একে অন্যকে দুষছেন: আরিফ-সাবরিনা

পিবিএ,ঢাকা: ভালোবাসা থেকে তাদের বিয়ে। তবে প্রথম বিয়ে নয়। স্বামীর চতুর্থ আর স্ত্রীর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়। স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীর নানা অপকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল বাকপটু চিকিৎসক স্ত্রী সাবরিনার অংশগ্রহণ। দুজনে মিলে বিস্তার করে জালিয়াতির নানা জাল।

শেষমেশ করোনা পরীক্ষা নিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ প্রতারণায় ধরা পড়তে হয়েছে এই দম্পতিকে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হতে হয়েছে মুখোমুখি। এখন চলছে পরষ্পর দোষারোপের পালা। তবে আরিফ-সাবরিনা সমানে সমান ধুরন্ধর বলেই তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

রিমান্ডে মুখোমুখি অবস্থানে এই দম্পতি করোনা রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা ও সরকারি নানা সুবিধা নিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য একে অন্যকে দায়ী করছেন। ডা. সাবরিনা বারবার দাবি করছেন কথিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জেকেজির চেয়ারম্যানই তিনি নন। আর একই সংগঠনের প্রধান নির্বাহী স্বামী আরিফুল পুলিশকে বলছেন তার স্ত্রীই জেকেজির চেয়ারম্যান।

পুলিশ বলছে, সমাজের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রভাব খাটাতেন সাবরিনা চৌধুরী। সরকারি কাজ পাইয়ে দিতেন আরিফুলের জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি) হেলথকেয়ারকে। সেই সুযোগে আরিফ চৌধুরীও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমএসহ স্বাস্থ্যসেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানে দাপটের সঙ্গে চলতেন। নিজের ওভাল গ্রুপের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের সব ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করত আরিফুল।

গত মার্চে সাবরিনার মাধ্যমেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার নমুনা পরীক্ষার বুথ স্থাপনের অনুমতি পায় জেকেজি। অভিযোগ আছে, এসব কাজে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করতেন বিএমর এক শীর্ষ নেতা ও হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবরিনার ইউনিট প্রধান।

তবে প্রভাব খাটিয়ে এতদিন নানা কাজ করলেও তাদের বিপদে ফেলে দিলো করোনা। শর্ত ভঙ্গ করে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও তা ফেলে দিয়ে করোনার মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে ফেঁসে যাচ্ছেন এই দম্পতি।

গত ২৪ জুন গ্রেপ্তার করা হয় আরিফুল হককে। আর ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় সাবরিনাকে। বর্তমানে দুজনেরই দ্বিতীয় দফা রিমান্ড চলছে।

দুজনেরই ছিলো বেপরোয়া জীবনযাপন

তথ্য বলছে, আরিফের এটি চতুর্থ আর সাবরিনার দ্বিতীয় বিয়ে। তবে বিয়ের পর সুখের সংসার সাজানোর বদলে বিষে পরিণত হয়েছে। কারণ সাবরিনার দাবি, আরিফ অনেক সময় তাকে মারধর করতেন। আর বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২৭তম বিসিএসে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেয়া সাবরিনাও অনেকটা বেপরোয়া চলাফেরা করতেন। তার প্রথম বরের সম্পর্কে দুই ধরণের তথ্য পাওয়া গেছে। কেউ বলছেন, বরও চিকিৎসক ছিলেন। অন্য একটি সূত্র বলছে, টেলিকম কোম্পানীর উচ্চ পদের কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথম স্বামীর ঘরে তার দুটি সন্তানও আছে বলে জানা গেছে।

সাবরিনার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে। তার বাবা সাবেক আমলা। তিনি ঢাকার শ্যামলীতে নিজ বাড়িতে বসবাস করেন। তার দুই মেয়ের মধ্যে ডা. সাবরিনা বড়। বাবার চাকুরীর সুবাদে বিদেশে বসেই এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন সাবরিনা। পরে সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেয়ে দেশে আসেন। সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি।

সাবরিনার প্রথম পোস্টিং দিনাজপুরে হলেও পরে বদলি হয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে যোগ দেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানেই কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্টার হিসেবে কর্মরত আছেন।

সাবরিনার অনৈতিক সম্পর্কের গুঞ্জন

অভিযোগ আছে, তার বিভাগীয় প্রধান ও বিএমএ’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান মিলনের সঙ্গে সুসম্পর্কের জোরে হাসপাতাল এবং অন্যত্র প্রভাব বিস্তার করতেন সাবরিনা। নিয়মিত ডিউটিও করতেন না বলে অভিযোগ আছে। তাদের দুজনের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কেরও গুঞ্জন আছে।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও দুজনই তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন। যদিও এ নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে সাবরিনাকে মারধরও করেছেন আরিফ চৌধুরী।

মাদকাসক্ত আরিফ বহুবিবাহেও সিদ্ধ

আরিফের একাধিক স্ত্রীর বিষয়টি গ্রেপ্তারের পর প্রকাশ্যে এসেছে। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্যজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে ভালোবেসে ২০১৫ সালে বিয়ে করেন সাবরিনাকে।

অভিযোগ আছে, আরিফ মাদকাসক্ত। যেকারণে সবসময় উগ্রভাব তার মধ্যে। সবশেষ গ্রেপ্তারের পর তেজগাঁও থানা পুলিশের কাছে রাতে ইয়াবা এনে দেয়ার আবদার করেন তিনি। ওই রাতে থানা হাজতের ফ্যান ও সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করেন আরিফ।

জানা গেছে, ওভাল গ্রুপ নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আরিফ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করলেও সাবরিনাকে বিয়ের পর স্বাস্থ্য খাতের ব্যবসায় নামেন। পরে নিয়মিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করত তার প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ ২০১৮-এর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে। আর এসব কাজ বাগিয়ে নিতে সাবরিনা সহযোগিতা করতেন।

তটস্থ থাকতেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন

অভিযোগ আছে, করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সুবিধা নিয়েছে জেকেজি। করোনার শুরুর দিকে যখন পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে টানাপোড়েন তখন অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে সরঞ্জাম নিত আরিফুল হক। অনৈতিক চাহিদা পূরণ না হলে আরিফ চৌধুরী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন হুমকিও দিতেন।

গত ৩১ মার্চ রংপুর মেডিকেল কলেজ, ১২ এপ্রিল মুগদা হাসপাতাল থেকে পিপিই, মাস্ক ও গগলসের জন্য চাহিদার বিপরীতে সামান্য কিছু সুরক্ষা সামগ্রী দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অন্যদিকে একইসময়ে আরিফুল চৌধুরী ১২শ করে পিপিই, গগলস, জুতার কাভার ও তিন হাজার করে সার্জিক্যাল মাস্ক ও সার্জিক্যাল গ্লাভস চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি লেখেন। তার সব চাহিদাই অনুমোদন দেওয়া হয়।

অনুমতির বাইরে গিয়ে বুথ বসিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে জেকেজি। এক পর‌্যায়ে টাকার বিনিময়ে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করার পর নিজেদের ল্যাপটপে মনগড়া রিপোর্ট দেয় জেকেজি। র‌্যাব বলছে, যার সংখ্যা ১৫হাজারের মত।

শুধু তাই নয়, মহাখালীর তিতুমীর কলেজের স্টাফদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় জেকেজির কর্মীরা। সেখানে তাদের বুথ ছিল। সাবরিনা ও আরিফুল চৌধুরীর ইন্ধনেই কলেজের স্টাফদের ওপর হামলা হয় বলে অভিযোগ আছে।

একে অন্যকে দুষছেন এখন

আদালত আদেশে রিমান্ডে নেয়ার পর মুখোমুখি করা হয় সাবরিনা ও আরিফুলকে। জানা গেছে, এসময় সাবরিনা আরিফকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আরিফকে উদ্দেশ করে বলেন─ তোর জন্যই আজ আমার এই অবস্থা। তুই আমাকে শেষ করে দিয়েছিস। সবকিছু করে এখন আমাকে ফাঁসিয়েছিস।

আরিফও পাল্টা জবাবে বলেন, সব দোষ কি আমার? তুমি তো এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলে। তুমিও জানতে সবকিছু।’

জেকেজির প্রতারণার ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। আরিফুল চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় ২০১২ সালেও একটি প্রতারণার মামলা রয়েছে।
পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...