খালেদার মুক্তিতে জামিন ছাড়াও দুই পথ দেখছেন আইনজীবীরা

খালেদা জিয়ার অভিযোগ গঠন আবারো পিছিয়েছে
পিবিএ,ঢাকা: দুর্নীতির দুই মামলায় দন্ডিত হয়ে কারাগারে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রশ্নে নতুন করে আবার শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। খালেদার মুক্তির বিষয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনের পরই এ আলোচনা শুরু হয়। আপিল বিভাগে জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি কীভাবে- এমন প্রশ্নই সবখানে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, সরকার চাইলে জামিন ছাড়াও মুক্তি দিতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও খালেদার মুক্তিতে জামিন ছাড়া দুই পথ দেখছেন। একটি অসুস্থতার কারণে প্যারোলে মুক্তি, অন্যটি রাষ্ট্রপতির কাছে সাজা মওকুফের আবেদন।

এদিকে, প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে আরও আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন ছিল উল্লেখ করে নিজ দলের নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খালেদা জিয়ার অন্যতম এক আইনজীবী। ওই আইনজীবী বলেন, দুই বছর আগেই এ প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তখন আমাদের নেতারা শোনেননি। অন্যদিকে, চলতি সপ্তাহে আবারও হাই কোর্টে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে থাকা মোট ৩৬ মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে দুটিতে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত পাঁচ বছর কারাদন্ড দেওয়ার পর হাই কোর্টে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে ৭ বছর কারাদন্ড দিয়েছে নিম্ন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। এই দুই মামলায় উচ্চ আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তার আইনজীবীরা। বাকি ৩৪ মামলার মধ্যে গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলাসহ ১৩টি মামলা বিচারাধীন। আর হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে ২১ মামলা। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি সাজা ভোগ করছেন। বর্তমানে কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জামিন ছাড়া কোনো আসামির মুক্তি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় কারও অসুখ হলে প্যারোলের আবেদন করতে পারেন। তবে তার (খালেদা জিয়া) বিষয়ে আবেদন পাওয়ার পরই এ আলোচনা করা সম্ভব হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম খালেদার মুক্তিতে জামিন ছাড়াও দুই পথ দেখছেন, তিনি বলেন, তার (খালেদা জিয়া) মুক্তিতে এখন দুটি পথ খোলা আছে। একটি হচ্ছে, অসুস্থতার বিষয়টি তুলে ধরে সরকারের কাছে আবেদন করতে পারেন। যেটা প্যারোল হিসেবে পরিচিত। অন্যটি হচ্ছে- সাজা মওকুফ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। তিনি বলেন, প্রথমটায় দোষ স্বীকার না করেও আবেদন করা যাবে। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে হলে অবশ্যই দোষ স্বীকার করতে হবে। সাজাটাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।

নিজ দলীয় নেতাদের প্রতি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি দুই বছর আগেই প্যারোলের বিষয়ে মত দিয়েছিলাম। তখন আমাদের নেতারা শোনেননি। তিনি বলেন, যে দুটি মামলায় এখন তিনি জামিনের অপেক্ষায় আছেন, সেই দুটি মামলায় বহু আগেই জামিন হওয়া উচিত ছিল। অথচ আমরা আপিল বিভাগে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এখন ম্যাডাম যে অবস্থায় আছেন, যদি দ্রুত উন্নত চিকিৎসা করা না হয় তাহলে ম্যাডামের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

খালেদার অন্যতম এ আইনজীবী বলেন, আইনের মাধ্যমে তার জামিন পাওয়াটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমি মনে করি রাজনৈতিক চিন্তার ঊর্ধ্বে, ম্যাডামকে বাঁচানোর জন্য তার উন্নত চিকিৎসা করা দরকার। তিনি আরও বলেন, বলা হচ্ছে বিএসএমএমইউ দেশের একটি উন্নত মানের হাসপাতাল। এটা আমিও মানছি। কিন্তু তার পরেও তো যারা ক্ষমতাসীন দলে থাকেন, বা সচ্ছল, তারা কিন্তু সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা করান। সেই ক্ষেত্রে দীর্ঘ চিকিৎসায়ও যেহেতু ম্যাডামের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, তাই তাকে নিজ ইচ্ছায় দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়া জরুরি। খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, জামিন ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারায়, অর্থাৎ দন্ড স্থগিত করে সরকার চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্তি দিতে পারে। এটা শুধু সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপার। জামিনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আপিল বিভাগে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। আবারও হাই কোর্টে জামিন আবেদন করব। চলতি সপ্তাহের শেষেই এটা করা হতে পারে। যতদিন আসামি কারাগারে থাকে, ততদিনই জামিন আবেদন করা যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্যারোলে মুক্তি সংক্রান্ত নীতিমালায় যা আছে- কারাবন্দী ব্যক্তির প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে ২০১৬ সালের ১ জুন একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই নীতিমালায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে। নীতিমালার ১ (ক) ধারায় বলা হয়েছে- ভিআইপি বা অন্যান্য সকল শ্রেণির কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকট আত্মীয়ের যেমন বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি এবং আপন ভাই বোন মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। ১ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, ভিআইপি বা অন্যান্য সকল শ্রেণির কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। তবে উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করে দেবেন। ধারা ২ অনুযায়ী, বন্দীকে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরাধীনে রাখতে হবে। নীতিমালার ৩ ধারায় বলা হয়, মুক্তির সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার অধিক হবে না তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস বা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবেন। ৪ ধারায় বলা আছে, কোনো বন্দী জেলার কোনো কেন্দ্রীয়/জেলা/বিশেষ কারাগার/সাব জেলে আটক থাকলে ওই জেলার অভ্যন্তরে যে কোনো স্থানে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবেন। অপরদিকে কোনো বন্দী নিজ জেলায় অবস্থিত কেন্দ্রীয়/জেলা/বিশেষ কারাগার/সাব জেলে আটক না থেকে অন্য জেলায় অবস্থিত কোনো কেন্দ্রীয়/জেলা/ বিশেষ কারাগার/সাব জেলে আটক থাকলে গন্তব্যের দূরত্ব বিবেচনা করে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবেন। তবে উভয় ক্ষেত্রেই দুর্গম এলাকা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, দূরত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর কিংবা নামঞ্জুরের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবেন। নীতিমালার ৫ ধারায় বলা হয়, কারাগারের ফটক থেকে পুলিশ প্যারোলে মুক্ত বন্দীকে বুঝে নেওয়ার পর অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যেই আবার কারাগারে পাঠাবেন।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...