই সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যেমন- পরিবেশ মেলা, বৃক্ষমেলা, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি, বসতবাড়ি বনায়ন কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ফলদ-বনজ-ভেষজ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম, ফলদ বৃক্ষমেলা প্রভৃতি। ‘জীবিকার জন্য গাছ, জীবনের জন্য গাছ’- এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ বন অধিদফতরের উদ্যোগে ঢাকার শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন মাঠে চলছে মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা। মেলায় ৮৮টি সরকারি-বেসরকারি স্টল থেকে সব ধরনের গাছের চারাই সংগ্রহ করা যাবে। পাশাপাশি পাওয়া যাবে বহুবিধ উপকরণ ও সেবা।

বর্ষাকাল গাছের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। সাধারণত উর্বর, নিষ্কাশনযোগ্য ও উঁচু স্থানে গাছের চারা রোপণ করা উত্তম। বসতবাড়ির দক্ষিণপাশে রোদ ও আলোর জন্য ছোট এবং কম ঝোপালো গাছ যেমন- সুপারি, নারিকেল, নিম, সজনে, দেবদারু, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, ডালিম গাছ লাগানো যেতে পারে। তবে উত্তরপাশে বড় ও উঁচু গাছপালা থাকলে ঝড়-তুফান প্রতিরোধ হয়। তাই উত্তরপাশে আম, কাঁঠাল, জাম, মেহেগনি, সেগুন, বাঁশ ইত্যাদি গাছ রোপণ করা ভালো। আবার বসতবাড়ির পূর্ব ও পশ্চিম পাশে মাঝারি উঁচু গাছ যেমন- কুল, সফেদা, আম্রপলি, লিচু, খেজুর, তাল, আতা, বেল, পেয়ারা প্রভৃতি লাগালে সারাদিন বসতবাড়ির আঙিনায় আলো পাওয়া যায়।

বসতবাড়িতে গাছ লাগান নিয়ে বেশ কিছু খনার বচন প্রচলিত রয়েছে। যেমন- ‘উঠান ভরা লাউ শসা, খনা বলে লক্ষ্মীর দশা’। ‘হাত বিশেক করি ফাঁক- আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ’। ‘নারিকেল বারো হাত সুপারি আট এর থেকে ঘন হলে তখনি কাট’। ‘পূবে হাঁস- পশ্চিমে বাঁশ, উত্তরে কলা- দক্ষিণে খোলা’। এছাড়াও বিভিন্ন অফিস, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় শোভাবর্ধনকারী ও ছায়া প্রদানকারী গাছ যেমন- কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশ, সোনালু, জারুল, বকুল, নাগেশ্বর, বকফুল, নারিকেল, পাম, দেবদারু, ঝাউ প্রভৃতি গাছ লাগান যায়। তবে হাট-বাজারে ছায়া প্রদানকারী গাছ যেমন- বট-পাকুড়, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি লাগান ভালো। পতিত জমিতে যে কোনো গাছই লাগান যায়। বাঁধ, মহাসড়ক বা রেললাইনের পাশে দেবদারু, সেগুন, মেহগনি, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা, কড়ই, অর্জুন, হরীতকী, নিম, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, তাল প্রভৃতি গাছ লাগান উত্তম। নিচু জমিতে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এমন গাছ যেমন- মান্দার, জারুল, হিজল, ছাতিম, বরুণ, অর্জুন, করচ, পিটালি, কদম, বাঁশ, বেঁত প্রভৃতি গাছ লাগাতে হবে। চর এলাকায় বাবলা, ঝাউ, কড়ই, জারুল, বাইন, কাঁকড়া, গরান প্রভৃতি গাছ লাগান যায়। পাহাড়ি এলাকায় গর্জন, গামারি, সেগুন, শিলকড়াই, চাপালিশ, তেলসুর, কাজুবাদাম, কমলালেবু প্রভৃতি গাছ লাগান উত্তম।

গাছ লাগানোর জন্য সতেজ, সবল, রোগমুক্ত, সোজা, কম শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট চারা নির্বাচন করতে হবে। নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহের পর কয়েকদিন ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিয়ে চারাকে হার্ডেনিং করে নিতে হবে। এতে চারাগাছ মরে যাওয়ার ঝুঁকি কমে। গাছভেদে নির্দিষ্ট দূরত্বে চারাগাছ রোপণ করতে হবে। গাছের চারা রোপণের আগে মাটি গর্ত করে জৈবসার দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হবে। চারার পলিথিন ব্যাগ অপসারণ করে আলতোভাবে গোড়ার মাটির চাকাসহ সোজা করে বসিয়ে দিতে হবে। তারপর চারার চারপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রথমে উপরের উর্বর মাটি এবং পরে নিচের মাটি দিয়ে ভালোভাবে পূরণ করে দিতে হবে। চারা লাগিয়ে শক্ত খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। চারপাশে বাঁশের খাঁচা দিয়ে বেড়া দিতে হবে। চারার গোড়ায় প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। মাটির আর্দ্রতা রক্ষায় গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে খড়-কুটো বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কোনো কারণে চারাগাছ মারা গেলে দ্রুত নতুন চারা ওই গর্তে রোপণ করতে হবে। সাধারণত বছরে দু’বার বর্ষার আগে ও পরে গাছের গোড়ায় সুষম সার দিতে হয়। সার দেয়ার পর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও গাছের মৃত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। এছাড়াও রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

কথায় আছে- ‘যে দেশে নাই তরু, সেই দেশটা হয় মরু’। একটি গাছ পঞ্চাশ বছরে যে উপাদান ও সেবা দিয়ে থাকে তার আর্থিক মূল্য প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা। একটি গাছ এক বছরে দশটি এসি’র সমপরিমাণ শীতলতা তৈরি করে, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে, ৬০ পাউন্ড ক্ষতিকর গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। একটি বড় গাছ দিনে একশ’ গ্যালন পানি বাতাসে ছেড়ে দেয়। এক হেক্টর সবুজ ভূমির উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ চলাকালে প্রতিদিন গড়ে নয়শ’ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ৬৫০ কেজি অক্সিজেন দান করে। এছাড়াও বৃক্ষরাজি ৮৯ থেকে ৯০ ভাগ শব্দ শোষণ করে দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। নিমগাছের শব্দ শোষণক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও বৃক্ষরাজি আবহাওয়ার তাপমাত্রা হ্রাস করে, বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায় ও ভূমিক্ষয় রোধ করে। তাই পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। নগরীতে বাড়ির ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করা যায়। এছাড়াও আপনার ঘরের ভেতরে শোভাবর্ধণকারী গাছ লাগাতে পারেন। টবে গাছ লাগিয়ে ঘরে রাখুন, জানবেন একটি জীবন্ত সাথী সব সময় আপনাকে দেখছে। গাছের অপর নাম জীবন। গাছ আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ, জ্বালানি, অর্থ সর্বোপরি জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেয়। একটি গাছ কাটার আগে একবার ভেবে দেখুন তো, এ গাছটির কতটুকু যত্ন আপনি করেছেন বা এ রকম কয়টা গাছ আপনি লাগিয়েছেন। তাই একটি গাছ কাটার আগে অন্তত তিনটি গাছের চারা রোপণ করুন।

পিবিএ/ইকে

আরও পড়ুন...