পিবিএ,বান্দরবন: বান্দরবানের লামা উপজেলায় চলতি মৌসুমে প্রায় ৬ হাজার একর ফসলি জমিতে বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ হয়েছে। গত তিন যুগ ধরে একটানা উপজেলার ফসলি জমিতে এ তামাক চাষের ভয়াল বিস্তারে সহযোগিতা করছে বেশ কয়েকটি টোব্যাকো কোম্পানী। এ কারণে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে স্থানীয় কৃষকেরা।
বর্তমানে উপজেলায় চাষাবাদের দুইটি মৌসুমে পরিণত হয়েছে। একটি ধানের, অপরটি তামাকের। ফসলি জমিতে অব্যাহত তামাক চাষের ফলে প্রতি বছর বোরো ও রবি শস্যের উৎপাদন যেমন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে; তেমনি মাটির উর্বরাশক্তিও দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি এ চাষে সংশ্লিষ্ট কৃষকরা জটিল রোগে আক্রান্তসহ ব্যবহৃত কীটনাশক খাল বিল নদী ও পুকুরের পানির সাথে মিশে মাছের প্রজনন মারাত্মক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গোটা বিশ্বের সঙ্গে দেশবাসী যখন সরব, তখন গাছগাছালির সবুজ বনায়নের বদলে উপজেলায় তামাক চাষের প্রসার নিয়ে সচেতন মহল উদ্বিগ্ন। এখনিই পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে অচিরেই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, মাতামুহুরী নদীর পলি বাহিত উর্বর এলাকা এবং জ্বালানি কাঠের সহজলভ্যতার কারণে দেশের প্রধান প্রধান তামাক কোম্পানিগুলো ১৯৮৪ সাল থেকে লামায় তামাক চাষ শুরু করে। উপজেলার লামা সদর ইউনিয়নের মেউলার চর এলাকায় সর্বপ্রথম ১০ একর জমিতে তামাক চাষ করা হয়। এরপর থেকে গত ৩৫ বছরে ক্ষতিকর তামাক চাষের ভয়াল বিস্তার ঘটেছে লামা পৌরসভা এলাকাসহ ৭টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানের বোরো ও রবি মৌসুমের ফসলি জমিতে। বর্তমানে ৯০ভাগ জমি তামাক চাষের দখলে।
কৃষি বিভাগ সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে তামাক কোম্পানিগুলো প্রায় ২ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ করেছে। বেসরকারি হিসাব মতে এর পরিমাণ ৩গুণ বেশি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা হাসিলের জন্য কৌশলগত কারণে কখনো তাদের রেজিস্ট্রেশনকৃত তামাক চাষির সংখ্যা ও জমির পরিমাণের প্রকৃত তথ্য দেন না। ব্রিটিশ আমলের নীলকর জমিদারদের মতোই উপজেলায় এ বিষের আবাদ করার জন্য আস্তানা করেছে ঢাকা, আবুল খায়ের, আকিজ ও বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি। আবার এ চাষে নারী ও শিশুদেরকেও খাটানো হচ্ছে অহরহ। এতে করে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা।
স্থানীয়রা জানান, মৌসুম এলেই তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের বীজ, সার, কীটনাশক, পাওয়ার টিলার, পাওয়ার পাম্প, নগদ ঋণ, সর্বোপরি বাজারজাতকরণের সুবিধা প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলে কৃষকরা লোভের বশবর্তী হয়ে ফসলি জমিতে বোরো ও রবি শস্যের আবাদ না করে ক্ষতিকর তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫ হাজার ২৩ হেক্টর। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বোরো এবং ৫৯০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭৮০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। যদিও বিগত বেশ কয়েক বছর উপজেলার বোরো ও রবি শস্য উৎপাদন শুধু কৃষি বিভাগের কাগজে কলমে অর্জিত হয়ে থাকে।
জানা গেছে, উপজেলার ৩০টি ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। মাঠ পর্যায়ের এসকল কর্মকর্তাদের সাথে কৃষকদের সখ্যতা না থাকা, মাঠ পর্যায়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা, সর্বোপরি তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদের সামনে তুলে ধরার ব্যর্থতার কারণে এলাকার কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছে বলে জানা গেছে। ফসলি জমিতে ব্যাপক হারে তামাক চাষের ফলে এলাকায় বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে কমেছে।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম বলেন, বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছর তামাকের চাষ কিছুটা কম হয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদেরকে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে কিছু কিছু তামাক চাষী এখন সবজি চাষ ও ভুট্টা চাষও করেছেন। তামাক চাষে কৃষকদের অতি উৎসাহের কারণ এবং এর প্রতিকার চিহ্নিত করণের লক্ষ্যে শিগগিরই একটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে বলেও জানান তিনি।
পিবিএ/ইএইচকে