তাদের কথা কেউ বলেনা !

পিবিএ,স.এম রায়হানুল ইসলাম পলক: দিনটি ছিলো ১৭ এপ্রিল । অন্য সব দিনের মতো ঐ দিনটার ব্যপ্তিও ছিলো ২৪ ঘন্টা । সূর্য উঠেছিলো নিজের মতো করে । বিগত কয়েকদিন ধরে পাহাড়ী রাস্তায় চলে অভ্যাস হয়ে গেছে । সেদিনও পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পাহাড়ী রাস্তা ধরে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর একটি স্থানে। অর্থ্যাৎ, কোনোদিক দিয়েই দিনটি অন্য দিনগুলোর থেকে আলাদা ছিলোনা । কিন্তু সেদিন আমি মুখোমুখি হয়েছিলাম একটি ঘটনার, যেটা আমাকে সাহায্য করেছিলো জীবনের সংজ্ঞায়নে । দিনটি একদিক দিয়ে ছিলো অতি কষ্টের, অন্যভাবে পরম এক প্রাপ্তির । এখন দিনটির কথা মনে পড়লে ভালো লাগে। ঘটনাটা চিনিয়েছে জীবনকে, নিজেকে ও মানুষকে ।

এসএসসি পরীক্ষার পর একদিন মামার ফোন । ঢাকাতে থাকেন । চট্টগ্রাম অঞ্চলের এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে একটি এনজিওতে চাকুরীরত। তিনি ১৪ তারিখ থেকে দশ দিনের অডিট এবং মিটিং পরিচালনা করতে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম যাবেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হলাম যাত্রাসঙ্গী । যাত্রার শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত পুরোটা ছিলো উপভোগ্য । কিন্তু একটা দিন ছিলো বিশেষ একটা শিক্ষা গ্রহণের। নতুন জিনিস দেখছিলাম। পারিপার্শ্বিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছিলাম । ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ; আর উপজাতিদের বৈসাবি । তো সব মিলিয়ে সফরটা ছিলো আমার কৌতুহল মেটানোর জন্য যথেষ্ট মশলাদার।

১৬ এপ্রিল রাঙামাটি থেকে ভাঙাচোরা একটা বাসে আড়াইঘন্টার পাহাড়ী পথের ভেতর দিয়ে । পরের দিন সকাল নয়টায় চাঁদের গাড়ি আসলো । মোট সফর করবো ১৩ জন। যাদের কথা না বললেই নয় শাহীন আংকেল, শওকত আংকেল, অজয় মিত্র শঙ্কু আংকেল , সত্যরঞ্জন চাকমা আংকেল। তারা আমার কাছে এতটাই সম্মানের ও শ্রদ্ধার যে, সর্বনামের ওপর চন্দ্রবিন্দু দিলেও সে সর্বনাম দিয়ে তাঁদের চিহ্নিত করতে পারবোনা । তাদের কারণেই মূলত সফরটা ছিলো অসাধারণ। যাইহোক, খাগড়াছড়ি পুলিশলাইন পার হয়ে প্রথমেই বাধাঁ। কাসালং নদীর ওপরের ব্রীজটা ভাঙা। গাড়ির প্রচন্ড জ্যাম। এই জ্যামই অবশ্য সুযোগ করে দিয়েছিলো নতুন এক অ্যাডভেঞ্চারের। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটি অস্বীকৃত রাস্তা দিয়ে আঁকা বাঁকা দুর্গম পথ ধরে জীবন হাতে নিয়ে চলে গেলাম ব্রীজ অংশ পার করে । তল্লাশির জন্য দীঘিনালা ক্যান্টনমেন্টে গাড়ির সারি । সেখানে আবার দেখা মামার পুরাতন কলিগদের সাথে । যাই হোক সে অন্য কথা । কিছুদিন আগেই পাহাড়ে ব্রাশফায়ারে একজন ইউপি সদস্যসহ মোট নয়জন নিহত হয় । স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক বর্তমান। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাজেকগামী গাড়িগুলোকে নিরাপত্তা দিয়ে পৌছে দেয়; আবার ফিরিয়ে আনে । মাঝেই আবার কাসালং নদীর ধারে মাসালং সাব-ক্যান্টনমেন্টে পুনরায় তল্লাশি হয় । তল্লাশি শেষে পুনরায় যাত্রা শুরু করি। রাস্তায় পেলাম আবার বরিশালের এক নানাকে । ওতো দূর থেকে এসেছে সাজেক দেখার জন্য। মজার ঘটনা এই যে , লোকটা আমার মামা, মামার কলিগদেরও নানা, আবার আমারও নানা। যাই হোক ঘটনায় আস্তে আস্তে অবতীর্ণ হওয়া যাক, কিছু দূর যেতেই দেখতে পেলাম জুম চাষের দৃশ্য । পাহাড়ী ঢালে সব জায়গায় কালো ধোয়া ও ছাই বর্তমান
বোঝায় যায় যে পূর্ববর্তী চাষ শেষে জমিকে পরের চাষের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে । জুম চাষে সাধারণত পাহাড়ী চালের আধিক্য দেখা যায় । চালগুলো খেতেও অসম্ভব সুন্দর। জুম চাষ করে দুর্গম অঞ্চলের এই উপজাতিরাই। তবে মালিকানা অবৈধ। বিষাক্ত মানসিকতার কতিপয় ওপরমহলের লোকজন জায়গা দখল নিয়ে চালায় সম্পদের অপব্যবহার। রাষ্ট্রীয় সম্পদকে পরিণত করে ব্যক্তিগত সম্পদে। জুম চাষের ফলে পাহাড়ের মূল সৌন্দর্য্য নিজের অবস্থানে নেই । তাদের এই অবৈধ কর্মকে আমি বলবো শোষণ। কারণটা আপনারাই বুঝবেন। চাকমা প্রথানুযায়ী ঘরে বাইরে সব কাজ করে নারীরা। পুরুষদের কাজ প্রজন্ম টিকিয়ে রাখা আর বারান্দায় বসে সীম পাতার হুক্কা খাওয়া । যদিও আধুনিকতার ছোঁয়া তাদেরও লেগেছে। পুরুষ চাকমা চাকরি করছে , রাজনীতি করছে , মন্ত্রীও হয়েছে। এমনকি সাবেক প্রধানবিচারপতি এস কে সিনহাও তো একজন উপজাতি ।

যাই হোক, দুর্গম এলাকা যখন অতিক্রম করছি, হঠাৎ একদল উপজাতি শিশু গাড়িগুলো দেখে হাত নাড়াচ্ছে । শুরুতে আমার কাছে বিষয়টা উপভোগ্যই ছিলো । কিন্তু শাহাদাত আংকেলের কাছ থেকে এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। এরা খাবারের আশায় হাত নাড়ায়। আমার কাছে বিষয়টা বেমানান লাগে । একপর্যায়ে মানবজাতিকে বেঈমান মনে হয়। যাইহোক, তখন বাচ্চাদেরকে ভালো করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। আমি ৭১ এর যুদ্ধের শরণার্থী শিবির দেখিনি , দেখার প্রশ্নই ওঠেনা। তবে শুনেছি। বাচ্চাদের অবস্থা আমি বাজি রেখে বলতে পারি তাদের চেয়ে কোনোদিক দিয়েই ভালো নয় । একটি বাচ্চার দেখি হাত-পাগুলো শুকনো কাঠির মতে চিকন, পেট বিশ্রীরকমের ফোলা । পরে মা বলেছিলো যে এটা কৃমির সমস্যা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। তারা আশায় থাকে পর্যটকের ছুড়ে দেওয়া শুকনো খাবারের (সাধারণত বিস্কুট) যেটা তারা পায় পর্যটকদের সাজেক যাওয়া এবং আসার সময়। তাদের মায়েরা কাজ করে ঠিকই , কিন্তু নেই কোনো প্রাপ্তি , পর্যাপ্ততা , সঞ্চয় । ছুড়ে দেওয়া বিস্কুট কারো ভাগ্যে পড়ে কারো পড়েনা। পাহাড়ী ঢাল পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়া তাদের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ ও বেসামাল। এরই মাঝে লক্ষ্য করলাম আরও একটি বিশ্রী দৃশ্য। একটি বাচ্চার এক চোখে রক্ত জমাট বাধা। আমি হয়তো বিষয়টা সুন্দর ও সঠিক মতো উপস্থাপন করতে পারলাম না । বিশ্বাস করুন , আপনি পাষাণ হলেও দৃশ্যটা দেখলে বুকটা কেদেঁ উঠবে । পরে সাজেক পৌছে জানতে পারলাম এরকম ১৫-২০ টা ঘটনা আছে যেখানে চোখে বিস্কুট প্যাকেটের কোণা লেগে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। জীবন এটা তাদের । নেই কোনো পরিবর্তন। পর্যটকদের ফেলনা বিস্কুটই তাদের জীবনের অবলম্বন। তবে সেনাবাহিনীও তাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা করে শুনেছি।

আমাকে হয়তো স্বার্থপর মনে হচ্ছে ?? এত ঘটনা বললাম , আমি কি তাখন কিছু খাবার দিতে পারতাম না? হ্যাঁ, আমি সাহায্য করেছি । আমি বললে ভুল হবে; আমরা সাহায্য করেছি । সাজেক থেকে ফিরে আসার পথে আমাদের স্নাকসের পাঁচবক্স লেক্সাস বিস্কুট তাদের দিয়েছি । কিন্তু এটা কোনো জীবন হতে পারেনা । জীবনের অবস্থান এমন হতে পারেনা । যেদেশে একরাতের ভেতর শেয়ার মার্কেট থেকে হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়, সালমান এফ. রহমানের মতো কোটিপতি আছে, সেদেশে এরকম বিরূপ চিত্র থাকতে পারেনা। পানির সংকট , খাদ্যের সংকট , বস্ত্রের সংকট , নিরাপত্তার সংকট, শিশুরা বিনা চিকিৎসায় থাকে, কে বাচেঁ কে মরে হিসাব নেই , শিক্ষার কথা বাদই দিলাম । জীবন যেখানে টেকেনা শিক্ষা সেখানে বিলাসিতা । মৌলিক চাহিদা , মৌলিক অধিকার এদের কিছুই নেই । নেই কোনো খুঁটি যেটা হবে তাদের বেচেঁ থাকার অবলম্বন । দেড় ঘন্টা হেটেঁ পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়ে কাসালং নদীতে যায় গোছল করতে । একহাড়ি পানিতে গোছল করে , আরেকহাড়ি পানি নিয়ে আসে নিত্য ব্যবহারের জন্য । আমি জীবন কাকে বলে তা শিখেছি ওদের সংগ্রাম দেখে । প্রতিদিন ভাবতাম তাদের কথা , শিখতাম জীবণের মূল্য দিতে । এখনও ভাবি তাদের কথা । বিষ্মিত হই , আমরা মানুষ !! কী আমাদের জীবনের মানে ! জীবণের উদ্দেশ্য কি ! তাদেরও ২০৬ টি হাড়, একটি মাথা, দুটি চোখ, চারটি হাত পা, মন মানসিকতা আছে । আমাদেরও আছে । কোনো পার্থক্য নেই। তবুও তারা আমায় ভাবায় কেনো ? কাদাঁয় কেনো ?

আমি বিশ্বাস করি , এই বৈষম্য একদিন থাকবেনা । তারা পিছিয়ে থাকবেনা । খাবারের অপেক্ষায় থাকবেনা , খাবার পাবে অধিকারবলে। হয়তো কোনো সাংবাদিক বা লেখকের লেখার উদ্দীপকও হবেনা তারা । তাহলে হয়তো সবচেয়ে বেশী খুশি হবো আমি । মানুষ দেখতে যাবে সাজেক । তাদের ভাবনা চিন্তা বা মন খারাপের কারণ হবেনা তারা। দিনটির অপেক্ষায় থাকবো আমি।

লেখক,
এস.এম রায়হানুল ইসলাম পলক।
শিক্ষার্থী, নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ।

আরও পড়ুন...