গুজব,সন্দেহ এবং সাম্প্রতিক নৃশংসতা

অলোক আচার্য: বর্তমানে আমাদের দেশে গুজব শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। নানা ধরনের গুজব বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যা রীতিমতো বিশ্বাস করাও কষ্টকর সেই গুজবে নানা হ্রিংস কর্মকান্ড ঘটছে। মানুষের প্রাণ যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। সেসব গুজবে কান দিয়ে মানুষ ও দেশের ক্ষতি হচ্ছে। গুজব বলতে সাধারণত বোঝায় কোন ব্যক্তি, কোন গোষ্ঠি বা কোন দলের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক কোন অপপ্রচার যার পেছনে বেশিরভাগ সময়ই কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। কোন অসত্য তথ্য বা প্রচার যা কারও ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়ও বিঘ্ন হতে পারে। আমরা খুব সহজেই গুজবে কান দেই। আমাদের শিক্ষা দীক্ষার কোনোকিছুর প্রয়োগ না করেই বিশ্বাস করে নিচ্ছি। কোনোকিছু শুনলেই বিশ্বাস করতে হবে? যেখানে চোখে দেখেও আজকাল বিশ্বাস করাটা বেশ কষ্টকর। সেখানে কারও কাছ থেকে কিছু শুনেই সেটা বিশ্বাস করা এবং তা নিজের মতো প্রচারের কাজে লেগে পরা! চিলে কান নিয়েছে শুনে কান উদ্ধারের জন্য সবাই চিলের পেছনে ছুটি। একবারও নিজের কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করার কথা মনে করি না। আমরা এতটাই নিষ্টুর যে কে সত্যিকার অর্থে ছেলেধরা তা বিচার বিবেচনা না করেই পিটিয়ে মেরে ফেলি! নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মেয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে দেখেছি।

এ ছাড়াও একজন মহিলাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে কেবল সন্দেহের বশে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে আধমরা করা হয়েছে অনেককে। কেবল সন্দেহ করেই কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলছি আমরা! গণপিটুনিতে আহত হওয়ার ঘটনা দেশে বেশ কয়েক স্থানে ঘটেছে। কি আশ্চর্য! আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার গুজবে কান দিতে নিষেধ করলেও আমরা তা শুনছি না। কেউ অপরাধী হলে তার জন্য আইন আছে। আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি। আইনের হাতে তুলে দেয়ার বদলে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো সভ্য জাতির কাজ হতে পারে না। যদি জানা যায় সে নির্দোষ তবে তাকে কি আর ফিরিয়ে দেয়া যাবে? এটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু না। আমাদের কান গুজবের জন্য খোলা! কাউকে হেয় করার বা কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। আজকাল গুজব ছড়াতে ডিজিটাল মাধ্যমই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার করা হয় গুজব ছড়াতে। কারণ এসব মাধ্যমে কোন অসত্য তথ্য প্রচার করা দ্রুততর এবং তুলনামূলক গুজব সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সাময়িক নিরাপদে অবস্থান করতে পারে। গুজবের ক্ষেত্র আজকাল বিস্তৃত হয়েছে। রাজনীতি,ধর্মীয়,সামাজিক বা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানো হয়। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে অপপ্রাচার কাজে লাগিয়ে হীন স্বার্থ উদ্ধার করা। গুজব ক্ষেত্রবিশেষে অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।

গুজবে প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় নিরীহ মানুষও প্রভাবিত হয় এবং নেতিবাচক কার্যে জড়িয়ে পরে। আজকাল অনলাইনের যুগে গুজব সৃষ্টি করাটা বেশ সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুলে এসব ভুল তথ্য প্রচার করছে। একসময় দেখা যেত সুদূর গ্রামে গঞ্জে কোন ভন্ড কবিরাজ মিথ্যা রোগ-শোকের ভয় দেখিয়ে কোন গুজব সৃষ্টি করতো। সেসময় মানুষ ছিল অশিক্ষিত। ফলে খুব সহজেই এসব গুজবে কান দিত। এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নিরীহ গ্রামবাসীকে ভয় দেখিয়ে পকেট ভর্তি করা। এছাড়া ওঝা,ভন্ড পীর- বা সন্ন্যাসী এসব গুজব কাজে লাগিয়ে মানুষের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেছে। এসব পকেট ভারী করা মানুষ আগে যেমন ছিল, এখনও আছে। আজও আমাদের রাস্তা ঘাটে এসব টোটকা ওষুধের তথাকথিত গাছ গাছড়াও চিকিৎসা দেখা যায়। তাদের চারপাশের ভিড় করা মানুষগুলো নিমগ্ন চিত্তে তার কথা শোনে। এরা এমনভাবে রোগের বর্ননা করে যে সে বিশ^াস করে ফেলে। গুজব কেবল এসব ভন্ড অপচিকিৎসকদের ভেতরেই সিমাবদ্ধ নেই। এর প্রবেশ ঘটেছে রাজনীতিতে নোংরা খেলায়। কোন দল বা গোষ্ঠীকে বিপদে ফেলতে গুজব ছড়ানোর নজির আামদের দেশে রয়েছে। এখন এটা হরহামেশাই ঘটছে। গজব প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাজও করে যাচ্ছে। গুজবের প্রধান টার্গেট থাকে জনগণের সরলতাকে কাজে লাগানো। কোন ষড়যন্ত্র যখন ব্যর্থ হয় তখন গুজব ছড়ানো হয়। আমাদের এই ভারতবর্ষেই গুজব ছড়ানোর অনেক ইতিহাস রয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময়কালে কার্তুজে গরু এবং শুকুরের চর্বি ব্যাবহারের গুজব তুলে হিন্দু এবং মুসলিম সৈনিকদের উত্তেজিত করে তুলেছিল। এরকমভাবে বহুবার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য গুজবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করা হয়ছে। বিভিন্ন সময় গুজবকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিলও করেছে গুজব সৃষ্টিকারীরা। চিলের কান নেয়ার কবিতাটা আমরা প্রায় সবাই জানি। কানের খোঁজে সেই যে ছুট দিল চিলের পেছনে কিন্তু সেই চিলটাকে আর ধরতে পারলো না। গুজব এরকমই হয়। কোন গুজবে কান দিয়ে ছুটলে কেবল গুজবসৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যই হাসিল হয়, কাজের কাজ কিছু হয় না। আমাদের অদৃশ্য কান মাঝে মধ্যেই চিল নিয়ে ছুট দেয়, আর আমরাও সেই চিলটার পেছনে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে একসময় কানে হাত দিয়ে নিশ্চিত হই যে কান সাথেই আছে। সম্ভব-অসম্ভব, সত্য-মিথ্যা কোন বিচার বিবেচনা না করেই গুজবের পেছনে ছোটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। গুজব আসলে এক ধরনের বিভ্রান্তি।

কিভাবে আমরা এই গুজবের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি নিজেকে? কোন গুজব বিশ^াস করার আগে প্রত্যেকের উচিত সেই ছড়ানো বিভ্রান্তি একবার হলেও ভালোভাবে যাচাই করে নেয়া। কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যাচাই করতে হবে। তারপর ঘটার সম্ভাবনা থাকলে ঘটনার পেছনে ছুটতে হবে। তবে অধিকাংশ গুজবই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। যার পেছনে ছোটা কেবল সময়ের অপচয়ই নয় বরং থাকে জীবনের ঝুঁকি। আজকাল ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব সৃষ্টি হচ্ছে খুব বেশি। যেহেতু আমাদের সবার হাতে হাতে এন্ড্রয়েট চালিত মোবাইল ফোন রয়েছে এবং শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট রয়েছে তাই কোন মিথ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য ছড়িয়ে দিতে বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। খুব দ্রুত একজন থেকে অন্য জনে ছড়িয়ে পরে। তাই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া একটু সময়ের ব্যাপার। ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব সৃষ্টিকারীরা প্রযুক্তির ব্যাবহারে দক্ষ হয়। তবে এ ধরনের গুজব প্রতিরোধে কতৃপক্ষ এখন আগের চেয়ে অনেক সজাগ রয়েছে। গুজব সৃষ্টিকারীরা কোনভাবেই যেন বিভ্রান্তি না ছড়ায় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নিজেদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। কোন অদৃশ্য কানের পেছনে ছোটার আগেই যদি নিজের কানটা একবার দেখে নেয়া যায় তাহলে গুজবের পেছনে ছোটা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়, কোন দুর্ঘটনা বা কিছু নিরীহ প্রাণ অযথাই ঝরে যাওয়া থেকে রক্ষা পায় কেবল একটু সচেতনতায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

পিবিএ/জেআই

আরও পড়ুন...