প্রকৌশলি সরদার মোঃ শাহিন : আমার শোনিম। করোনার এই কয় মাসে আরো বড় হয়ে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হচ্ছে। ক’মাস বাদেই ষোল পূর্ণ হবে। খুশীর বিষয়। কিন্তু ওর মা এবং আমি খুশী নই। আমরা চাইনা এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাক ছেলেটা। কিন্তু ও খুব একসাইটেট। বয়স ষোল হতে যাচ্ছে ভেবেই সে একসাইটেট। কথায় কথায় এখন আর পোলাপাইন কথাটি শুনতে হবে না। একটা মুরুব্বী মুরুব্বী ধাঁচের ট্রিট পাবে। এজন্যেই করোনা টরোনায় কোন পরোয়ানা নেই শোনিমের।
ক’দিন ধরে শোনিমের ভাবসাবে পরিবর্তন এসেছে। একটু পরপরই টয়লেটে ঢোকে। একবার নিজের টয়লেট তো একবার মায়ের টয়লেট। না ঢোকেই বা উপায় কি! হঠাৎ করে পেটে কামড় দেয়; পেটটা একটু ব্যাথা ব্যাথা করে। অমনি দৌঁড়। ইদানিং এমন দৌঁড়টা বেড়ে গেছে। মানে, বেড়ে গেছে টয়লেটে যাওয়ার মাত্রা। করোনার দূর্দিনে আমাদের কপালে চিন্তার বলিরেখা। কথায় কথায় আগের মত ডাক্তারও পাওয়া যায় না।
এমনদিনে কেবল টয়লেটে যাবার সংখ্যা বাড়া নয়, ভেতরে বসে থাকার সময়টাও বেড়েছে। একবার গেলে আর বেরুবার নাম নেই। চুপচাপ, শব্দহীন টয়লেটে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে। ওর মা এবং আমি; দুজনেই চিন্তিত কন্ঠে বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করি, কষ্ট হচ্ছে বাবা? পেট কি খুব ব্যাথা করছে? ভেতর থেকে শোনিমের জবাব, না আব্বু! নো ব্যাথা। এভরিথিং ওকে; ফাইন। জবাবের মধ্যে সামান্য জড়তা নেই। একেবারেই স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক থাকাটাই স্বাভাবিক। ভাল এবং সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ টয়লেট না চাপলেও চাপার ভান ধরে টয়লেটে বসে থাকলে এমনই হয়। এসব না করেই বা উপায় কি? করোনাকালে স্কুল নেই, পড়াশুনার তেমন চাপ নেই। কিচ্ছু না করে আর কত ঘরের বন্দি জীবনে থাকা যায়! কত মাস থাকা যায়! কাজের মধ্যে কাজ একটাই। মোবাইল টিপো। আর অনলাইনে ঘুটুর ঘুটুর করো। কিন্তু মায়ের জ্বালায় তাও সম্ভব নয়। অগত্যা টয়লেটের ভান ধরে একটু পরপর টয়লেটে ঢুকে পড়া।
ঢুকে পড়ার ধরণটাও দারুণ। ট্রাউজারের পকেটে মোবাইল লুকিয়ে শোনিম এমনভাবে টয়লেটে ঢোকে যেন মা না দেখে। বাবা দেখলে সমস্যা নেই। বাবাকে তেমন গোনায় ধরেনা। ধরার কথাও না। বাবা দেখলেও কিছু বলে না। বলার মত মুখ থাকলে না বলবে। কাজটা তো বাবাও করে। মানে, বাপ-বেটা মিলেই করি। তবে প্রকাশ্যে না; গোপনেগোপনে করি। না করে উপায় কি। মালিকের কঠিন শাসন। আইয়ুব খানের শাসন; “টয়লেটে মোবাইল নিয়ে যাওয়া যাবে না। টয়লেটে মানুষ হাগু করতে যায়। মোবাইল টিপতে যায় না।”
আইয়ুবের বেটিকে লুকিয়ে যাবারও উপায় নেই। কোনভাবে পার পাবার যোগাড় নেই। যেখানেই লুকিয়ে মোবাইল দেখি না কেন, তার চোখে পড়বেই। ডিবির চোখ। সামান্য ফাঁকি দেবার জো নেই। মায়াদয়া তো নেইই। প্রথমে খুশখুশে কাঁশি দিয়ে জানতে চাইবে, কী করি? তারপর কষে ধমক। শোনিমকে ডাইরেক্ট ধমক দেয়। আমাকে দেয় ইনডাইরেক্ট। দম আটকে আসে। করোনায় যেভাবে শ্বাস আটকে আসে, ঠিক তেমনি দম আটকে আসে।
আমার এবং শোনিমের মতে করোনার চাইতেও কঠিন জিনিস ওর মা। গায়ের গড়ন এবং চরিত্রের ধরণও অনেকটা একই। অতীব সুন্দর এবং সদা শান্ত প্রকৃতির। তবে ধরলে খবর করে ছাড়ে। প্রথম দু’সপ্তাহ রাগের উপসর্গ বোঝা যায় না। চুপচাপ নির্বিকার থাকে। এরপর শুরু হয় সিমটমের প্রকাশ। আস্তে আস্তে বের হয় রাগ। রাগের পরশে প্রথমে ফুসফুস দূর্বল হয়; দম যায় যায় করে আমাদের। পরে যাবার উপক্রম হয় প্রাণের। এমনি পরিস্থিতিতে অক্সিজেন নিয়ে শোনিম কোনরকম নিজেকে সামলাতে পারে। আমি পারি না! আমার লাগে ভেন্টিলেশন!! প্রথমে আইসোলেশন, পরে ভেন্টিলেশন!!!
(২৬ জুলাই ২০২০, ফেইসবুক পেইজ থেকে নেওয়া)
লেখক : চেয়ারম্যান, সিমেক ফাউন্ডেশন।