তালিকা হলেও সহায়তা পায়নি নদী ভাঙা পরিবারগুলো

শাহিনুর ইসলাম প্রান্ত, লালমনিরহাট: তিস্তা আর ধরলার নদীর তীব্র ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করা হলেও এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি পুনর্বাসনের সরকারি সহায়তা। ফলে রাস্তার ধারে ও বাঁধে ঘরবাড়ি ফেলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন লালমনিরহাটের ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো।

জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের উত্তর সীমান্তে রাক্ষুসী ধরলা আর দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে খরস্রোত তিস্তা নদী প্রবাহিত। এ দুই নদী অনেকটাই জেলার সীমানা প্রাচীর তৈরি করেছে। দুই নদীর দুইপাড় ভেঙে প্রতিবছর জেলাকে ছোট করে ফেলছে। জন্মলগ্ন থেকে এ দুই নদী খনন না করায় পালিমাটি আর বালু জমে তলদেশ ভরাট হয়েছে। ফলে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে সামান্য বৃষ্টি আর উজানে ঢেউয়ে লোকালয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। পানি কমতে শুরু করলে নদী তীরে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। শুস্ক মৌসুমে নদীর বুক চিরে অসংখ্য চর জেগে উঠে। ধুধু বালুময় চরাঞ্চলের কয়েক হাজার হেক্টর জমি খরা পুরে সেচের অভাবে অনাবাদি হয়ে পড়ে। এভাবে বন্যা, নদীভাঙন ও খরার মত প্রকৃতিক দুর্যোগের সাথে নিত্য লড়াই করে চলতে হয় এ জনপদের মানুষকে।

প্রতি বছর বন্যা ও নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে জেলার অর্থনীতির চাকা। বন্যার মত প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আগে থেকে খাদ্য সঞ্চয় করে রাখেন নদী তীরবর্তী জনপদের মানুষ। কিন্তু এ বছর করোনা দুর্যোগের কারণে কর্মহীন থাকায় বন্যার জন্য সঞ্চিত খাদ্য বন্যার আগেই শেষ করে ফেলেছেন অনেকেই। এরপরও এ বারে বন্যার স্থায়িত্ব ছিল দীর্ঘ। নদীভাঙনও তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে নদী তীরবর্তী এ জনপদের ছিন্নমূল মানুষগুলো চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

নদীপাড়ের মানুষগুলো জানান, জুন মাসের শেষ দিকে বন্যা শুরু হয়। থেমে থেমে এ বন্যা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়িত্ব ছিল। প্রতিটি বন্যায় ৫/৬ দিন পর্যন্ত পানিবন্দি থাকেন নদীপাড়ের মানুষ। বন্যার পানি কমে গেলেই নদী তীরে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের মুখে স্বপ্নে লালিত ভালবাসার প্রিয় বসতভিটাসহ আবাদি জমি বিলীন হয়েছে। নদীর কড়াল গ্রাসে বিদ্ধস্থ হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম ও স্থাপনা। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো ঘর বাড়ি ভেঙে উঁচু স্থানে বা রাস্তার ধারে সড়াতে পারলেও জমির অভাবে নতুন বাসস্থান নির্মাণ করতে পারছেন না। ফলে রাস্তার ধারে অন্যের বাঁশঝারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাপাড়া মৌজার সিংগিমারী গ্রামটি ঈদ উল আযাহার রাত থেকে মাত্র ৪ দিনের ব্যাবধানে তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। তীব্র ভাঙনে দিশেহারা পরিবারগুলো কেউ কেউ কিছু আসবাবপত্র সড়িয়ে নিতে পারলেও অনেকের ঘরসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তিস্তার স্রোতে ভেসে গেছে। গ্রামটির ৩/৪শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এ গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম জানান, তিনটি ঘরের একটি বিক্রি করে বাকী দুইটি ঘর সড়ানোর খরচ মিটানো হয়। জমি আর প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বাকি ঘর দুইটিও তৈরি করতে পারেননি তিনি। সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত সরকারি সহায়তা পানি বলেও জানান ক্ষতিগ্রস্থ দিনমজুর আজিজুল ইসলাম।

একই গ্রামের এন্তাজ বাউদিয়া ও মোকসেদ আলী জানান, ঈদের আগের রাতে হঠাৎ ভাঙনের মুখে পড়ে তাদের গ্রাম। বন্যার পানি আর জনবল সংকটে দ্রুত ঘর সড়াতে পারেননি। দ্বিগুন ভাড়া দিতে চেয়েও নৌকা পাননি তারা। ফলে চোখের সামনে তাদের একটি করে দুইটি ঘর তিস্তার স্রোতে ভেসে গেছে। বাড়ির কিছু আসবাবপত্র সড়াতে পারলেও জমির অভাবে নতুন করে ঘর তৈরি করতে পারেননি। দ্রুত সরকারি সহায়তা দাবি করেন তারা।

কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের রুদ্বেশ্বর গ্রামের নুর বানু জানান, তিস্তার ভাঙনে তাদের অনেকেই ঘর বাড়ি সড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু জমির অভাবে ঘরগুলো যে যার মত রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছেন। তার ঘরগুলো স্থানীয় কবরস্থানে রেখেছেন। সেই কবরস্থানের একপাশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

নদী ভাঙনে শিকার পরিবারগুলো আর্থিক সংকটের কারণে চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীর কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়ি করার জমি মেলাতে চরা দামে কেউ কেউ ভাড়ায় জমি নিয়ে বাড়ি করছেন। অনেক সময় জমি মিলাতে পারলেও তা নিচু এবং বাড়ির করার উপযুক্ত করতে মাটি ভরাট করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নদীপাড়ে বর্ষাকালে শুকনো মাটি মেলানো বড়ই কঠিন। ফলে বোমা মেশিনে বালু উত্তোলন করতে হচ্ছে। যা আইনত অপরাধ হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে রাতের আঁধারে মেশিন চালাতে তাদের মোটা অংকে টাকা গুনতে হচ্ছে। সব মিলে দুঃখ যেন শুধু নদীপাড়ের মানুষদের।

জেলা ত্রাণ ও পুনবাসন কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার শাম্মী কায়সার বলেন, গত অর্থ বছরের বরাদ্ধ থেকে নদীভাঙনের শিকার ৪৬টি পরিবারকে পরিবার প্রতি ৭ হাজার টাকা করে পুনর্বাসনের সহায়তা করা হয়েছে। নতুন করে ৭৩০টি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে পুনবাসনের জন্য টিন/নগদ অর্থ বরাদ্ধ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বরাদ্ধ এলে বিতরণ করা হবে।

পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...