ড. খুরশিদ আলম: দেশে কেমন মন্ত্রী দরকার, সে সম্পর্কে সবাই হয়তো বলবেন, সৎ, যোগ্য, দক্ষ, কর্মঠ, জনদরদি ব্যক্তির মন্ত্রী হওয়া দরকার। আবার কেউ কেউ বলবেন, তরুণ কিংবা মাঝবয়সী লোক মন্ত্রী হওয়া দরকার। কেউ কেউ মনে করেন, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি মন্ত্রী হওয়া দরকার। তারা তাদের দৃষ্টিতে আদর্শ মন্ত্রীর সন্ধান করেন। তাদের এ বক্তব্যের মধ্যে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের দর্শন দেখতে পাওয়া যায়। গণমানুষের এই রাষ্ট্রদর্শন আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক দার্শনিকদের রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মিলে যায়। নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যুগে যুগে প্রায় অভিন্ন থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গঠিত ২০টি মন্ত্রিসভায় আনুমানিক পাঁচশ’ ব্যক্তির অধিক মন্ত্রী হয়েছেন। তারা সবাই না হলেও অনেকের কথা মানুষ বিভিন্ন সময়ে স্মরণ করেন। তেমন একজন মন্ত্রী হয়েছিলেন ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব, যিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় কিছুদিনের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালীন একবার বলেছিলেন, দেশের কথা চিন্তা করে তার রাতে ঘুম হয় না। দেশের অবস্থা তখন এতই খারাপ ছিল যে, কোটি কোটি মানুষ দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে পারেনি। তাই সে দেশের পরিকল্পনামন্ত্রী হলে রাতে তার ঘুম না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে দেশের সে রকম অবস্থা নেই। তাই বলে কি বর্তমানে দেশে কোনো সমস্যা নেই?
বর্তমানে দেশে সে রকম খাদ্য সমস্যা না থাকলেও জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। তাই মন্ত্রীদের আগের মতো কোনো বিষয়ে উদাসীন থাকা সম্ভব নয়। যেমন, আমাদের দেশে এখন যতজন শিক্ষিত বেকার আছে, তত লোকসংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। এসব তরুণ-তরুণীর অনেকের খাবারের সমস্যা না থাকলেও একটি সুন্দর জীবন তাদের এখন বড় প্রত্যাশা। তা ছাড়া এদের অনেকের পরিবারের প্রত্যাশা, তারা শিক্ষা শেষ করে পরিবারের হাল ধরবে। অনেকের পিতা-মাতা এমনকি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাদের আর আগের মতো সংসার টেনে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। অনেকের বৃদ্ধ পিতা-মাতা অসুস্থ। তাদের সে পিতা-মাতাকে চিকিৎসাসহ এখন আর্থিক সহায়তা করা দরকার।
বর্তমানে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বেকার সমস্যার সমাধান করা, তা জানা যায় না। কারণ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাজে দেখা যায়, তারা শ্রমিক নিয়ে কাজ করেন। কর্মসংস্থান তাদের প্রধান কাজ নয়। তাদের সে ধরনের কোনো কর্মসূচি নেই। তা ছাড়া তা নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নিজ নিজ কৌশলে কাজ করে বিধায় কোনো একক মন্ত্রণালয় সেটিকে তাদের নিজের কাজ বলে বিবেচনা করে না। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সমন্বয়ও নেই, কোনো লক্ষ্যও নেই। এডিপি বা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এর কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা বা পরিকল্পনা নেই।
মন্ত্রীর কাজ হচ্ছে পরিকল্পনা করা, সে বিশেষ ক্ষেত্রে দেশের কী করা দরকার তা বলা। আমি এমন অভিযোগও শুনেছি, একজন অতিবয়স্ক ব্যক্তিকে মন্ত্রী করার পর তাকে কোনো কথা বললে এক ঘণ্টা পর তিনি তা মনে করতে পারতেন না। আমার মতো বহু লোক বহু কথা শুনেছে। ফলে এ ধরনের মন্ত্রীর পক্ষে দেশের জন্য কী করা দরকার, তা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন কিংবা বলা চলে প্রায় অসম্ভব। বর্তমান বিজয়ী দল নির্বাচনের আগে বলেছে, উইনেবল ক্যান্ডিডেট দরকার এবং সে জন্য সরকারি দলের ভূমিধস বিজয় হয়েছে। এ বিজয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে; সেই সঙ্গে সরকারি দলের দায়িত্বও। জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণ করার মতো কমিটেড মন্ত্রীর দরকার। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করার মতো সক্ষমতা আছে তেমন মন্ত্রী দরকার। এসডিজি বাস্তবায়ন করার মতো মন্ত্রী দরকার। জনগণের চাহিদা নিরূপণ করে, তা থেকে অগ্রাধিকার তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করতে পারেন, তেমন মন্ত্রী দরকার। নিজ এলাকা নয়, সারাদেশের জন্য কাজ করবেন তেমন মন্ত্রী দরকার। জনগণকে সমীহ করেন তেমন মন্ত্রী দরকার। শাসক নয়, সেবক মন্ত্রীর দরকার। উপদেশ নয়, উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন, তেমন মন্ত্রী দরকার।
মন্ত্রী কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হলে ভালো; না হলেও কিছু যায় আসে না। কারণ মন্ত্রীর কাজ কিন্তু ওই দপ্তরের রুটিন ওয়ার্ক নয়; রুটিন কাজের জন্য সচিবই যথেষ্ট। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী হতে হলে হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার নেই; রেলমন্ত্রী হতে হলে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার নেই; নৌপরিবহনমন্ত্রী হতে হলে জাহাজ চালানোর অভিজ্ঞ ব্যক্তি হওয়ার দরকার নেই কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে হলে চিকিৎসক হওয়ার দরকার নেই। কারণ সেসব কাজ সংশ্নিষ্ট বিভাগের কারিগরি বিশেষজ্ঞরাই করে থাকেন। মন্ত্রীর কাজ হলো দেশে কত রাস্তা করবে, কোন রাস্তার কোন দেশের সঙ্গে সংযোগ দেবে; পরিবহন ব্যবস্থা কি সরকারি খাতে রাখবে, না বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবে; স্থলপথ না জলপথ বেশি প্রাধান্য পাবে, রেললাইন করবে নাকি হাইওয়ে বেশি করবে, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহন থাকবে, না একই পরিবহনে চলবে, প্রতিবন্ধীদের রাস্তায় চলাচলের ব্যবস্থা করবে, নাকি তা যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে; ছাত্রদের কি
অর্ধেক ভাড়ায় বাস চড়তে দেওয়া হবে, নাকি হবে না; রাস্তা নির্মাণের টাকা কি
চীন থেকে নেবে, নাকি জাপান থেকে ইত্যাদি। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, বয়স ইত্যাদি মন্ত্রীর ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
একজন মন্ত্রীর তাই প্রথম কাজ হবে তার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে জনগণ যা প্রত্যাশা করে তা করার ম্যান্ডেট আছে কি-না, নীতিমালা বা পরিকল্পনার কোনো ঘাটতি আছে কি-না, সমন্বয়ের কোনো সমস্যা আছে কি-না, নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ওয়াদা বাস্তবায়ন করার মতো তার মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ও কৌশল আছে কি-না, তা পর্যালোচনা করা। প্রধানমন্ত্রীর এ বিষয়ে তার মন্ত্রীদের একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া দরকার, যাতে তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের ঘাটতি চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে কর্মসূচি বা করণীয় ঠিক করতে পারেন।
মন্ত্রীদের করণীয় :জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের ম্যান্ডেট ঠিক আছে কি-না তা যাচাই করা (পানি উন্নয়ন বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে পানি ব্যবস্থাপনা বোর্ড গত ২৮ বছরেও করা যায়নি, যা আমি ১৯৯১ সালে করার প্রস্তাব করেছিলাম। তবে ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে ক্রীড়া উন্নয়ন বোর্ড করা সম্ভব হয়েছে)। জনগণের চাহিদা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা, ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করতে ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করা, মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি চাহিদাভিত্তিক বাজেট তৈরি করা (তা না হলে সরকারের ২০ শতাংশ অপচয় বন্ধ হবে না), নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ওই মন্ত্রণালয়ের কী নীতিমালা এবং কৌশলগত পরিবর্তন আনা দরকার, তা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া; জনগণকে মন্ত্রণালয়ের কাজে সম্পৃক্ত করা; জনগণের অভিযোগ প্রদানের জন্য একটি অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা; মিট দ্য পিপল সিস্টেম চালু করা; মিতব্যয়ী হওয়া; সরকারের ব্যয় ছাড়া কী কী উন্নয়ন কাজ করা যায় (যেমন, সার্কুলার দিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়) তা ঠিক করা; পরিকল্পিত কাজের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করা; স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে (এসডিজিসহ) কী কী করা যায় তার পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করা। এভাবে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে কাজ করা। মন্ত্রণালয়ে অনেক কর্মদক্ষ, ন্যায়বান ও জনবান্ধব কর্মকর্তা থাকেন। তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে।
নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমা এক বিশেষজ্ঞ একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে উন্নত করা খুব সহজ; শুধু একটা কাজ করলেই হবে। সবাই অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করল :কীভাবে? তিনি বললেন :নোয়াখালীর লোকগুলোকে ভাগ করে ৬৪ জেলায় দিয়ে দাও। তারপর তারাই ওইসব জেলা উন্নত করে ফেলবে। সেভাবে যদি বৈজ্ঞানিক ফ্যান্টাসি করে বলা যায়, শেখ হাসিনার ক্লোন করে আরও ৪৪টি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী বানিয়ে বসিয়ে দাও; কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হয়ে যাবে। তার জন্য ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না।
সায়েন্টিফিক ফ্যান্টাসি না করে বাস্তবে আসতে হবে। শেখ হাসিনার কর্মাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যিনি তার মতো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন তেমন মন্ত্রী চাই। তাই দেশে দরকার অনেক ডিগ্রিধারী নয়; কর্মবীর মন্ত্রীর। দরকার ভিশনারি মন্ত্রীর। সে মন্ত্রী দরকার যিনি উপদেশ দেবেন না; উদাহরণ সৃষ্টি করবেন।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট