পিবিএ: সেদিন মনটা একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। বড়দিনের কিছুদিন পরের ঘটনা। জানুয়ারি মাস। একটা গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন রানু মণ্ডল। সেখানে গান করে প্রথম হন। শেষ পর্যন্ত রানু মণ্ডলের নাম ঘোষণা করা হলো না। প্রথম হয়েও পুরস্কার পাওয়া হলো না!
ভারতের এক টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের এই খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলেন রানু মণ্ডল। ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমার মা–বাবা থাকলে হয়তো প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু সেদিন আমার জন্য বলার মতো কেউ ছিল না। সারা দিন কেঁদেছিলাম।’ পুরো নাম রানু মারিয়া মণ্ডল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা রানু মণ্ডল। ১৯৬৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর জেলার কার্তিকপাড়া গ্রামে তার জন্ম। বাবা আদিত্য কুমার। তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। একেবারেই শৈশবেই মা–বাবাকে হারান রানু মণ্ডল। বড় হয়েছেন অন্যের বাড়িতে। স্কুলে যাওয়া হয়নি। সুরেলা কণ্ঠ, পরিষ্কার উচ্চারণ, সরলতা ছিল সম্পদ। বাংলায় কথা বলেন স্পষ্ট উচ্চারণে, টুকটাক ইংরেজিও বলতে পারেন। ভিডিও সাক্ষাৎকারে ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করে রানু মণ্ডল বলেন, ‘এক শীতে পাড়ার ছোটরা পিকনিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে পিকনিকে নেওয়ার মতো কেউ নেই।
মন খারাপ করে পিকনিকের বাসের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শুনলাম মাইকে বাজানো হচ্ছে গানটা, “এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়। পিকনিকে না যেতে পারলেও বাস থেকে বাজানো গানটা মনে ধরে যায়। সেই থেকে গান শুনলে আমি সব ভুলে যাই।’ মা–বাবাহারা রানুর মন খুব খারাপ থাকত সব সময়। মনের দুঃখ বলার, শোনার মতো কেউ নেই। তাই ক্যাথলিক চার্চে গিয়ে একা একা কাঁদতেন। সবার মা–বাবা আছে, তার নেই—এসবই বলতেন প্রার্থনায়। সেই শৈশব থেকেই দুঃখকষ্ট তার সঙ্গী হয়ে যায়। সে দুঃখ থেকে দূরে থাকার জন্যই গান গাইতেন। রাস্তায়, মানুষের বাসায় রেডিওতে গান শুনে শুনে গান মুখস্থ করতেন। অন্যের রেডিও ছিল তার গানের গুরু। বিয়ে হয় মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সেও অনেক বড় কাহিনি। রাজি ছিলেন না। অনেকটা জোর করেই বাবুর্চি স্বামী বিয়ে করেন। এ নিয়ে থানায় অভিযোগ করেন। কিছু না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত সংসার শুরু করেন। তবে কপাল ফিরল না। স্বামীর আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। বেকার। রানু সংসার চালাতেন। মানুষের বাসায় কাজ করেই চলত সংসার। একসময় ছোট্ট ব্যবসা শুরু করেন।
ফেরি করে বিস্কুট বিক্রি করতেন। এর মধ্যে আবারও কপাল পুড়ল। স্বামী মারা গেল রানুর। বিধবা নিঃসঙ্গ রানু মণ্ডল খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে বিস্কুট বিক্রি করতেন, গান শোনাতেন। ভালো গাইয়ে হিসেবে রানু পরিচিতি পান। সবাই বলতেন, ‘লতাকণ্ঠি রানু পাগলি’। গান গেয়ে, মানুষের টুকটাক কাজ করে এক হাজার টাকার মতো জমালেন। একদিন সেই টাকা চুরি হয়ে যায়। সেদিন থেকে কষ্ট আরও বাড়ে। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেলে খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন; যদি কেউ দয়া করে খাওয়ায়। এভাবে চলে যাচ্ছিল জীবন। রানাঘাট রেলস্টেশনে বেশির ভাগ দিন কাটে। রোদে পোড়েন, বৃষ্টিতে ভেজেন। অভাব–অনটনে মানসিক ভারসাম্যও হারান কিছুটা। অনেক কিছুই মনে করতে পারতেন না। তবে গানগুলো ঠিকই মুখস্থ তার।
অনায়াসে গেয়ে ফেলেন ‘পান্না কি তামান্না হ্যায় কে হিরা মুঝে মিল যায়ে’ ও ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়’, ‘লাগ যা গালে’র মতো জনপ্রিয় গান। একদিন সেখানে অতীন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক যুবক রানু মণ্ডলের গান শুনে এত মুগ্ধ হলেন যে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে গানের ভিডিও করলেন। ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড করেন। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে পড়ে। বিশ্বের কাছে পৌঁছে যায় লতাকণ্ঠি রানু মণ্ডলের গান। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া।
সবকিছু যেন গল্পের মতো, সিনেমার গল্প, যা কোনো দিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি রানু। রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি পৌঁছে যান বিমানবন্দরে। চড়লেন উড়োজাহাজে। গেলেন মুম্বাই। গাইলেন নতুন গান। এর আগে রানু মণ্ডলকে পারলারে নেওয়া হয়। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল—সবকিছু ঝকঝকে। রানু এমন দিন আগে কখনো দেখেননি। রানু পেলেন লটারি! রানু স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁর গান এভাবে সবাইকে মুগ্ধ করবে, এভাবে লটারি পাওয়ার মতো ভাগ্য বদলে যাবে। তবে তার ভাগ্যে হয়তো লেখা ছিল এমনটাই।
রানাঘাটের স্টেশনের ভবঘুরে জীবন থেকে মুম্বাইয়ের রেকর্ডিং স্টুডিও—রানুর কাছে এ যেন এক স্বপ্ন–উড়ান। এখন রানু মণ্ডলকে নিয়ে হইচই–উল্লাস চলছে। প্রতিদিন। জানা গেছে, কলকাতার একটি এলাকার দুর্গাপূজা কমিটি থিম সং করিয়েছে রানুকে দিয়ে। গত সপ্তাহে বলিউডে প্লেব্যাক করেন রানু মণ্ডল। ‘হ্যাপি হার্ডি অ্যান্ড হির’ ছবির হিমেশ রেশমিয়ার সুরে একটি গান ‘তেরি মেরি’ রেকর্ড করেন তিনি। সেদিন রাতে রানুর গাওয়া সেই গান নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে হিমেশ রেশমিয়া শেয়ার করেন। ‘হ্যাপি হার্ডি অ্যান্ড হির’ ছবিটি মুক্তি পাবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই। ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন সালমান খান এবং প্রযোজক হিমেশ নিজেও।
ছবির সংগীত পরিচালক হিমেশ। ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিমেশ রেশমিয়া রানুর গাওয়া প্রথম গানের জন্য তাকে ছয় থেকে সাত লাখ রুপি দিয়েছেন। আবার আরেকটি সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি পেয়েছেন তিন থেকে চার লাখ রুপি। কিন্তু এই অঙ্ক যা-ই হোক, রানু মণ্ডল প্রথমে তা নিতে রাজি হননি। হিমেশ রেশমিয়া প্রায় জোর করেই এই অর্থ রানু মণ্ডলের হাতে ধরিয়ে দেন। আরকটি সূত্রে জানা গেছে, অক্ষয় কুমারের পরবর্তী একটি ছবির জন্য গান গাইবেন রানু মণ্ডল। রানু মণ্ডল যেন জঙ্গলে ফোটা হাসনাহেনা ফুল। হাসনাহেনা যদি কখনো জঙ্গলে ফোটে, তাহলেও দূরে হেঁটে যাওয়া পথিকের কাছে তার সুঘ্রাণ পৌঁছে যায়। স্বামী, সন্তান, ঘর—সব হারিয়ে গেলেও তাঁর জীবনে রয়ে গেছে গান আর মধুর কণ্ঠ, যার ওপর ভর করে তিনি আজ তারকা তকমা পেয়েছেন। তাঁর এই পরিচয় কত দিন থাকে, সেটা বলে দেবে সময়।
পিবিএ/এমআই