পিবিএ ডেস্কঃ বাংলাদেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে স্ট্রোক হলে তা আপনাকে মৃত্যুর কোলে ঢলানোর আগেই তাকেই কাবু করে ফেলা যায়। কিন্তু তার জন্য দরকার আগে তাকে চেনা৷ কীভাবে জানবেন আর কীভাবেই বা তার মোকাবিলা করবেন জেনে নিন।
মূলত দুই ধরণের স্ট্রোকে আক্রান্ত হন রোগিরা। ব্রেন ও হার্ট স্ট্রোক। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের রক্তনালীতে বাধা হল মূল কারণ৷ রক্ত চলাচলের নালীগুলি বন্ধ হয়ে যায়৷ সঠিক পরিমাণ রক্ত হৃদপিণ্ডে না পৌঁছনোর কারণে দিনের পর দিন হৃদযন্ত্র খারাপ হতে থাকে৷ ব্রেন অ্যাটাকের মূল কারণও একই৷ মাথায় থাকা সূক্ষ্ম রক্তনালী গুলি দিয়ে রক্ত চলাচল সঠিক পদ্ধতিতে না হলেই ব্রেনের কিছু অংশে রক্ত পৌঁছতে পারেনা৷ ফলে সেই জায়গাটি অকেজো হতে শুরু করে৷ এরপরই ব্রেন তার কাজ করা বন্ধ করতে আরম্ভ করে৷ এক্ষেত্রে ভয়ের কারণ হল ব্রেনটি একবার নষ্ট হতে শুরু করে তার কর্মক্ষমতা আর কখনও ঠিক করা সম্ভব হয়না। এরপরই দেখা দিতে থাকে শরীরের নান রকম সমস্যা।
মারাত্মক হার্ট অ্যাটাকের ফলে মৃত্যু অবধারিত। তবে যদি সেই রোগী বেঁচেও যান এমন খুব কমই দেখা গিয়েছে যে তিনি একেবারে সুস্থ জীবন যাপন করতে পেরেছেন৷ আবার ব্রেন অ্যাটাকের ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয়ত হয়না কিন্তু তাঁর শরীরের কোনও একদিক সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান৷ পারালিসিস হয়ে যায় তাঁর শরীরের বামদিক অথবা ডানদিক৷ কখনও আবার মুখ বিক্রিত হয়ে গিয়ে তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন৷ এবং এভাবে বেঁচে থাকা তাঁর সারাজীবনের চোখে জল এনে বাঁচার সামিল হয়ে ওঠে৷ অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে গিয়ে সেই রোগী মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন৷
বাঁচার উপায় কী? কী কী ভাবে বোঝা যাবেঃ স্ট্রোক বর্তমানে খুবই পরিচিত একটা রোগ। বেশিরভাগ রোগীই স্ট্রোকের কবলে পড়েন৷ ৮০ শতাংশ মানুষ ইস্কেমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন৷ ব্রেনের ধমনীগুলি আটকে ছোট হয়ে যেতে থাকে ও তাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷
হেমোরেজিক স্ট্রোকঃ যখন ব্রেনের দুর্বল রক্তনালীগুলি ছিঁড়ে যায় এবং ব্রেনে রক্তপাত হয় তখন ব্রেনের টিস্যুগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে৷ এর ফলেই হয় হেমারেজিক স্ট্রোক৷ হেমারেজিক স্ট্রোক ইস্কেমিক স্ট্রোকের থেকে অনেক গুন বেশি ক্ষতিকারক হয়৷ মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতে থাকে৷ এটিরও মাত্রা কম বেশি হয়৷ যদি মাত্রা বেশি হয় সেক্ষেত্রে রোগী কোমায় চলে যেতে পারেন৷ অনেক সময় দেখা গিয়েছে রোগী হঠাৎই কোলাপ্স করে গিয়ে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে৷
তবে এই সব স্ট্রোকের আগেই একটা ওয়ার্নিং স্ট্রোক হয়৷ যাকে বলা হয় ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক(TIA)৷ কখনও কখনও একে ”মিনি স্ট্রোক”ও বলা হয়৷ এই স্ট্রোক আপেক্ষিক রক্ত জমে যাওয়া থেকে হয়৷ এটি হওয়ার সময় রোগী তার মুখে হাতে ও কথা বলতে হঠাৎই অক্ষম হয়ে পড়েন৷ দুর্বলতা দেখতে পাওয়া যায়৷ প্রায় দুই থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত থাকে এই অবস্থা৷ এরপর আবার জমাট রক্ত সরে গেলে সেই রোগী আবার সুস্থ মানুষের মতই হয়ে যান৷
তবে বেশিরভাগ রোগীই বোঝেন যে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে তবুও তাঁদের মধ্যে খুব কম রোগীই এই কারণে চিকিৎসকের কাছে যান চিকিৎসা করাতে৷ ওই দুই থেকে পাঁচ মিনিট প্রবল কষ্টের সম্মুখীন হয়েও তারপর ঠিক হয়ে গেলে তাঁরা মনে করেন সব কিছুই আবার আগের মতই হয়ে গিয়েছে৷ তিনি এখন সুস্থ এমনই মনে করতে থাকেন তাঁরা৷ তাঁরা বোঝেন না ওই ছোট্ট স্ট্রোকটিই এরপরের এগিয়ে আসা বড় স্ট্রোকের অশনি সংকেত ছিল৷ তবে ওই সময়েই যদি সঠিক চিকিৎসা নেওয়া শুরু করা যায় তাহলে সারা জীবনের জন্য সেই প্রাণঘাতী স্ট্রোকটিকে জীবন থেকে দূর করা সম্ভব৷
নীচে স্ট্রোক চিহ্নিতকরণের কিছু সংকেত দেওয়া হলঃ
মুখ বিকৃতিঃ যখন মুখের একটা দিক বেঁকে যাবে কিমবা তার পেশি গুলি নড়াচড়া করানো সম্ভব হবেনা৷ কখনও বা সেই ব্যক্তি হাসলে বা কথা বলতে গেলেও এই রকম বিকৃতি লক্ষ্য করা যেতে পারে৷
হাতে জোর না পাওয়াঃ মুখ বিকৃতির পাশাপাশি আরও একটি সংকেত হল হাতে সমান জোর না পাওয়া৷ যখন কোনও ব্যক্তি দু হাত তুলে হাত সোজা করতে গিয়ে দেখছেন তাঁর এক হাত সোজা থাকলেও অপর হাতটিতে তেমন জোর নেই বা সেটি পড়ে যাচ্ছে সেই হাতে বল নেই সেটিও স্ট্রোকের অশনি সংকেত হতে পারে৷
কথা বলতে অসুবিধাঃ যখন কোনও ব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে অসুবিধা হবে৷ শব্দ উচ্চারণ স্পষ্ট হবে না৷ এবং পাশের যে ব্যক্তির সঙ্গে তিনি কথা বলছেন তিনি তাঁর কথা বুঝতে পারবেন না৷ কথা জড়িয়ে যাবে৷
উপায়ঃ টিক এই রকম সময়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হবে৷ এই সময় দ্রুততাই আসল চিকিৎসা৷ সেই সময় জরুরীকালিন তৎপরতায় তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে৷ স্ট্রোক এক্সপার্টের সহায়তায় তাঁকে চিকিৎসা শুরু করাতে হবে৷
এছাড়াও হঠাৎ অসম্ভব মাথার যন্ত্রণা শুরু হওয়া, হঠাৎ দুর্বলতা, মুখের প্যারালিসিস, হাত ও হাতের তালুতে জোর চলে যাওয়া, পায়ে জোর না পাওয়া ও শরীরের এক পাশে পক্ষাঘাত৷ আচমকা চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাওয়া বিশেষ করে যখন কোনও একটা চোখে এই সমস্যা দেখা দেয়, আবার শরীরের ব্যালেন্স চলে যাওয়া হাঁটতে গিয়ে সমস্যা, মাথা ঘোরা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া, আকস্মিক জ্ঞান হারানো এসবই স্ট্রোক হওয়ার পূর্ব লক্ষণ৷
স্ট্রোকের চিহ্নিতকরণের পরই সেই রোগীকে দ্রুত স্ট্রোক সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি রোগীকে হাসপাতালে পোঁছনো যাবে এবং তাঁর শরীরের রক্ত সঞ্চালন যত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করা যাবে তত জীবনের ঝুঁকি কমবে৷ তাঁর ব্রেনকে অক্ষম হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব৷ এক মিনিটে ব্রেনের ১.৯ মিলিয়ন নিউরনসের(ব্রেন সেলস) মৃত্যু হয়৷
দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে রোগীর ব্রেনের চিকিৎসা শুরু হয়৷ তাঁর ব্রেনের এনজিওগ্রাফি করা হয়ে থাকে৷ বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁর স্ট্রোকের চরিত্র নির্ধারণ করা হয়৷ বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে রোগীকে সুস্থ করে তোলা হয়৷ সুতরাং সঠিক সময়ে রোগ নির্ধারণ ও তার চিকিৎসা সঠিক সময়ে শুরু করা প্রয়োজন৷ নাহলে আপনার বা আপনার প্রিয় জনের জীবন চলে যেতে পারে শুধুমাত্র অবহেলার কারণে।
পিবিএ/এমআর