মোহাম্মদ হোসেন, হাটহাজারী : দক্ষিণ এশিয়ার এক মাত্র মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। বিগত বছর গুলোতে পরিবেশ দূষণের কবলে তার স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছিল এই নদী। দুষিত হয়েছিল নদীর পরিবেশ। বিভিন্ন কলকাখানার বর্জ্য ও দুষিত পানি নদীর পানির সাথে মিশার ফলেই এই দূষণ। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ডলফিন মরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হালদা হাাড়িয়েছে তার ঐতিহ্য। তবু প্রকৃতির কঠিন সংগ্রামে হালদা টিকে রয়েছে।
২০২০ সালে হালদা থেকে বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বাধিক ডিম আহরণ করা হয়। একজন নিবেদিত প্রাণ সরকারি কর্মকর্তার ঐকান্তিক চেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রুহুল আমিন এখানে আসার পর থেকে হালদার উপর বিশেষ নজর দেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তার বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপের সুফল পেল দেশ।
হালদার সমস্যা গুলি চিহিৃত করে নদীতে অভিযান শুরু করেন হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। এতে দেখা যায়, গত দেড় বছরে নদীর ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করেছে। উপজেলা ও নগরীর বিভিন্ন কলখানায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান এবং নদী দূষন কমায় আজ হালদায় প্রাণ ফিরেছে।
হালদা খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে নামকরণ হয় হালদা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার ১ নং পাতাছড়া ইউনিয়নের রামগড় পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে মানিকছড়ি, চট্টগাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরের কাছে কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে। হালদার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। পানির উৎস মানিকছড়ি, ধুরং, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, লেলাং, বোয়ালিয়া, চানখালী, সর্ত্তা, কাগতিয়া, সোনাইখাল, পারাখালী, খাটাখালীসহ বেশ কিছু ছোট ছোট ছড়া। নদীটির গভীরতা স্থান বিশেষ ২৫ থেকে ৫০ ফুট। তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, হালদায় একসময় ৭২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কালপরিক্রমায় পাঙ্গাশ, ঘনি চাপিলা, কইপুঁটি, বাণী কোকসা, ঘর পুঁইয়া, গুইজ্জা আইর, বুদ বাইলাসহ অন্তত ১৫টি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পাহাড়ি অঞ্চলের সালদা গ্রামের সালদা নামক ছড়া থেকে হালদার নামকরণ। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম শহরের চাঁদগাঁও হয়ে পড়েছে ইতিহাস খ্যাত আরেক নদী কর্ণফুলীতে। হালদা নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ দেশেই উৎপত্তি হয়ে এ দেশেই শেষ হয়েছে। সে হিসেবে এ নদী সম্পূর্ণপরূপে আমাদের। প্রায় ১০০ কি.মি. দৈর্ঘ্যের হালদা নদীতে মিলিত হয়েছে ৩৬টি ছড়া।
এর খালের সংখ্যা ১৯টি। এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা বাংলাদেশের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। এ প্রাকৃতিক জিনপুল বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর গুরত্ব অত্যাধিক। দেশের রুই-কাতলা, মৃগেল, কালিবাউসসহ সব ধরনের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রকৃতিক উৎস হালদা। হালদা নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য নয়, এটি ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যর যোগ্যতাও রাখে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে হাটহাজারীর ইউএনও হিসেবে যোগদানের পর থেকেই রুহুল আমিনের নেতৃত্বে হালদা নদীর পরিবেশ রক্ষা ও নদী দুষণরোধ শুরু হয়। নিয়মিত অভিযানে নদীর প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় প্রশাসনের কিছু সোর্সের মাধ্যমে নদী থেকে ভাসা জাল জব্দ, ড্রেজার আটক করেন। দিবারাত্রী অভিযানে নদীকে সুন্দর পরিবেশে নিয়ে আসার পিছনে যথেষ্ট ভুমিকা রেখেছেন ইউএনও রুহুল আমিন।
তিনি হালদা নদীর পরিবেশ রক্ষার্থে নিজ উদ্যোগে শক্তিশালী সোর্সের এর মাধ্যমে নদীতে অভিযান পরিচালনা করে আসছিলেন। নদীতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে পুলিশ, আনছার,সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান পাশাপাশি সচেতন লোকজন ও তাকে সহযোগিতা করেন।
অভিযানের পর ইউএনও সাথে সাথে গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়ে দেন এবং সবশেষ ইউএনও ফেইসবুকে অভিযানের সংক্ষেপে কিছু পোস্ট করেন।
ইউএনও রুহুল আমিন জানান, ‘গত দুই বছরে হালদা নদী নামেই ছিল কাজে ছিল না। হালদা নদীর জীব-বৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় যেসকল চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রম সফলভাবে মোকাবেলা করতে হয়েছে এর মধ্যে ২০১৯ সালের একটা ঘটনার প্রসঙ্গে বলতে হয়, যেটা হালদা নদীকে ব্যাপক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
হালদা নদীর জীব-বৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সর্বদা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে হালদা নদী সংক্রান্ত গৃহীত কার্যকরী উদ্যোগগুলোকে জনগণের নিকট তুলে ধরেছেন বলে তিনি তাদের প্রশংসা করেন।
পিবিএ/মোহাম্মদ হোসেন/এমএ