পিবিএ,ঝিনাইদহ: মেয়েদের সাজগোজের অন্যতম প্রয়োজনীও জিনিস হচ্ছে গহনা। এই গহনার চাহিদা মিটাতে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে গরিবের সোনাখ্যাত ইমিটেশন সিটি গোল্ডের জুয়েলারি কারখানা। সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সোনার চাহিদা মেটাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এখানকার গহনা তৈরির কারখানাগুলো। মহেশপুরে সিটি গোল্ড হিসেবে খ্যাত দুটি কারখানা থেকে ইমিটেশনের গহনা তৈরি শুরু হলেও এখন ১১টি কারখানা গড়ে উঠেছে।
এখানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৬ শতাধিক পরিবারের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ জীবিকা নির্বাহ করছে ইমিটেশন জুয়েলারি কারখানায় কাজ করে। এসব কারখানায় উৎপাদিত ইমিটেশন জুয়েলারি ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হচ্ছে। সিটি গোল্ডকে হার মানিয়েছে এখানকার গলার হার, কানের দুল, হাতের চুরি, বালা, চেন, ব্রেসলেট, পায়ের নূপুর, আংটি। ভারতের থেকে কম দামেও পাওয়া যাচ্ছে এসব জুয়েলারি সামগ্রী। স্বর্ণের উচ্চমূল্যের কারণে বাহারি ডিজাইনের ইমিটেশন সিটি গোল্ডের গহনা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এলাকাবাসী জানান, ২০০৩ সালের দিকে ঝিনাইদহের মহেশপুরে প্রথমে গরিবের সোনার গহনা (সিটি গোল্ড) তৈরির কাজ শুরু করেন মিলন নামের এক যুবক। স্থানীয় কিছু যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার গহনা বাজারজাত শুরু করেন। এখন একে একে ১১টি কারখানা গড়ে উঠেছে।
এলাকাবাসী আরো জানান, ২০০২ সালের দিকে বাংলাদেশে ভারত থেকে ইমিটেশনের সিটি গোল্ডের জুয়েলারি সামগ্রী আসতে শুরু করে। ভারত থেকে যে গহনাগুলো আনা হতো তার দাম অনেক ছিল। ভারতের এক জোড়া ইমিটেশনের গহনার দাম ৫ থেকে ৭শ’ টাকা। আর মহেশপুরে কারিগরদের তৈরি গহনা ২শ’ থেকে ২৫০ টাকায় পাওয়া যায়। এখানকার তৈরি গহনা টেকসই, মজবুত ও রং বেশি দিন থাকে। এলাকাবাসীদের তথ্য মতে, দেশে স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে সমাজের উচ্চবিত্ত সব শ্রেণির মানুষ সিটি গোল্ডের গহনা ব্যবহার করেন। মহেশপুরের দেশীয় সিটি গোল্ডের কারণে ভারত থেকে তেমন আর সিটি গোল্ডের গহনা আসে না। কারণ ভারতের থেকে গুণগত মান ভালো থাকায় ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই পাইকারি দামে ক্রয় করেন।
সরেজমিনে মহেশপুর উপজেলার বৈচিতলা, নওদাগ্রাম, জলিলপুর, যোগীহুদা, রামচন্দ্রপুর, বাথানগাছিসহ দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামের পর গ্রামে কর্মসংস্থানের নতুন চিত্র দেখা গেছে। দলবেঁধে বসে একনিষ্ঠ মনোযোগে ছাচে আর ডিজাইনে কেউ কেউ গলাচ্ছে নানা ধাতব পদার্থ, কারো মনোযোগ নকশাতে কারো বা হাতে চলছে গহনার চুড়ান্ত ডিজাইন কেউ বা পুঁতি সাজাচ্ছে কোথাও বা চলছে স্বর্ণের সোনালি কালারের রঙের কাজ। ভাঙাচোরা মাটির বা টিনশেডের ঘরে ঘরে গ্রামের পর গ্রামজুড়ে ইমিটেশন গহনা তৈরির এমন মহাযজ্ঞ চলছে দেশের সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহের মহেশপুরে।
পৌরসভাসহ ৩টি ইউনিয়নে ১১টি কারখানার মাধ্যমে জীবনযাত্রা বদলের এ গল্প শুরু হয়েছে। এ উপজেলা জুড়েই ভারত সীমান্ত। ভালো অবকাঠামো, কলকারখানা আর যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এ অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে বেকারত্ব। এই যখন অবস্থা ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারি নতুন স্বপ্ন এখানকার মানুষদের। স্কু-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ফাঁকে কর্মসংস্থানের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ। প্রতিদিন কাজ শেষেই পাচ্ছে নগদ টাকা, নিজের লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি পরিবারকেও সহযোগিতা করে চলেছে ক্ষুদে কারিগররা।
মহেশপুরে মিলন সিটি গোল্ড কারখানার মালিক মিলন জানান, তার কারখানায় এখন ৫শ’ শ্রমিক রয়েছে। মহেশপুর শহরে নিজস্ব ভবনে ইমিটেশন জুয়েলারির মূল কারখানা। মহেশপুর শহরে রয়েছে ১টি শোরুম। এ ছাড়াও ঢাকা ও রংপুরে আরো ২টি শোরুম রয়েছে। তিনি বলেন, তার দেখাদেখি এখন মহেশপুরে ১১টি কারখানা রয়েছে।
মহেশপুরের সিটি গোল্ড পল্লীর আরেক মালিক জানান, আমরা সম্পূর্ণ হাতে গহনা তৈরি করি। ভারতের থেকে মানসম্পন্ন ও কম দামে গহনা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। তিনি বলেন, মহেশপুরে প্রায় ৫শ’ পরিবার রয়েছে যারা সবাই সিটি গোল্ডের গহনা তৈরির সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, সিটি গোল্ড গহনা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত আলোর দরকার। মহেশপুরে ২৪ ঘণ্টা যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এই ব্যবসার পরিধি আরো বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে আরো হাজার বেকার তরুণ-তরুণীর।
সিটি গোল্ড পল্লীর কারিগর মমিন জানান, যে কোনো গহনা ব্যবহারে পর রং নষ্ট হতে পারে। মহেশপুরের তৈরি কোনো গহনার রং উঠে গেলে তা ফেরত বা পরিবর্তন করে দেয়া হয়। কিন্তু ভারতের কোম্পানির সিটি গোল্ডের গহনা ব্যবহারে এমন সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, ভারতের সিটি গোল্ডের গহনাগুলো ত্বকের জন্য ভাল না। কারণ তারা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহার করে। আর মহেশপুরের সিটি গোল্ডে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।
পিবিএ/এইউ/এফএস