পিবিএ,ডেস্ক: অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা চালু নিয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ এর বিরোধিতা করে ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছে। রাস্তায় মানববন্ধনও করেছে কেউ কেউ।
করোনা মহামারির মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে নির্দেশনা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এর পর থেকে কিছু শিক্ষার্থী সব ধরনের ক্লাস, পরীক্ষা ও ভর্তি বয়কটের নামে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে পরিস্থিতি অস্থির করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে, এ রকম উসকানিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝেও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা এর পেছনে ষড়যন্ত্র দেখছেন।
দেখা গেছে, ফেসবুকে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ঐক্য’র ব্যানারে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিস্টার ফি মওকুফ চাই’ একটি গ্রুপ খুলে সেখানে কিছু শিক্ষার্থী পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছু রাজনৈতিক কর্মীও এই গ্রুপে উসকানি ছড়াতে সহযোগিতা করছেন। সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, গ্রুপটির অন্যতম ক্রিয়েটর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সস্পৃক্ত থাকা চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অ্যানি সেন। গ্রুপে দেখা যায়, শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ না নিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন এই নেতা। একই সঙ্গে, পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ারও চেষ্টা করছেন তিনি। ৩ মে তার একটি পোস্টে দেখা যায়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংক্রান্ত উপ-কমিটি করার আহ্বান জানাচ্ছেন, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-নীতির পরিপন্থি। শুধু তাই নয়, অনেক বহিরাগতেরও অংশগ্রহণ এই গ্রুপে রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে অ্যানি সেন গতকাল দুপুরে সমকালকে বলেন, তাদের এই আন্দোলন ফেসবুকভিত্তিক এবং এখানে কোনো বহিরাগত নেই। গ্রুপের সদস্য এরই মধ্যে ১৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তারা কোনো অস্থিরতায় উসকানি দিচ্ছেন না। তারা কেবল শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথা বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ‘সংঘাত’-এ যাওয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়।
আন্দোলনে থাকা কিছু শিক্ষার্থীর অভিযোগ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় টিউশন ফি দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তবে এটা সত্য নয় বলে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কয়েকটি সূত্র জানায়, বর্তমান করোনাকালীন সংকটে অনেক অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এটা আমরাও বুঝি। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হচ্ছে। সুতরাং কোনো শিক্ষার্থীকেই টিউশন ফির জন্য চাপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা যেন টিউশন ফি জমা দেয়, সেই বিষয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী যেন বেতন বঞ্চিত না হন সেজন্যই এই অনুরোধ জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ যেখানে মানবিক সেখানে কিছু শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের উস্কানিতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ ব্যাপারে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অব বাংলাদেশ (পিইউএসএবি) নামে একটি গ্রুপও সোচ্চার। সেখানকার এডমিনের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন যারা কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও এই গ্রুপটি ধারাবাহিকভাবে সরকারের সমালোচনা করেছে বলে জানা গেছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, কেউ যেন বেতন বঞ্চিত না হন, এ জন্যই সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি জমা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আর সেশনজটের ঝুঁকি কমাতে শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদি কেউ-ই টিউশন ফি না দেয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরতদের বেতনই বা কোথা থেকে দেওয়া হবে? সরকার তো এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রণোদনা কিংবা আর্থিক সহযোগিতা এখনও দেয়নি।
এ ছাড়াও আন্দোলনকারীদের গ্রুপে অনেকে অনলাইনে পরীক্ষা বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দাবি, চলমান সেমিস্টারে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই ক্লাস ও মিডটার্ম পরীক্ষা মিলিয়ে ৭০ শতাংশ মূল্যায়ন কার্যক্রম করতে পেরেছে। এই মুহূর্তে তাদের কোনো ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘ইউজিসির সঙ্গে এসব বিষয়েই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী যে ইউজিসি থেকেও খুবই সংবেদনশীল একটি গাইডলাইন আসবে। সুতরাং এসব বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তারা আসলে শিক্ষার্থীদের ভালো চায়, নাকি তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, এটা দেখতে হবে।’
এ ছাড়া আগামী জুনের মধ্যে সবাইকে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে কীভাবে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো যায় সে বিষয়েও গবেষণা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, গত সোমবার রাজধানীর শাহবাগেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে শিক্ষাদান নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে এক মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। কেন এ মানববন্ধন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন অনলাইন পরীক্ষার নামে মূলত শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফি প্রদানের জন্য চাপ দিচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে সেমিস্টার ফির জন্য চাপ দিলে যেসব মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছে, তারা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়বে। এ ছাড়া এদেশের ইন্টারনেটের যে অবস্থা, তাতে অনলাইনে ক্লাস চালানো কঠিন। এমন অবস্থায় অনলাইনে পরীক্ষা দিতে সব শিক্ষার্থী প্রস্তত কিনা তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিবেচনা করা উচিত। এ জন্য আমাদের মূল দাবিগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক সেমিস্টার ফি মওকুফ করতে হবে এবং অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার নামে সেমিস্টার ফি আদায়ের পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক উপাচার্য বলেন, ‘ইউজিসির সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করছিল। ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা জারির আগে এই হার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৮০-৯০ ভাগ ছিল। সরকার যদি নগণ্য মূলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ হাইস্পিড ইন্টারনেট প্যাকেজের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে শতভাগ অংশগ্রহণ কঠিন কোনো বিষয় নয়।’
তারা বলেন, আমরা কি সে ধরনের সমাধানের দিকে যাব? নাকি হবে না, পারব না বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকব? আমাদের পাশের দেশ ভরতে কিন্তু অনেক জায়গায় ইন্টারনেটের অবস্থা আমাদের চেয়ে খারাপ। তবুও তারা গোটা শিক্ষা অনলাইনে দিয়ে যাচ্ছে। তারা পারলে আমাদের তরুণরা পারবে না কেন? যারা তাদের না পারার জন্য ধমকাচ্ছে, তারা শিক্ষার্থী বা দেশ কারোরই ভালো চায় না।
পিবিএ/এএম