পিবিএ,ভাঙ্গা (ফরিদপুর): ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মাসের পর মাস কুমার নদী থেকে বালু উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পাড় সহ সড়কের বেশ কয়েক জায়গা ধ্বসে পড়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে কুমার নদীর উপর নির্মিত ভাঙ্গা ও ঘারুয়া সহ প্রায় ৬টি বড় ব্রীজ।
বিষয়টি এলাকাবাসি দীর্ঘদিন প্রশাসনের নজরে দিলেও প্রশাসনের নাকের ডগার উপর দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন করে আসছে চক্রটি। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙ্গা কলেজপাড়, বায়পাড়া, পীরেরচর বাজার, ঘারুয়া বাজায়, মুনসুরাবাদ বাজার সহ শতাধিক স্থানে ধ্বস নেমেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে নদী পাড়ের বাসিন্দারা এবং আবাদী জমি। জনগনের চাপের মুখে বালু উত্তোলনকারিরা কিছু কিছু জায়গায় বাঁশ দিয়ে ধ্বস ঠেকাতে চেষ্টা করছে। অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন করায় আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ভাঙ্গা কলেজপাড় ব্রীজ, ঘারুয়া ব্রীজ, ভাঙ্গা থানা ভবনের একাংশ সহ একাধিক স্থানে ভাঙ্গনের আশঙ্কা করছে নদীর উভয় পাড়ের বাসিন্দারা।
বিষয়টি নিয়ে গত ২ মাস আগে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন সকল ধরনের বালু উত্তোলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। প্রশাসন লোক দেখানো নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা মাত্র সপ্তাহ খানেক বহাল ছিল। পরবর্তীতে পুরোদমে ফের চালু হয়ে যায় বালু উত্তোলন। কুমার নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় ২০টি অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালূ উত্তোলন করা হচ্ছে।
গত ২৯ ফেব্রয়ারি এমপি নিক্সন চৌধুরী সদরদী উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে যোগদানের সময় কাপুরিয়া সদরদী এলাকায় কুমার নদী থেকে বালু উত্তোলন দেখে ফেলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে তাৎক্ষনিক বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেন।
এসময় তিনি স্থানীয় সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিভাবে চক্রটি বালু উত্তোলন করছে বিষয়টি অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রকাশ করুন। পাশাপাশি এর সাথে যদি প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকে তাদের সহ বালু উত্তোলনকারিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশ দেন।
তিনি আরও বলেন, নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পেতে সরকার যেখানে কোটি কোটি টাকা খবচ করে বাঁধ নির্মান করছে সেখানে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারনে ফের নদী ভাঙ্গনের শিকার হবে এমনটা হতে দেওয়া হবে না। তাছাড়া বেঙ্গল কোম্পানী সঠিকমত কাজ না করে তাদের নির্ধারিত কিছু এজেন্টজের দিয়ে বালুর ব্যবসা পরিচালনা করছে আর এর সাথে জড়িত রয়েছে অসাধু কিছু কর্মকর্তা। অনতিবিলম্বে এসব বালু উত্তোলন চিরতরে বন্ধ করাসহ যেখানে যেখানে ক্ষতি হয়েছে সেখানে ক্ষতি পুরন দিতে হবে।
সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসির সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছরে কুমার নদী খনন কাজ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বেঙ্গল গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছিল। তারা নদী খনন করে চলে গেলে এলাকার কিছু বালু ব্যবসায়ি তাদের কাছ থেকে সাবলীজ নিয়ে নদী খননের কাজ নেয়। একই সাথে নদী খননের নামে নদীর তলদেশ হতে বালু উত্তোলন করে বালু ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর এলাকাবাসি জানালে এবং বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এতদিন বালু উত্তোলন করে চক্রটি এককভাবে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এখন প্রশাসনের কিছু অসৎ ব্যক্তির গোপন সখ্যতায় তার ভাগ নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মুকতাদিরুল আহম্মেদ তিনি নিজেই বালু ব্যবসায়িদের সাথে আতাত করে উপজেলা পরিষদের ২টি পুকুর, ভাঙ্গা কাজী শামচুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠ, সহকারি কমিশনার (ভুমি) অফিসের পুকুর ভরাট কাজ শেষ করিয়েছেন। এছাড়াও মুজিববর্ষ পালন, ১৬ ডিসেম্বর পালন, বাংলা নববর্ষ পালন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসব বালু ব্যবসায়িদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাদের মিয়া দীর্ঘ ১ যুগেরও বেশী সময় ভাঙ্গা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার কার্যালয় ও সহকারি কমিশনার (ভুমি) অফিসে দায়িত্ব পালন করায় এলাকার এসব চক্রের সাথে তার রয়েছে ঘনিষ্ট সখ্যতা। অভিযোগ রয়েছে সে ও উপজেলা নিবার্হী অফিসারের জনৈক পিয়ন এসব অর্থ কালেকশন করে থাকে।
ভাঙ্গা পৌরসদরের বাসিন্দা ও শ্রমিক নেতা মিজানুর রহমান পান্না বলেন, দিনের পর দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর দুইপাড় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আসছে বর্ষা মৌসুমে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙ্গাবাসি বেশ ক্ষতির সম্মুখিন হবে। দ্রুত এসব বালু ব্যবসায়িদের নদীতে বালু ব্যবসা বন্ধ করার জন্য সরকারের দৃষ্টি কামনা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক বালু ব্যবসায়ি জানায়, আমরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করি ঠিকই এই টাকার ভাগ প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যাক্তিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মচারিরা পেয়ে থাকে। নাহলে প্রশাসনের নাকের ডগায় মাসের পর মাস এভাবে বালু উত্তোলন করা কি করে সম্ভব?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে বালু উত্তোলন করে জেল জরিমানা দিয়ে পুনরায় বালু উত্তোলন করছেন, পুর্ব সদরদীর ড্রেজার মালিক খবির মাতুব্বর, খারদিয়ার ফারুক মিয়া, নান্নু মীর, আলগী ইউনিয়নের এসকেন মেম্বার, ভাঙ্গার মমিন, মুনসুরাবাদের কাবুল, ইলিয়াছ, ঘারুয়ার রাজ্জাক মিয়া, তুজারপুরের সিরাজ ভুইয়া, মোশারফ হোসেন সহ আরো বেশ কয়েকজন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মুকতাদিরুল আহম্মেদ এর বক্তব্য নিতে গেলে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি এবং তাহার ব্যবহৃত মোবাইলে যোগাযোগ করে সংযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ফরিদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, কুমার নদীতে অবৈধ ড্রেজার ও বেঙ্গল গ্রুপের ড্রেজার নিয়ম বর্হিভুত বালু উত্তোলনের সংবাদ আমি পেয়েছি। জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। একাজের সাথে যেই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি) মোঃ আল-আমিন বলেন, আমি সদ্য ভাঙ্গাতে যোগদান করেছি। আমার কাছে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই আমি ড্রেজার জব্দ সহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সব কাজ আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশাসনের উর্দ্ধতন মহলের সার্বিক সহযোগিতা ও জনসাধারনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেলেই বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব।
পিবিএ/রফিকুজ্জামান/এমএসএম