অলোক আচার্য: এখন করোনাকাল চলছে। করোনাকালের মধ্যেই দুটো ঈদ চলে গেলো। কোরবানির ঈদের সময় করোনার সাথে সাথে আরেক সমস্যা ছিল বন্যা। করোনার ভেতরেই বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানেই ঘর বাড়িতে পানি রয়েছে। সেই প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেই আমাদের কাটাতে হয়েছে। শুধু মানুষ নয়, গরু, ছাগল হাঁস, মুরগী সবকিছু নিয়ে এক তীব্র দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে বানভাসি মানুষ। আমাদের দেশের মানুষ অসীম সাহসের সাথে এ সময় মোকাবেলা করছে। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষ থেকে মানুষে। অনেক সমস্যার মধ্যেই প্রশান্তি ছড়িয়েছে। এখনও পানিতে বন্দী রয়েছে মানুষের জীবন। থমকে আছে তাদের জীবনযাত্রা। থমকে আছে বললে ভুল হবে। চলছে। জীবন কখনো থেমে থাকে না। কিন্তু এই দুঃসহ সময়টা যেন থমকে আছে। তবুও মানুষ আনন্দে মেতে উঠেছে। কারণ কোনো মহামারীই মানুষের জীবনকে থামিয়ে দিতে পারেনি। করোনাও তা পারবে না। বন্যাদুর্গত মানুষ যে সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে । ঘরের ভেতর পানি, উঠানে পানি সব জায়গায় পানি। শোবার জায়গা নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই (যেহেতু টিউবওয়েলগুলো বন্যার পানির নিচে), খাবার রান্নার জায়গা নেই, বাজার নেই আবার থাকলেও সেখানে যাওয়ার মত অবস্থা নেই, এরকম নানাবিধ সমস্যা নিয়ে থাকতে হচ্ছে বানভাসিদের। এই পরিস্থিতিতে দুর্গতদেও পাশে থাকা আমাদেও জন্য একান্ত আবশ্যক। নিউ নর্মাল এখন মানুষ মেনে নিতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা থাকলেও বাস্তবিকপক্ষে স্বাস্থ্যবিধির বালাই খুব একটা নেই। মাস্ক ব্যবহারের কথা থাকলেও এই স্বাস্থ্যবিধি প্রায়ই চোখে পরে না। আইন মেনে চলার প্রবণতা আমাদের প্রায় নেই বললেই চলে। এ বছর বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পৃথিবীতে একটি মহাসংকট চলছে। চলমান মহামারীতে বিপর্যস্থ পৃথিবী। এ বছর ঈদ অন্যসব বছরের ঈদের থেকে আলাদা। নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়েছে। করোনা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একটু পার্থক্য থাকবে। মনে আনন্দের ছোয়া দিয়ে গেছে। মানুষ মানুষের জন্য। পৃথিবীতে এ এক মহাসত্য বাণী যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে মানুষের পাশে এনে দাড় করিয়েছে। আর আজ যখন মানুষ করোনার মহামারীতে মারা যাচ্ছে তখনো মানুষ মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। লাখ লাখ প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তান্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নয়। তবে একসময় তা শান্ত হবে। এর আগের মহামারীগুলোতে তাই হয়েছে। প্লেগ বা সার্স বা এরকম যত মহামারী এসেছে সবই একসময় চলে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বন্ধ হবে তখন আমরা যে বিশ^ পাবো সেই বিশ^ কেমন হবে? উত্তর হলো সেই বিশ^ও মানবিক হবে। করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে রক্ষা পেতে দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ঘরে থাকাই যে এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র ভালো উপায়। তাই মানুষকে ঘরে থাকতে হবে।
বিশে^র জন্য নভেল করোনা ভাইরাস এক বিরাট ধাক্কা। এই ধাক্কা যে কেবল এই কয়েকদিনেই শেষ হবে তা বলা যায় না। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি দরিদ্র, অসহায় আর খেটে খাওয়া দিনমজুর যারা আজ উপাজর্নহীন জীবন যাপন করেছে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সবাই। বাংলাদেশ,ভারত সব দেশেই দেশের সরকার, প্রতিষ্টান,স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগ সবাই আজ এসব মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- এ কথারই সত্যতা জানান দিচ্ছে। কিন্তু তাতেই সমস্যার শেষ হচ্ছে না। আপাতত সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে মাত্র। করোনা ভাইরাসের প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদী। যার প্রধান শিকার হবে এসব দরিদ্র মানুষই। এসব দরিদ্র মানুষের সাথে আরও দরিদ্র মানুষ যোগ হবে। অর্থ্যাৎ আর মানুষ দরিদ্র হবে।
বেকারত্ব ও দারিদ্রতা ঘিরে ধরছে পৃথিবীকে। উল্লেখযোগ্য হারে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এর প্রভাব পরছে মানুষের জীবন যাপন, ক্রয় ক্ষমতায়। মানুষ বাধ্য হচ্ছে জীবন যাপনের মানে পরিবর্তন আনতে। অনেকেই হয়তো অন্যান্য ঈদের মতো কেনাকাটা করতে পারেনি। কারণ আর্থিক সংকট। করোনায় লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তান্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নয়। তবে একসময় তা শান্ত হবে। জীবন জীবিকা দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা যায় না। কিন্তু এখন সবকিছু চললেও তা অনেকটাই থেমে থেমে। অনেকে যা সঞ্চয় করেছিল তাও কারো কারো শেষ হওয়ার পথে। ফলে ভবিষ্যতে কি হবে তার উত্তর অনেকের কাছেই নেই। সমাজের বিত্তবানরা হতদরিদ্রদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয় যে তা রাতারাতি সবাইকে করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব ঘিরে ধরছে এবং সেই সাথে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। চাকরি হারানোর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যা দারিদ্রতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলছে। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর করোনা যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। করোনাকালে পরিবর্তন হচ্ছে পেশা,জীবন ও জীবিকা। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা অনেকেই চাকরি হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। শহরের জীবন ফেলে ফিরছেন গ্রামের জীবনে। খরচ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক চাকরিজীবির বেতন কমে গেছে বা একেবারেই পাননি।
যারা বাসা ভাড়া করে থাকতো তারা বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে কেবল বাসা ভাড়ার খরচ বাঁচাতে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে। হয়তো তার সন্তান যে স্কুলে পড়ালেখা করতো সেখানে আর তারা পড়তে পারবে না। করোনা ভাইরাস পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। এই প্রভাব পরছে মূলত নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের জীবন যাত্রায়। ফলে মানুষ জীবন যাপন প্রক্রিয়া বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবিদের ক্ষেত্রে চাকরিচুত্যি,কম বেতনে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই যেন করোনাকালে একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর্থিক সংকট মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে। ক্রয় ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে। কিন্তু এই দুঃসময় ঠিক কেটে যাবে। তখন আবার পৃথিবী আগের মতো চলতে শুরু করবে। পুরোনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে।
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
পিবিএ/এইচএস