পিবিএ ডেস্ক: মানবসভ্যতার ইতিহাসে হাজারো অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলো যুগে যুগে মানুষকে হতবাক করেছে, চমকে দিয়েছে অথবা করেছে ব্যথিত। বিংশ শতাব্দীতে এমন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে গর্ভবতী হয়েছিল লিনা মেডিনা। হাতে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। কেননা এমন একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা আপনাকে বিস্মিত না করে পারবে না।
লিনা মেডিনা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মা। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে গর্ভবতী হয়ে সে সুস্থ স্বাভাবিক একটি শিশুর জন্ম দিয়েছিল। লিনার জন্ম ১৯৩৩ সালে, পেরুর টিক্রাপো শহরে। লিনার বয়স যখন পাঁচ, বাবা-মা তার শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। দিনদিন লিনার পেট বড় হচ্ছিল। প্রতিবেশীদের ধারণা ছিল লিনার উপর অশুভ আত্মা ভর করেছে। লিনার বাবা-মা তাকে শামানদের (স্থানীয় ওঁঝা) কাছে নিয়ে যান। উপকার না পেয়ে তারা লিনাকে নিকটবর্তী পিসকো শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন।
হাসপাতালের গাইনোকলজিস্ট জেরার্ডো লোজাদা প্রথমে ভেবেছিলেন লিনার পেটে বোধহয় টিউমার হয়েছে। কিন্তু এক্স-রে করানোর পর সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়! নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু মেডিকেল টেস্ট করানো হয়। রিপোর্টে উঠে আসে অবিশ্বাস্য এক সত্য- লিনা সাত মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা!
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ব্যাপারটি একদমই অসম্ভব। কারণ সাধারণত একজন নারীর পিরিয়ড শুরু হয় ১১-১২ বছর বয়সে। পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে নারী সন্তান জন্মদানের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এরপর চিকিৎসক তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, লিনার মাত্র ৩ বছর বয়স থেকেই পিরিয়ড শুরু হয়েছিল! অর্থাৎ ৩ বছর বয়স থেকেই সে সন্তান জন্মদানের জন্য প্রস্তুত ছিল।
এরপর লিনাকে পেরুর রাজধানী লিমায় আরো বড় স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। সেখানে পুনরায় পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হলে লিনাকে নিয়ে বিশ্বে আলোড়ন তৈরি হয়। অধিকাংশ পত্রিকার প্রথম পাতায় ঘটা করে ছাপানো হয় এই সংবাদ। যথাসময়ে লিনা মেডিনা একটি ফুটফুটে ছেলেশিশুর জন্ম দেয়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার শিশুটি সুস্থ এবং বেশ স্বাস্থ্যবান ছিল। যদিও সন্তান পেটে আসার পর লিনার যথেষ্ট শারীরিক বিকাশ ঘটেছিল, তবুও চিকিৎসকেরা কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে সিজার করে সন্তান প্রসব করান। অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসকেরা লিনার দেহ সম্পর্কে অনেক তথ্য অনুসন্ধান করার সুযোগ পান। তারা দেখেন- একেবারে অল্প বয়সেই লিনার যৌনাঙ্গ পুরোপুরি বিকশিত হয়েছিল। চিকিৎসকেরা পরীক্ষার পর দেখেন ৩ বছর নয়, ৮ মাস বয়স থেকেই লিনার পিরিয়ড শুরু হয়েছিল। এমনকি তার স্তন মাত্র ৪ বছর বয়স থেকেই বড় হচ্ছিল। মূল ব্যাপার হলো লিনার শরীরে হাইপোফাইসিসের হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতার কারণেই এমন অপ্রাপ্ত বয়সে বয়ঃসন্ধি হয়েছিল। মজার বিষয়, ১০ বছর বয়স পর্যন্ত লিনার সন্তান লিনাকে বোন ভাবতো। এরপর তাকে জানানো হয় লিনা তার মা।
ডাক্তার লোজাদা পরীক্ষা করে যখন জানতে পারলেন লিনা গর্ভবতী তিনি পুলিশকে ফোন করে তার বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। প্রতিবেশী, পুলিশ এবং ডাক্তারের সন্দেহের তালিকায় প্রথমে তার বাবার নাম ছিল। কিন্তু যথাযথ প্রমাণ না থাকায় পুলিশ তার বাবাকে ছেড়ে দেয়। তার এক মানসিক প্রতিবন্ধী ভাইকেও সন্দেহবশত আটক করা হয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে ঘটনাটি ঘটল কীভাবে?
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, লিনার সন্তানের বাবার পরিচয় আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। লিনাও এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেনি। সাধারণত এই বয়সে শিশুদের বিশেষ কোনো ঘটনা মনে রাখার মতো প্রখর স্মৃতিশক্তি থাকে না। তবে ডাক্তার এবং পুলিশ মাত্র ৫ বছর বয়সেই গর্ভবতী হওয়ার পেছনে সম্ভাব্য কিছু কারণ বের করেছিলেন। লিনা প্রায়ই কাপড় ধুতে একা নদীতে যেতো। লিনার বাবা-মা’র ধারণা সেখানেই হয়তো কেউ তার সাথে সহবাস করেছে। অথবা ওই এলাকার লোকেরা নানারকম অদ্ভুত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। এমন কোনো অনুষ্ঠানে গিয়েই লিনা হয়তো কারুর মাধ্যমে জোরপূর্বক সহবাসে অংশ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, লিনা সিজারিয়ান ডাক্তার জেরার্ডো লোজাদার নামানুসারে ছেলের নাম রেখেছিল। মাত্র ৪০ বছর বয়সে অস্থিমজ্জায় সংক্রমণের কারণে ছেলেটি মারা যায়। ১৯৩৯ সালে বিখ্যাত পত্রিকা সান আন্তোনিয়া লিনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। তবে পেরুর মিডওয়াইফারি সংস্থা সাফ জানিয়ে দেয়- লিনা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দেশেই থাকবে। পরবর্তী সময়ে একটি আমেরিকান প্রযোজনা সংস্থা লিনাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করার জন্য তার বাবাকে পাঁচ হাজার ডলার দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবার এই বিষয়ে একদমই সম্মতি ছিল না। লিনারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা পছন্দ ছিল। কিছুদিন এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, লিনার পরিবার বিপদের মধ্যে আছে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা দরকার। এই কমিশন গঠনের পর লিনা এবং তার পরিবার সাংবাদিকদের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পায়।
সাবালিকা হওয়ার পর লিমায় সেই ক্লিনিকেই লিনাকে সেক্রেটারি পদে চাকরি দেয়া হয়। ক্লিনিক নিজস্ব খরচে লিনা এবং তার সন্তান জেরার্ডোকে পড়ালেখা করায়। পরবর্তী সময়ে লিনা রাউল জুরাডোকে বিয়ে করেন। ৩৮ বছর বয়সে হয় তার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ এই মা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।