হুমকির মুখে সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ

ওবায়দুল করিব সম্রাট,কয়রা (খুলনা): কয়েক মাস ধরে বনবিভাগ, কোস্ট গার্ড ও পুলিশের অভিযানে সুন্দরবনের নদী খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকাররত জেলেদের কাছ থেকে বিষের বোতল ও বিষ দিয়ে ধৃত চিংড়ি মাছ সহ ২৮ জন জেলে আটক করে জেল জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানকালে ২০টি নিষিদ্ধ ভেষালি জাল ও মাছ ধরার অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করে র‍্যাব পুলিশ। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে তারপরও থামছে না অসাধু জেলেদের বিষ দিয়ে মাছ শিকার করার প্রবণতা। বিষক্রিয়ায় বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার আজ হুমকির

সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। সূত্রমতে গত একযুগের বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকায় বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলে ও স্থানীয়রা বলেন, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক গডফাদার, আর মহাজন নামক দাদন (কোম্পানী) ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে কোনক্রমে ঠেকানো যাচ্ছে না এই সর্বনাশা মৎস্য শিকার। সিন্ডিকেট চক্র ভাগাভাগি করে লুটে নিচ্ছে মাসে লাখ লাখ টাকা।

এক্ষেত্রে অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারী লুটের মাসোয়ারা ভাগ বাটোয়ারা করে পকেটস্থ করছে। আর বনবিভাগের পদস্থ কর্মকর্তারা ধোয়া তুলশী পাতার মত ছাফাই গেয়ে চলেছেন। তাদের বক্তব্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট, নৌযানের অভাব, সোর্স মানি ও ঝুঁকি ভাতা না থাকায় এবং সর্বপোরি মাষ্টার প্লানের অভাবে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও অভয়ারন্যে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে কথা হয় মানবাধিকার কর্মী ও পরিবেশবাদীদের সাথে। তারা জানিয়েছেন বনবিভাগের উদাসীনতার কারণে এ অপরাধ দমন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষক্রিয়ায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার মাছ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধ্বংসের পাশাপাশি মৎস্য প্রজনন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত সহ অভ্যন্তরীন মৎস্য ভান্ডার শুন্য হচ্ছে। সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব। আর আমরা খাচ্ছি বিষাক্ত খাবার অনুপযোগী মাছ।

আমিষের চাহিদা পূরণের অফুরন্ত এই ভান্ডারের রক্ষনাবেক্ষন এখন সময়ের দাবি। বন বিভাগের সূত্রমতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট সুন্দরবনের স্থলভাগের পরিমান ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ও জলভাগের পরিমানে ২ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার । সুন্দরবন বন বিভাগ পূর্ব ও পশ্চিম এ দুভাগে বিভক্ত। দু’বিভাগে মোট ৪টি রেঞ্জ ও ১৬টি ষ্টেশন রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে ৪ শতাধিক খাল ও ভারানি আছে।

এ সকল খাল ও নদী পরিদর্শন করার জন্য ৭৬টি ফরেষ্ট ক্যাম্প ও ১৭৮ জন বন প্রহরী রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। সুন্দরবন রক্ষনাবেক্ষনের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল ও সরাঞ্জামাদি নেই। তবে বর্তমানে কোষ্টগার্ড, পুলিশ ও র‍্যাব সুন্দরবন সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। আর তাতেও আবার গাত্রদাহ বনবিভাগের। অসংখ্য নদী নালা ও খাল দ্বারা বেষ্টিত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের কয়েকটি এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে পূর্ব বনবিভাগের নীলকমল, হিরন পয়েন্ট, কটকা, কচিখালী এলাকার অংশ বিশেষ। জানা গেছে কয়রা এলাকার কয়েকটি মাছ কোম্পানী চক্র বনবিভাগের সাথে যোগসাজশে জেলেদের কাছ থেকে প্রতি গোনে নির্দিষ্ট মাসোয়ারা আদায় করছে। এই চক্রটি চোরা মাছ শিকারীদেরকে অভয়ারণ্যে মাছ ধরার সুযোগ করে দেয়ায় মাছের প্রজনন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে।

এছাড়া পশ্চিম বনবিভাগের ঝাপসি, ভদ্রা, হাডড়া, চালুবগী, নিষেনখালী, সাহেবখালী, বোটবুড়নিয়া, পাটকোষ্টা, হংশরাজ, পাঠাঘাঠা, ভোমরখালী, আড়–য়া শিবসা, সাচানাংলা সহ প্রভৃতি স্থানে বিষপ্রয়োগে মাছ ধরা চলছে পুরোদমে। এসব এলাকার মধ্যে বেশকিছু নদী ও খাল অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে প্রজনননের কারণে মাছ ধরা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। কিন্তু অসাধু মৎস্য শিকারীরা সুন্দরবনে বিভিন্ন খাল ও নদ নদীতে বিষ প্রয়োগ করে অবাধে নানা প্রজাতির মাছ শিকারের নামে
সর্বনাশা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়রার এক জেলে বলেন, আমরা অনুমতি নিয়ে মাছ ধরতে যাই। কিন্তু অনেক জেলে আছে যারা অনুমতি না নিয়ে বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে টাকা দিয়ে পানিতে বিষ ঢেলে মাছ ধরে।

এতে করে একদিকে যেমন বনের গহীনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে অন্যদিকে বিষ প্রয়োগ করে শিকার করা মাছ খেয়ে মানুষ পেটের পীড়াসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বিষ প্রয়োগকৃত পানি পান করে বাঘ, হরিণসহ বনের নানা প্রাণীও বিভিন্নভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বন বিভাগ
মাঝে মধ্যে এসব মৎস্য দস্যুদের আটক করলেও বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার কোন ভাবেই রোধ
হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ আবু সালেহ বলেন, বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের দায়ে বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে ২৮ জন আটক করে আইনে সোপর্দ করেছে। এ সময় ৫শ কেজি চিংড়ি মাছ জব্দ করা হয়। এ কাজে বন বিভাগের লোক জড়িত কি না, তা খোঁজখবর নিয়ে দেখা হবে।অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...