পর্নোগ্রাফি যে শারীরিক ক্ষতিগুলো করে

পিবিএ ডেস্কঃ যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৫৫ সালে পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীলতাকে ‘সভ্যতার কালো দাগ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। রয়েল সোসাইটিতে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘একদিন অশ্লীলতা চর্চার মাশুল গুনতে হবে মানবজাতিকে।’ আর বিশ্বব্যাপী যৌনসন্ত্রাস বৃদ্ধির ঘটনাকে বিভিন্ন সময়ে পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীলতা চর্চার ফল হিসেবে দেখিয়েছেন গবেষকরা।

জার্মান গবেষকদের বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা ডেইলি মেইল জানায়, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ সংকুচিত হয়ে যায়। একই সঙ্গে কমে যায় এর কার্যক্ষমতা।
গবেষকরা জানান, মানুষ যখন পর্নোগ্রাফি দেখে তখন মস্তিষ্কের অন্যতম পরিবাহক (নিউরোট্রান্সমিটার) ডোপামিনে একটি ঢেউ তোলে। এই পরিবাহকটির অন্যতম কাজ আনন্দ এবং সুখের অনুভূতিগুলো বহন করে তার স্মৃতি নিউরনে পাঠিয়ে দেওয়া। একটা সময় মানুষ পর্নোগ্রাফি দেখা ছাড়তে চাইলেও মস্তিষ্ক অভ্যস্ততা থেকে একই রকম ঢেউ চায়, অর্থাৎ পর্নোগ্রাফি দেখতে আসক্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি মানুষ বাস্তব জীবনে যৌনক্রিয়া থেকে আগ্রহও হারিয়ে ফেলে।

সাইকোলজি টুডেতে ২০১১ সালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দর্শকদের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ ‘স্টেরিয়াটামের’ আকৃতি ও কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। মস্তিষ্কের এই অংশটি উদ্দীপনা গ্রহণ ও সুখানুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
গবেষকরা জানান, এই গবেষণাটি প্রথম দেখিয়েছে নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে পারে।

ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ১৩ বছর থেকে কিশোররা পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্ত হয়ে নিয়মিত দেখে থাকে, আর প্রাপ্তবয়স্করা ‘দোষী বিনোদন’ হিসেবে পর্নোগ্রাফি দেখে। পুরুষ ও নারীদের কাছে পর্নোগ্রাফি তাদের যৌনতার কল্পরাজ্যে ভ্রমণ করার শামিল। অনেকেই বলেন, যৌনতার এই কল্পরাজ্যে ভ্রমণে তাদের বাস্তবের যৌনজীবনে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর ফলে স্বাস্থ্যগত এবং মানসিক কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে।

পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে মস্তিষ্ক যখন নিয়মিত মানসিক পরিস্থিতি উন্নয়নের হরমোন নিঃসরণ করতে থাকে, মস্তিষ্ক তখন এই নিষিদ্ধ নেশায় অভ্যস্ত হয়ে যায়।
তরুণ বয়স থেকে পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির তথা নিয়মিত ডোপামিনের নিঃসরণের ফলে মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে তৈরি হয়ে যায়। অর্থাৎ ফলে ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে আসা অনেক সময় ওই ব্যক্তির জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

জামা সাইকিয়ার্টি ম্যাগাজিনে বলা হয়, মানুষের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস শিখতে চায়। আর কীভাবে নতুন জিনিস শিখবে তা মূলত নির্ভর করে মস্তিষ্কের সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটির ওপর।
এটি মানুষের মস্তিষ্কের এমন একটি বিশেষ ক্ষমতা যা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আগে ঘটে যাওয়া স্মৃতি, ঘটনা অথবা জানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিউরনের যোগাযোগ রাখে এবং কত দ্রুত মস্তিষ্ক ঘটনাটিতে সাড়া দেবে তা নির্ধারণ করে।

এই ডোপামিনকে উদ্দীপ্ত করতেই বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে মানুষ। নতুন আবিষ্কৃত বিভিন্ন মাদকও তৈরি করা হয় এই ডোপামিনকে লক্ষ করে। যাতে মাদক সেবনে মস্তিষ্ক প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নিঃসরণ করে এবং নিঃসরিত এই ডোপামিনের ফলে সুখানুভুতি জাগে মানুষের মনে।
এর ফলেই নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের ফলে সুখের অনুভূতি জাগে মনে। তবে ডোপামিন নিঃসরণের ফলে মনে আনন্দের এই অনুভূতি সাময়িক। মাদকদ্রব্যের উপাদান ও পরিমাণের ওপর নির্ভর করে এটি কতখানি ডোপামিন নিঃসরণ করবে আর অনূভূতি কতক্ষণ স্থায়ী হবে।

আর ওই সুখের অনুভূতি কেটে যাওয়ার পর রাজ্যের বিষন্নতা, হতাশা আর অবসাদ এসে ভর করে শরীর ও মনে। ফলে মস্তিষ্কের গঠন অনুযায়ী স্নায়ুতন্ত্র ডোপামিনের জন্য দেহকে বারবার নির্দেশ পাঠায়। এ সময় মাদকদ্রব্য গ্রহণকারীর মনে প্রচণ্ড অস্থিরতা তৈরি হয় এবং এর প্রভাব গিয়ে পড়ে শরীরে, যার ফলে পুরো শরীরে আশ্চর্য অবসাদ দেখা দেয়। অনেক সময় শরীর জ্বালাপোড়া ও অস্থিরও লাগতে পারে। শেষে মাদক গ্রহণকারী শরীরের চাহিদায় অনন্যোপায় হয়ে মাদকের শরণাপন্ন হয়। এভাবেই তৈরি হয় আসক্তি, যা কোনোদিন কমে না বরং বাড়তেই থাকে।

একই ধরনের অনুভূতি হয় পর্নোগ্রাফিরর ক্ষেত্রেও। পর্নো ভিডিও, ছবি, লেখা, অডিও ইত্যাদিও মানবদেহে সুখানুভূতি জাগায়। আর এক্ষেত্রে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে ডোপামিনের ভূমিকা।
বিভিন্ন নেশার মতোই পর্ন মানুষের মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিঃসরণে সাহায্য করে। ফলে মাদকের মতোই পর্ন দেখার ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণের একটি যোগসূত্র তৈরি হয়। ফলে কিছুদিন পর্ন না দেখলে স্নায়ুতন্ত্র ডোপামিনের জন্য দেহকে বারবার নির্দেশ পাঠায়।

এই গেল মস্তিষ্কের সাথে পর্নোগ্রাফির যোগসূত্রের কথা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফির প্রভাব মাদকের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ মাদকসেবীদের কাছ থেকে মাদক সরিয়ে নিলে বা যোগান না থাকলে এর প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। তীব্র শারীরিক ও মানসিক যাতনাবোধের পর এক সময় মাদক গ্রহণ না করে থাকতে পারে মানুষ। কিন্তু পর্নের ক্ষেত্রে এটি মনে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যায়। ফলে পরবর্তীতে বাস্তব জীবনে যখন মানুষ যৌনকর্মে লিপ্ত হয় তখন পর্নোগ্রাফি দেখা, পড়া বা শোনা চিত্র তার অবচেতন মনে আসতে থাকে। মানুষটি তখন বাস্তবের মানুষ নয় বরং পর্নোগ্রাফি দেখা কাউকে চিন্তা করে যৌনক্রীড়ায় সাড়া দেয়।

বারবার পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে নতুন নতুন দেহ আর কৌশল দেখতে দেখতে মস্তিষ্ক সেভাবে ভাবতে শুরু করে। ফলে বাস্তব জীবনে সঙ্গীর উপর সে আকর্ষণ অনুভব করে না। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে দেখা ও পড়া বিকৃত ও অনৈতিক সম্পর্কগুলো যেভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে যায়, সেখান থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মস্তিষ্কের কাজের ধরন অনুযায়ী সেখানে সবচেয়ে বেশিবার যে স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা প্রবেশ করানো হবে মস্তিষ্ক সেই অনুযায়ী কাজ করবে। এর ফলে পর্নোগ্রাফিতে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের মন যৌনচিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে কল্পনা ও বাস্তবের ফারাকটা সেভাবে নির্ণয় করতে পারে না।

এ ছাড়া নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে মানবদেহে সাড়া না দেওয়ার (ইরেক্টাইল ডিসফাংশন) একটি প্রবণতা দেখা যায়। কারণ সে পর্নোগ্রাফিতে দেখা অতিরঞ্জিত দৃশ্যের সঙ্গে বাস্তবের তেমন মিল খুঁজে পায় না।
পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ব্যক্তি তার সঙ্গী/সঙ্গিনীর কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়। এবং বেশিরভাগ গবেষণা অনুযায়ী পর্নোগ্রাফিতে আসক্তরা ব্যক্তিজীবনে অসুখী হয় বলে জানিয়েছে ডেইলি মেইল।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...