যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আরও ১০ বাংলাদেশির মৃত্যু

এক কক্ষে করোনায় মৃত স্বামীর লাশ, অন্য কক্ষে স্ত্রী ও দুই সন্তান

পিবিএ ডেস্ক: করোনাভাইরাসে পুরো যুক্তরাষ্ট্র বিপর্যস্ত। দেশটিতে মৃত্যুর মিছিল বিদ্যুৎ গতির মতো বাড়ছে। এদিকে করোনায় মৃত্যুর তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে বাংলাদেশিদের নাম। ঝরছে এক একটি প্রাণ। গ্রাস করছে পুরো পরিবার, পুরো কমিউনিটিকে। শোকে কাতর হয়ে বদলে যাচ্ছে বহু পরিবার, বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনের গল্প।জমা হচ্ছে একর পর এক বিলাপগাথা।

১১ এপ্রিল শনিবার এই ভাইরাসে মারা গেছেন আরো ১০ জন বাংলাদেশি। তাঁরা হলেন- দেওয়ান আফজল চৌধুরী , ব্যবসায়ী নুরুন নবী, মোঃ মানিক মিয়া, বোরহান উদ্দিন বাবুলের স্ত্রী, রতন চৌধুরী, ওয়াশিংটন ডিসিতে আব্দুল মান্নান, জয়দেব সরকার, খন্দকার মোছাদ্দিক আলী (সাদেক) এবং বাফালোতে সামসুল জাহির, মোঃ জাকির।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণঘাতী করোনায় ১১৪ বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। এ সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

করোনায় এমন তাণ্ডবে স্তব্দ বাংলাদেশি কমিউনিটি। নিউইয়র্কের কুইন্সের এষ্টোরিয়া ঘটে গেল এমন একটি করুণ ঘটনা। স্বপ্নের দেশে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে স্বামী রতন চৌধুরী ও স্ত্রী সুজাতা চৌধুরী সন্তানসহ এসেছিলেন এই স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার।নিজে কাজ করেন, স্বামী কাজ করেন, দুই সন্তান স্কুলে যায়। করোনার বিপদ সংকেত পাবার সাথে সাথেই স্বামী ছুটি নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন, সন্তানরাও বাড়িতে। সুজাতা চৌধুরী নিজের অজান্তেই ভাইরাস বাড়ি নিয়ে আসলেন কাজের জায়গা থেকে। নিজে মারাত্মক অসুস্থ হবার আগেই স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দুই সন্তানও আক্রান্ত হলো ভাইরাসে। হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ায় বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। ডাক্তারের নির্দেশনায় তিন বেডরুমের বাড়িতে স্বামী সন্তানদের আলাদাভাবে রুমগুলো ছেড়ে দিয়ে সুজাতা নিজে জায়গা করে নিলেন ড্রইং রুমে। মধ্যরাতেও রুমে রুমে গিয়ে চেক করেন, কে কেমন আছে। ১১ এপ্রিল শনিবার ভোরে স্বামীর রুমে ওষুধ দেবার জন্য ঢুকে কোন সাড়া পেলেন না স্ত্রী। যা বুঝবার অল্পতেই বুঝে নিলেন তিনি। বাইরে থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানদের ডেকে উঠালেন। শান্ত স্থিরভাবে বললেন ওদের সবকিছু।সন্তানরাও ততক্ষণে বুঝে গেল করোনা কেড়ে নিয়েছে তাদের বাবাকে।

সুজাতা চৌধুরী নিজেই ৯১১ নাম্বারে কল করলেন। উত্তর পেলেন তাদের আসতে দেরি হবে। সারাদিন তিনটি অসুস্থ মানুষ বসে রইলেন তাদের অতি প্রিয়জনের মৃতদেহ নিয়ে। বিকেল চারটায় তিনজন স্যোসাল ওয়ার্কার আসলো। সাথে আসলো না মর্গের গাড়ি কিংবা কোন সরঞ্জাম। তাঁরা জানালেন তাদের অসহায়ত্বের কথা। সরঞ্জাম সর্টেজ ও মর্গ বা অস্থায়ী ট্রেলারের মর্গে জায়গার অভাবের কথা।কিছু মৃতদেহ মাটিচাপার পর মর্গ কিছুটা খালি হলে তারা নিয়ে যাবে মৃতদেহ। প্লাস্টিকের ডাবল বডি ব্যাগে স্বামীর দেহ ভরে স্ট্রেচারে বেধে স্প্রে করে রুমেই রেখে বন্ধ দরজায় ‘নো এনট্রি’ হলুদ সাইন ঝুলিয়ে চলে গেলেন তাঁরা। এক রুমে প্রিয় স্বামীর মৃতদেহ আর অন্য রুমে একই রোগের তিনটি মানুষ বসে আছেন।বাকিটা এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি।

সিলেটের খন্দকার মোছাদ্দিক আলী ব্রঙ্কসে থাকেন। নিউইয়র্ক, নিউজার্সিতে বসবাসরত বিশাল অভিবাসী পরিবারের সদস্য। নিজের তিন ছেলের একজন ডাক্তার। দুইজন নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিকে কর্মরত। আমেরিকায় কোন পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ পদের বাংলাদেশি এ পরিবারের সদস্য। ট্রাফিক সন্তানের হাত ধরে করোনার অনুপ্রবেশ। পরিবারের সবাই আক্রান্ত। ছেলে খন্দকার আব্বাসের শরীর নাজুক হতে থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হন। এক পর্যায়ে চরম শারীরিক সংকট দেখা দেয়। ঘরের অন্যসব কমবেশি অসুস্থ। অসুস্থ বাবা জায়নামাজে বসে সদ্য বিবাহিত সন্তানের রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহ’র দরবারে ফরয়্যাদ জানাতে থাকেন। জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে আব্বাস ঘরে ফিরেন। খন্দকার মোছাদ্দিকের শরীর খারাপ হতে থাকে।

১১ এপ্রিল শনিবার ভোরে হাসপাতালে নেয়ার পরই জীবনের ইতি টানেন নির্বিবাদি ও সজ্জ্বন হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোছাদ্দিক। তাঁর শত শত আত্মীয় স্বজন কেউ যেতে পারছেন না , সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এ প্রবাসীর দাফন কখন হবে – স্বজনরা জানাতে পারছেন না মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা পরও।

এর আগে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জনির পরিবারে ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা। কর্তব্যকাজে গিয়ে নিজে শরীরে ঢুকেছিল করোনাভাইরাস। যখন পজিটিভ ধরা পড়লো ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। ঘরে আক্রান্ত হয়েছেন তার বাবা। আর বাবাকে সেবা দিচ্ছিলেন মা। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের নেওয়ার পর গত বুধবারে বাবা অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সারোয়ারের মা অধ্যক্ষ রেনু সুলতানাও অসুস্থ। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদতেও পারছেন না জনি।

একদিকে মা , অন্যদিকে তাঁর পেশাগত জীবন। বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহল নগরীর লোকজনের নিরাপত্তার কাজ যে তাঁর মতো লোকজনের হাতে দিয়ে নাগরিকরা ঘুমাতে যায়।

অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পিরোজপুর শহরের সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন। তার সহধর্মিণী রেনু সুলতানা পিরোজপুর সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ছোট ছেলে জনির আবেদনে তারা যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্র্যান্ট হয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশ ও আমেরিকায় আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন।

এমন কাহিনী নিউইয়র্কের সর্বত্র। কেউ কারো সাথে কথা বলছেন না। বললেই, বেরিয়ে আসছে শোকের সাতকাহন। যা কেউ আর শুনতে চায় না , শোনাতেও চায় না।

এদিকে নিউইয়র্কে ব্রঙ্কসের বাংলাবাজার জামে মসজিদ ও স্টারলিং-বাংলাবাজার বিজনেস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ৪৩ পুলিশ প্রিসেনক্টের কমিউনিটি পার্টনার, কমিউনিটির প্রিয়মুখ, সমাজসেবী আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিনের দাফন সস্পন্ন হয়েছে। ১১ এপ্রিল শনিবার বিকেল ৪.৪৫ মিনিটে জানাজা শেষে নিউজার্সীর টেটোয়ায় বাংলাবাজার মসজিদের নিজস্ব কবর স্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। জানাজায় ইমামতি করেন নর্থ ব্রঙ্কস জামে মসজিদ অ্যান্ড ইসলামিক সেন্টারের খতীব মাওলানা মো: মাসহুদ ইকবাল।

২৪ ঘণ্টায় আমেরিকায় ১ হাজার ৭১৯ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ফলে এই ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৫৭৭ জনে। প্রথমবারের মতো কোনো দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াল। আর গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে আরও ২৬ হাজার ৪৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৭৯ জনে।

পিবিএ/এমএসএম

আরও পড়ুন...