পিবিএ ডেস্কঃ বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবারো ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বে মুসলমানরা হিজরি বর্ষের দ্বাদশ মাস জিলহজের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপন করে। আরবের অনেক দেশে একে বড় ঈদ বা ঈদুল কুবরাও বলা হয়ে থাকে। অন্যান্য দেশেও এর নিজস্ব ভিন্ন নামও রয়েছে, তবে এর অর্থ ও তাৎপর্য অভিন্ন। মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশে হযরত ইবরাহিম (আ)-এর নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর জন্য কোরবানি করার ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেয়ার লক্ষ্যে পবিত্র হজের পরদিন ঈদুল আজহা উদযাপন ও পশু কোরবানি করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ)-এর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রের পরিবর্তে তাকে পশু কোরবানি করার নির্দেশ দেন। হযরত ইবরাহিম (আ)-এর সে সুন্নাত অনুসরণে ঈদুল আজহার সময় মুসলমানরা পশু কোরবানি করেন।
ঈদুল আজহাঃ ঈদ শব্দের অর্থ অভিধানে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে উৎসব, খুশির দিন এবং যা বারবার আসে অন্যতম। আর আজহা অর্থ কোরবানি, ত্যাগ, উৎসর্গ বা কোরবানির পশু ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে কোরবানির বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাদিসেও ‘কোরবানি’ শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর পরিবর্তে ‘উজহিয়াহ’ ও ‘জাহিয়া’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ জন্যই কোরবানির ঈদকে ‘ঈদুল আজহা’ বলা হয়। আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসি বা উর্দুতে ‘কোরবানি’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ ইত্যাদি। উল্লিখিত শব্দ এবং অর্থগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ত্যাগ বা বিসর্জন অর্থাৎ কোরবানিকে ভিত্তি করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের যে সুনির্দিষ্ট আনন্দময় অপার সুযোগ তাকেই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ বলে। পারিভাষিক অর্থে ‘কোরবানি’ ঐ কাজকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়। আর প্রচলিত অর্থে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরয়ি তরিকায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। সকালে রক্তিম সূর্য ওপরে ওঠার সময়ে ‘কোরবানি’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আজহা’ বলা হয়ে থাকে।
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানিঃ মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হযরত আদম (আ)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। এ ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদসহ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে কাসির একে ওলামায়ে মোতাকাদ্দেমিন ও ওলামায়ে মোতায়াখ্খেরিনের সর্বসম্মত উক্তি বলে আখ্যা দিয়েছেন। হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর পৃথিবীতে আগমনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে মানুষ বিস্তার শুরু হয়। তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন হযরত আদমের আর কোন সন্তান ছিল না। মহান আল্লাহ উপস্থিত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আদম (আ)-এর শরিয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পরের সহোদর ভাইবোন গণ্য হবে। সুতরাং তাদের মধ্যে পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভের কন্যা সহোদরা বোন গণ্য হবে না। তাই তাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে। কিন্তু কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ‘আকলিমা’ ছিল খুবই সুশ্রী সুন্দরী। আর হাবিলের সহজাত বোন ‘গাজা’ ছিল তুলনামূলক কম সুন্দরী। বিবাহের সময়ে হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত বোন কাবিলের সাথে বিয়ের কথা হলে কাবিল জেদ ধরল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। হযরত আদম (আ) তাঁর শরিয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন।
অতঃপর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাবিল ও কাবিলের দুইজনের মধ্যে হাবিলের কোরবানি গৃহীত হয়। এতে কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। সে হাবিলকে হত্যা করার সঙ্কল্প করে এবং একপর্যায়ে তাকে হত্যা করে। এই কোরবানির ঘটনা পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে-‘আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনাটি সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। তা হচ্ছে এই যে, যখন তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত হলো আর অপরজনের কোরবানি গৃহীত হলো না। তখন সে ভাইকে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বলল আল্লাহ তো মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। নিশ্চয়ই আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা মহান আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি দোজখিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সে কিভাবে সমাহিত করবে। এ দৃশ্য দেখে সে বললো, হায় আফসোস! আমি এ কাকটির মতোও হতে পারলাম না যাতে নিজের ভাইয়ের লাশটিও লুকাতে পারি। এরপর নিজের কৃতকর্মের জন্য সে খুবই অনুতপ্ত হলো। (সূরা আল মায়িদাহ : ২৭-৩১)
কোরবানির ধারাবাহিকতা ও বাধ্যবাধকতাঃ কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। কোরবানি নামক এ মহান নিদর্শন আদম (আ)-এর পর থেকে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরিয়তেই কার্যকর ছিলো। সকল নবীর উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছিন্নভাবে কোরবানির ধারাবাহিকতা চলে আসছে তথা সকল নবীর উম্মতকেই কোরবানি করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোনভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে। এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব বা ফিতরাত। এ ফিতরাতের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সূরা হজ : ৩৪)
আমাদের কোরবানি সুন্নাতে ইবরাহিমিঃ আমাদের ওপর যে কোরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত হযরত ইবরাহিম (আ) কর্তৃক শিশুপুত্র ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর রাহে কোরবানি দেয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহিমি’ হিসেবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহিম ও ইসমাইল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আজহা’ বা কোরবানির ঈদ। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু পুত্র ইসমাইলকে তাঁর উদ্দেশ্যে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আজহার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের প্রিয়তম জানমাল আল্লাহর পথে কোরবানি করার সাক্ষ্য প্রদান করেন। হযরত ইবরাহিম (আ)-এর সেই মহত্ত্ব ও মাকবুল কোরবানিকে শাশ্বত রূপদানের জন্যই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা) এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আজহা উপহার দিয়েছেন এবং কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত ইবরাহিম (আ)-এর ঈমানের পরীক্ষামুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ)কে মহান আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা করেছেন। তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায় পূর্ণ সফলকাম প্রমাণিত হয়েছেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তাকে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে।
এক. তাওহিদের হেফাজতের প্রয়োজনে হযরত লুত (আ)কে সাথে নিয়ে চিরদিনের জন্য প্রিয় জন্মভূমি ইরাক ত্যাগ করে ফিলিস্তিনের কেনানে হিজরত করলেন। ৮৬ বছর বয়সে সেখানে বসে সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে পরওয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্রসন্তান দাও।’ (সূরা আস সাফফাত : ১০০) এ দোয়ার জবাবে মহান আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ)কে সুসংবাদ দিয়ে বললেন, ‘আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ (সূরা আস সাফফাত : ১০১)
দুই. নমরুদ কর্তৃক প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়ে চরম ধৈর্য ও আল্লাহর প্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর খলিলের জন্য আগুনকে ফুলবাগিচায় পরিণত করে দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি বললাম, হে আগুন, তুমি ইবরাহিমের ওপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’
তিন. অতঃপর যখন তাঁর প্রিয় আদরের পুত্র ইসমাইল ও প্রিয় স্ত্রী হযরত হাজেরা (আ)কে মক্কার বিরাণ মরুভূমিতে রেখে আসার আদেশ হলো সেটাও ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কেননা বার্ধক্য ও শেষ বয়সের বহু আকাক্সক্ষার স্বপ্নসাধ, দিবা-রাত্রির প্রার্থনার ফল এবং পরিবারের একমাত্র আশার আলো হযরত ইসমাইলকে শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পানি ও জনমানবহীন মরু প্রান্তরে রেখে এসেছেন। অথচ একবারও পেছনের দিকে ফিরেও তাকাননি। যেন এমন না হয় যে, পিতৃস্নেহ উথলিয়ে ওঠে এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কোন প্রকার বিচ্যুতি ঘটে যায়। স্ত্রী ও পুত্রকে সেখানে রেখে এসে তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করলেন, ‘হে আমাদের রব! আমি একটি তৃণ পানিহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি। পরওয়ারদিগার! এটা আমি এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামাজ কায়েম করবে। কাজেই তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো, হয়তো এরা শোকরগুজার হবে।’ (সূরা আল ইবরাহিম : ৩৭)
চার. উপরোল্লিখিত পরীক্ষাগুলোর কঠিন মঞ্জিল অতিক্রম করার পর হযরত ইবরাহিম (আ)-কে স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়, যা ছিল বিগত পরীক্ষাগুলোর চেয়েও অধিক কঠিন, হৃদয়বিদারক ও আল্লাহপ্রেমের কঠিন পরীক্ষা। হযরত ইবরাহিম (আ) স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয়বস্তু কোরবানি দেয়ার জন্য আদিষ্ট হন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন হযরত ইবরাহিম (আ) পরপর তিন রাত্রি দেখেছিলেন। প্রথমবার তিনি ১০টি উট কোরবানি করেন। আবারও একই স্বপ্ন দেখলে এবার তিনি ১০০টি উট কোরবানি করলেন। তৃতীয়বার যখন একই স্বপ্ন দেখলেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমার কাছে প্রিয়বস্তু একমাত্র কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাইল ছাড়া তো আর কিছুই নেই। মূলত আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাও তাই। প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার নির্দেশ তাঁকে এমন সময় দেয়া হয়েছিল, যখন অনেক দোয়া কামনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন পালন করার পর পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করতে পারে এবং তাঁকে সাহায্য করার যোগ্য হয়েছে। তাফসিরবিদগণের কেউ কেউ লিখেছেন- এ সময় হযরত ইসমাইলের বয়স ছিল তেরো। কেউ বলেছেন তিনি তখন বয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাফসিরে রুহুল বয়ানে আছে ৯ বছরের কথা। এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য যে, নবী রাসূলগণের স্বপ্নও ওহির অন্তর্ভুক্ত। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল এই যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহিম (আ) এর একমাত্র পুত্রকে জবেহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেয়ার কারণ হলো হযরত ইবরাহিম (আ)-এর আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা। হযরত ইবরাহিম (আ) মহান প্রতিপালকের নির্দেশ সত্বর পালনের নিমিত্তে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহিম (আ)- এর ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাই তিনি পুত্র ইসমাইলের সাথে পরামর্শ করার নিমিত্তে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন বল তুমি কি মনে করো?’ (সূরা আস সাফফাত : ১০২)
হযরত ইবরাহিম (আ)-এর আদর্শের ছাঁচে গড়া পুত্র ইসমাইল তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণে মস্তক অবনত করে জবাবে বললেন, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই হিসেবে পাবেন।’ (সূরা আস সাফফাত : ১০২)এরপর পিতা ও পুত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কোরবানির নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে গমন করেন। ইতিহাস ও তাফসির ভিত্তিক কোন কোন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, শয়তান কোরবানির মহান এ কাজে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করে। সে প্রথমে মা হাজেরা ও ইসমাইল (আ)-কে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁরা শয়তানের প্ররোচনাকে কোন পাত্তা দিলেন না। মরদুদ শয়তান হযরত হাজেরা (আ) ও হযরত ইসমাইল (আ)-কে ধোঁকা দেয়া থেকে নিরাশ হয়ে মদিনা যাওয়ার পথে ‘জামরায়ে আকাবাহ’, ‘জামরায়ে উসতা’ এবং ‘জামরায়ে উলা’ এই তিন জায়গায় তিনবার হযরত ইবরাহিম (আ)-কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে এবং হযরত ইবরাহিম (আ) তাকে প্রত্যেকবারই সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতিস্বরূপ মিনায় ঐ তিনটি স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করার বিধান হাজীদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন কোরবানির উদ্দেশে মিনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং ইবরাহিম (আ) ইসমাইল (আ)-কে কোরবানি করার জন্য শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাইল পিতা ইবরাহিম (আ) কে বললেন আব্বাজান! আমার হাত-পা খুব শক্ত করা বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা তাতে না পড়ে। অন্যথায় এতে আমার সওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হয়ে যেতে পারেন। আপনার ছুরিটি ভালো করে ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালামটুকু অনুগ্রহপূর্বক পৌঁছে দেবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইবরাহিম (আ) দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, ওগো আমার প্রাণপ্রিয় বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ। ইবরাহিম (আ) পুত্রকে আদর করে চুম্বন করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন। অতঃপর তাঁকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে, বারবার ছুরি চালানো সত্ত্বেও গলা কাটছে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজান! আমাকে উপুড় করে শুইয়ে নিন। কারণ আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে ওঠে। ফলে গলা কাটা যাচ্ছে না। ইবরাহিম (আ) তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুনরায় সজোরে প্রাণপণে ছুরি চালালেন। কিন্তু তখনও গলা কাটছে না। হযরত ইবরাহিম (আ)-এর এ প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং হযরত ইসমাইলের বিনা জবেহেই তার কোরবানি কবুল করে নিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের আনুগত্যের শির নত করে দিলেন এবং ইবরাহিম (আ) পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্য), তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক কঠিন পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কোরবানি দিয়ে ফিদিয়াস্বরূপ তাকে (ইসমাইলকে) উদ্ধার করেছি।’ (সূরা আস সাফফাত : ১০৩-১০৭)
অতঃপর মহান আল্লাহ নির্দেশ দিলেন এখন পুত্রকে ছেড়ে দিন এবং আপনার নিকট যে দুম্বাটি দাঁড়ানো রয়েছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে জবেহ করুন। তখন ইবরাহিম (আ) পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি হৃষ্ট-পুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো আছে। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সে দুম্বাটিকে জবেহ করলেন। এটাই সেই কোরবানি যা আল্লাহর দরবারে এতই প্রিয় ও মাকবুল হয়েছিল যে, আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে তা অবিস্মরণীয় রূপে বিরাজমান রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন।যার কারণে মিল্লাতে ইবরাহিমে তথা দ্বীন ইসলামের এক মহান ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে এ কোরবানি আজও পালিত হয়ে আসছে।
আল্লাহু আকবার তাকবিরের প্রেক্ষাপটঃ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজরত ইবরাহিম (আ) যখন কলিজার টুকরা পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন, তখন হজরত জিবরাইল (আ) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে একটা দুম্বা নিয়ে রওনা হলেন। তিনি ভাবলেন, না জানি আমি পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ইবরাহিম (আ) জবাই কাজ শেষ করে দেন! আর এ জন্যই জিবরাইল (আ) আকাশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’। এমন মধুর ধ্বনি শুনে হজরত ইবরাহিম (আ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। হজরত ইসমাইল (আ) পিতার মুখে তাওহিদের বাণী শুনতে পেয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ হজরত জিবরাইল (আ) এবং দুই নবীর কালামগুলো আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতরের দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে ওই কালামগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে।
ঈদুল আজহার গুরুত্বঃ ঈদুল আজহার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকিদ দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,১. ‘আর কোরবানির পশুসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা হজ : ৩৬)২. ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাইলের) পরিবর্তে জবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কোরবানি। এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।’ (সূরা আস সাফফাত : ১০৭-১০৮)৩. ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় কর এবং কোরবানি কর।’ (সূরা কাওসার : ২)৪. রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিনে মানবসন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট এত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কোরবানি করা। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো।’ (তিরমিজি)৫. রাসূল (সা) আরো বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনে মাজাহ)কাজেই কোরবানি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহিম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে মদিনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কোরবানি করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত। কোরবানি ও জীবনদানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী (সা)কে আরো নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য, যার কোন শরিক নেই। এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী।’ (আল আন’আম : ১৬২-১৬৩)
ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্যঃ-
১. ঈদুল আজহা হযরত ইবরাহিম (আ), বিবি হাজেরা ও ইসমাইলের পরম ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত উৎসব। ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণেই ইবরাহিম (আ)কে পবিত্র কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও।’ (সূরা হজ : ৭৮) এ পরিবারটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য ত্যাগের মহত্তম আদর্শ। তাই ঈদুল আজহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ইবরাহিমি সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে।
২. কোরবানি হলো চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধাতা প্রতি মুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশেই নিবেদিত এবং কোরবানি হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক।
৩. কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কিনা সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কোরবানি আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহিম (আ)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদেরকে এখন আর পুত্র কোরবানি দেয়ার মতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি ‘মুসান্নাহ’ হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। ঈমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যত বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন তারাই হন তত বড় খোদাপ্রেমিক ও ততই সফল মানুষ এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ততই সফল। ঈদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততটাই উপভোগ করতে পারেন যতটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হন।
৪. কোরবানির পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে কোরবানির সওয়াব গ্রাহ্য হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, যে অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইবরাহিম (আ) স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের স্কন্ধে ছুরি উত্তোলিত করেছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেয়ার সময়ে কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে। কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী যদি সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত না হয়ে ওঠে, তাদের দেহ আর মনের পরতে পরতে যদি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তাদের এই কোরবানির উৎসব গোশতখুরির পর্বেই পর্যবসিত হবে। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কোরবানিদাতাদের সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কোরবানির পশুর গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা হজ : ৩৭)
৫. কোরবানি কেবল পশু কোরবানি নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহঙ্কার ত্যাগের কোরবানি। নিজের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি। এই কোরবানি পশু জবেহ থেকে শুরু করে নিজের পশুত্ব জবেহ বা বিসর্জন এবং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার রাস্তায় শাহাদতবরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কোরবানি মানুষের আকাক্সক্ষা, নিয়ত, প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
৬. মূলত কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কোরবানি সার্থক হয়েছে, কোরবানির ঈদ সার্থক হয়েছে। নতুবা এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কুরআনে বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরবানির গোশত আল্লাহর কাছে যায় না। যতটুকু যায় বা রেকর্ড হয়ে থাকে তা হলো আমাদের মনে আল্লাহপ্রেমের গভীরতার মাত্রা। কোরবানির গোশত দরিদ্রদের জন্য যতটুকু বিলিয়ে দেয়া হয় কেবল সেটাই পরকালে আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। আর যেটাকে আমরা আমাদের অংশ মনে করে কৃপণের ধনের মতো আঁকড়ে আছি সেটাই বরং আমাদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে আছে যা আমরা জানি না। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো।’ (সূরা আল বাকারাহ : ২৬৭) কাজেই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সকল বিত্তশালী লোককে এগিয়ে আসতে হবে। সারা বছর, সারা জীবন সাধ্যমত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। চিত্ত আর বিত্তের মিল ঘটানোর জন্যই আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বারবার মানুষকে আহ্বান করেছেন।
৭. কোরবানি কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কোরবানিতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফল মনোরথ ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমাদের সমাজে আজ অনেককে বড় বড় পশু ক্রয় করে প্রদর্শন করা কিংবা বাহাদুরি জাহির করতে দেখা যায়। আবার অনেককে দেখা যায় গরিব-মিসকিনদের যথাযথভাবে না দিয়ে ঈদের দিন নিজেরা যৎসামান্য গোশত রান্না করে; আর বাকিটা ফ্রিজে রেখে দেয়। এরপর সারা বছর কিছু কিছু নিয়ে নিজেরা খায়। এসব কোনো মতেই প্রকৃত কোরবানির পর্যায়ে পড়ে না। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু ক্রয় করে প্রদর্শন করা, বাহাদুরি জাহির করা অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে কোরবানি কবুল হবে না। তা কেবলমাত্র পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এসব পশুর রক্ত আর গোশত যেমন আল্লাহর নিকট যায় না তেমনি গ্রহণযোগ্যতা পায় না এগুলোর কোরবানিও। হালাল উপার্জন, ইখলাস ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। কে কত টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করল, কার পশুটি কত মোটাতাজা বা সুন্দর, আল্লাহ তা দেখেন না। তিনি দেখেন সহিহ নিয়ত ও তাকওয়া। মূলত আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জজবা সৃষ্টি করা, ইবরাহিম (আ)-এর পুত্র কোরবানির ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করাই ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য।
ঈদুল আজহার চিরায়ত শিক্ষামানুষ মহান আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহিম (আ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত- সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি আত্মসমর্পিত হয়ে যাওয়া। স্বামী, স্ত্রী ও শিশু-পুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশি করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে জবেহ করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ-এসবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহিদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহিম (আ) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কোরবানি করার মধ্য দিয়ে মূলত পুত্রের মুহাব্বতকে কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে। ইবরাহিম (আ)-এর নিকট থেকে আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হলো প্রকৃত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। ইবরাহিম (আ) তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাইল (আ)কে কোরবানি করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে। আর ইসমাইল নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব ও জ্বলন্ত শিক্ষা প্রদান করে গেছেন। মূলত আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার নামই হলো আত্মসমর্পণ। পিতা-পুত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, আজকে ইবরাহিমি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পশু কোরবানির সাথে সাথে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জান, মালসহ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত আছি। আর এটিই হলো কোরবানির শিক্ষা।হযরত ইবরাহিম (আ) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তোমাদের জন্য ইবরাহিম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ বিদ্যমান।’ (সূরা মুমতাহিনা : ৪)
কোরবানি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় মাসায়েলঃ-
১. যার ওপর ফিতরা ওয়াজিব তার ওপর কোরবানিও ওয়াজিব। (অর্থাৎ ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত পারিবারিক প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি যদি ‘নেসাব’ পরিমাণ মালের মালিক হয়, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। (শরিয়তের ভাষায় নেসাব পরিমাণ মাল বলা হয়, সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ কিংবা তৎসম মূল্যের সম্পত্তি।) কিন্তু ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও যদি কোরবানি করে, তবে নফল কোরবানির জন্য অনেক সওয়াব পাবে।
২. ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত এ তিন দিন কোরবানি করার সময়। কিন্তু প্রথম দিন সর্বাপেক্ষা উত্তম, তারপর দ্বিতীয় দিন, তারপর তৃতীয় দিন।
৩. নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতেই জবাই করা মুস্তাহাব। যদি নিজে জবাই করতে না পারে, তবে অন্যের দ্বারা জবাই করবে, কিন্তু নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। কোরবানিদাতা মেয়েলোক পর্দার ব্যাঘাত হয় বলে যদি সামনে উপস্থিত না থাকতে পারে, তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই।
৪. কোরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা জরুরি নয়। যদি মনে মনে চিন্তা করে নিয়ত করে এবং মুখে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করে তবুও কোরবানি জায়েজ হয়ে যাবে।
৫. কোরবানি শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়। এমনকি নাবালেগ সন্তান যদি ধনী হয়, তবুও তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। যদি কেউ সন্তানের পক্ষ থেকে কোরবানি করতে চায় তবে তা নফল কোরবানি হবে। কিন্তু নাবালেগের মাল থেকে কিছুতেই কোরবানি করবে না।
৬. ছাগল, পাঁঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাঁড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় প্রকার গৃহপালিত পশু কোরবানি করা জায়েজ আছে। এ ছাড়া হরিণ ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তুর দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না।
৭. গরু, মহিষ ও উট এই তিন প্রকার পশুর এক একটিতে এক থেকে সাতজন পর্যন্ত শরিক হয়ে কোরবানি করতে পারবে। তবে কোরবানি জায়েজ হওয়ার জন্য শর্ত এই যে, কারো অংশ যেন সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম না হয় এবং কারো যেন গোশত খাওয়ার নিয়ত না হয়। সবার যেন কোরবানির নিয়ত থাকে। অবশ্য যদি কারো আকিকার নিয়ত হয়, তবে তাও জায়েজ আছে। কিন্তু যদি শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত হয়, কোরবানি বা আকিকার নিয়ত না হয়, তবে কারো কোরবানি জায়েজ হবে না। এভাবে যদি শুধু একজনের অংশ সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম হয়, তবে সবার কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে।
৮. যদি গরু খরিদ করার সময় অন্যকে শরিক করার ইচ্ছা না থাকে, একা একাই কোরবানি করার নিয়ত থাকে, পরে অন্যকে শরিক করতে চায় এমতাবস্থায় যদি ওই ক্রেতা গরিব হয় অর্থাৎ তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব না হয়, তবে পরে সে অন্য কাউকেও শরিক করতে পারবে না, একা একাই পশুটি কোরবানি করতে হবে। আর যদি ওই ক্রেতা ধনী হয় অর্থাৎ তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়, তবে ইচ্ছা করলে পরে অন্য শরিকও মিলাইতে পারবে। (তবে নেক কাজে যতটুকু পারা যায় জায়েজ থাকলেও নিয়ত পরিবর্তন না করাই ভালো।)
৯. যদি কোরবানির পশু হারিয়ে যায় ও তৎপরিবর্তে অন্য একটি খরিদ করে, এরপর প্রথম পশুটিও পাওয়া যায়, এমতাবস্থায় যদি ক্রেতার ওপর কোরবানি ওয়াজিব থাকে, তবে একটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। যদি ক্রেতার ওপর কোরবানি ওয়াজিব না থাকে, তবে উভয় পশু কোরবানি করা তার জন্য ওয়াজিব।
১০. ছাগল পূর্ণ এক বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। এক বছর পুরা হলে জায়েজ হবে। গরু, মহিষ দুই বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। উট পাঁচ বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। দুম্বা এবং ভেড়ার হুকুম ছাগলের মতো; কিন্তু ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি এরূপ মোটা তাজা হয় যে, এক বছরের দুম্বার মধ্যে ছেড়ে দিলে চেনা যায় না, তবে সেরূপ দুম্বার বাচ্চা কোরবানি জায়েজ আছে। কিন্তু ছাগলের বাচ্চা যদি এরূপ মোটাতাজাও হয় তবুও এক বছর পূর্ণ না হলে কোরবানি জায়েজ হবে না।
১১. যে পশুর দু’টি চোখ অন্ধ, অথবা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের তিন ভাগের এক ভাগ বা আরো বেশি দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, সে জন্তুর কোরবানি জায়েজ নয়। অনুরূপভাবে যে পশুর একটি কানের বা লেজের এক-তৃতীয়াংশ বা তদপেক্ষা বেশি কেটে গিয়েছে সে পশু দ্বারা কোরবানি জায়েয নয়।
১২. যে পশু এমন খোঁড়া যে, মাত্র তিন পায়ের ওপর ভর দিয়ে চলে, চতুর্থ পা মাটিতে লাগেই না, অথবা মাটিতে লাগে বটে, কিন্তু তার ওপর ভর দিতে পারে না, এরূপ পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয়। আর যদি খোঁড়া পায়ের ওপর ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে চলে, তবে সে পশুর কোরবানি জায়েজ আছে।
১৩. যে পশুর একটি দাঁতও নেই, সে পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ নেই। আর যতগুলো দাঁত পড়ে গেছে তা অপেক্ষা যদি অধিকসংখ্যক দাঁত বাকি থাকে, তবে কোরবানি জায়েজ আছে।
১৪. যে পশুর কান জন্ম থেকে নেই, তার কোরবানি জায়েজ নেই। কান হয়েছে কিন্তু অতি ছোট; তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ আছে।
১৫. যে পশুর শিং ওঠেইনি বা শিং উঠেছিল, কিন্তু কিছু ভেঙে গেছে তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ আছে। অবশ্য যদি একেবারে মূল থেকে ভেঙে যায়, তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ নেই।
১৬. যে পশুকে খাসি বানানো হয়েছে তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ আছে। এভাবে যে পশুর গায়ে বা কাঁধে দাদ বা খুজলি হয়েছে তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ আছে। অবশ্য খুজলির কারণে যদি পশু একেবারে কৃশ বা দুর্বল হয়ে যায় তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ নেই।
১৭. ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি এমন কোনো দোষ এসে পড়ে যে কারণে কোরবানি জায়েজ হয় না, এমতাবস্থায় ক্রেতার অবস্থা যদি এমন হয় যে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব, তাহলে ওই পশুটি রেখে অন্য একটি পশু কিনে কোরবানি করতে হবে। অবশ্য যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, নিজেই আগ্রহ করে কোরবানি করার জন্য কিনেছে, সে ওই পশুটিই কোরবানি করে দেবে। অন্য আরেকটি কেনার দরকার নেই।
১৮. কোরবানির পশু জবাইকারী ও গোশত প্রস্তুতকারীর পারিশ্রমিক পৃথকভাবে দেবে, কোরবানির গোশত, চামড়া, মাথা বা পায়া দ্বারা দেবে না। তবে উক্ত কোরবানির গোশত তাদেরকে কোনো বদলা ছাড়া দান করা বা দাওয়াত করে খাওয়াতে পারবে।
১৯. কোরবানির পশুর গায়ে যদি দড়ি বা কোনো পোশাক থাকে তাহলে তা গরিবদেরকে দিয়ে দেবে, নিজে ব্যবহার করবে না।
২০. গর্ভবতী পশু কোরবানি করা জায়েজ আছে। যদি পেটের বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায়, তবে সে বাচ্চাও জবাই করে দেবে।
২১. কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়স্বজনের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-দুঃখীদের দান করে দিতে হবে। (এ ব্যাপারে বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত এতিম অসহায় গরিব শিক্ষার্থীদের খেয়াল করা উচিত। কারণ তারা এর মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে বিশেষভাবে উপকৃত হয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত এবং দীন-দুঃখীদেরও দেয়া যেতে পারে।)
শেষকথাঃ কোরবানির মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম পরিবারের আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হবে একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহর হুকুমের বাইরে অন্য কোন মত ও পথের কাছে তাদের মাথা নত করা যাবে না। এর পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব হবে আত্মত্যাগে উজ্জীবিত হওয়া, মানবিক কল্যাণ সাধন করা, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সৌভ্রাতৃত্বের বাঁধনকে আরো সুদৃঢ় করা। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন তাঁর সন্তানদের। সুতরাং আমরা যেন নিছক লৌকিকতা, আত্মম্ভরিতা, বাহাদুরি ও প্রতিযোগিতামূলক রক্তক্ষরণ ও গোশত ভক্ষণ করে মহান ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও শিক্ষাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করি। ইবরাহিমি ঈমান ও ইসমাইলি আত্মত্যাগের উত্থান যদি আবার জাগ্রত হয়, তবে আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় তমসা ভেদ করে পুনরায় মানবতার বিজয়নিশান উড্ডীন হবে। সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। তাই কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেয়ার আগে নিজেদের মধ্যে লুক্কায়িত পশুত্বের গলায় ছুরি দিতে হবে। মহান আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ও আত্মত্যাগী হতে হবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন বা মুত্তাকি হতে হবে। আমাদের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ সবকিছু আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ হোক, ঈদুল আজহায় মহান রবের নিকট এই থাকুক প্রার্থনা।
পিবিএ/এমআর