হোসেনী দালাল চত্বরে অবরুদ্ধ তাজিয়া মিছিল

পিবিএ,ঢাকা: কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) মহামারীর কারণে এবার আশুরার দিন শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল হয়েছে হোসেনী দালান চত্বরের ভেতরই। চার দেয়ালের ভেতরে ঐতিহ্যবাহী এ মিছিল অবরুদ্ধ থাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষ এতে অংশ নিতে পারেননি। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান।

আশুরার তাজিয়া মিছিল সড়কে বের না করার জন্য আগে থেকেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল পুলিশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের চত্বরেই মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয় হোসেনী দালান ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য সময় তাজিয়া মিছিল হোসেনী দালান থেকে বের হয়ে বকশিবাজার, উর্দ্দুরোড, লালবাগ চৌরাস্তা, ঘোড়া শহীদের মাজার, আজিমপুর, নিউমার্কেট হয়ে ঝিগাতলা (ধানমন্ডি লেকের কাছে) গিয়ে শেষ হয়।

মিছিলে অংশ নিতে রোববার (৩০ আগস্ট) সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা আসতে থাকেন হোসেনী দালান প্রাঙ্গণে। চলতে থাকে মিছিলের প্রস্তুতি।

সকাল থেকেই হোসেনী দালাল চত্বরে প্রবেশের জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একজন একজনকে পরীক্ষা করে আর্চওয়ের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করিয়েছেন। হোসেনী দালাল চত্বরের ভেতরেও অবস্থান নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ঠিক সকাল ১০টায় দক্ষিণ দিকের গেইটের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। মিছিল একটু এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ছিল। মূলত ঘণ্টা, ঢোলের শব্দ নিয়ে যে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট চত্বরটিতে। বেলা ১১টা দিকে ইমামবাড়ার উত্তর পাশে গিয়ে শেষ হয় মিছিল।

মিছিলে অংশ নেয় বিপুল সংখ্যক নারী। এসেছিল শিশুরাও। তরুণরা ছিল কালো কাবুলি-পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরা, তরুণীদের গায়ে ছিল কালো সালোয়ার কামিজ।

কালো-লাল-সবুজের নিশান উড়িয়ে, কারবালার শোকের মাতম ওঠে হাজার হাজার মানুষের মিছিলে। মাঝে মাঝেই বুক চাপড়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ মাতম ধ্বনি উঠছিল মিছিল থেকে, সবার পা ছিল খালি। মিছিলে ছিল ‘বৈল দল (ঘণ্টা পড়া তরুণ)’। কেউবা পড়েছে নওহা (শোকগীতি)।

মিছিলে ছিল কালো কাপড়ের ইমাম হোসেন (র.) এর তাজিয়া (প্রতীকী কবর)। মিছিলের শেষের দিকে সুদৃশ্য বড় আরেকটি তাজিয়া। নারী-পুরুষ শিশুদের হাতে অসংখ্য কালো, লাল ও সবুজ নিশান। তরুণদের (ভেস্তা) হাতে হাতে বিচিত্র আলাম (দীর্ঘ লাঠির মাথায় পতাকা)।

একটি ঘোড়াকে ইমাম হোসেনকে বহনকারী ঘোড়া দুলদুলের প্রতীক হিসেবে সাজানো হয়। দুধ-ছোলা দিয়ে পা ধোয়ানো হয় ঘোড়ার, পড়ানো হয় সুদৃশ্য জিন (বসার আসন) ও মাথার খাপ। দুধ দিয়ে ঘোড়ার পা ধোয়াতে দেখা গেছে। মিছিলের মাথা খানিকটা সামনে গেলে দক্ষিণ দিকের গেইটের সামনেই আনা হয় সেই ঘোড়াটিকে। সেই চত্বরটি দুধে ভেসে গেছে। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা ঘোড়ার পা ধোয়ানো দুধ পবিত্র হিসেবে আরোগ্য কামনায় শরীরে মাখে ও ব্যবহার করে।

স্থান স্বল্পতার জন্য এবার মিছিলে আলাম, নিশান, কালাপাহাড়সহ (ছোট তাজিয়া) অন্যান্য উপকরণ অনেক কম ছিল বলে জানিয়েছেন ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ।

মিছিলের এক পর্যায়ে হোসেনী দালান ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধায়ক এম এম ফিরোজ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এবার করোনায় জর্জরিত। আমাদের যে তাজিয়া মিছিলের ৪০০ বছরের ঐতিহ্য সেখানে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি করোনার কারণে। এবার আমরা আশুরার মিছিল ভেতরেই করছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি আগামীতে সেই পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে যাব ইনশাআল্লাহ। তাজিয়া মিছিলে যা থাকে এবার তার সবকিছুই এবার আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমরা সবকিছু করার চেষ্টা করছি।’

কল্যাণপুর থেকে মিছিলে এসেছেন সৈয়দ আহলে বাইতে নেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘ইমাম হোসেন অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। ন্যায়ের জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন। সারা পৃথিবীর মানুষ তার আত্মদানের এই দিকটিকে স্মরণ করে। আমরাও তাকে স্মরণ করি। তার প্রতি শ্রদ্ধা থেকে আমিও প্রতি বছর মিছিলে আসি।’

কামরাঙ্গীচর থেকে ৬ বছরের ছেলে আশিকুর রহমানকে নিয়ে এসেছেন পিতা মো. মিলন। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে মিছিলে ছিলেন তিনি। মিলন বলেন, ‘আমরা ৪ মেয়ের পর এই ছেলে হয়েছে। এই ছেলে হওয়ার পর থেকেই আমি তাকে নিয়ে তাজিয়া মিছিলে আসি।’

পুরনো ঢাকার সাত রওজা এলাকা থেকে এসেছেন জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘ইমাম হোসেন অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে নিজ জীবন দিয়ে ওই সময়ে ইসলামের পরিপূর্ণতা এনেছেন। আমার জীবন যতদিন থাকবে আমি ততদিন তাজিয়া মিছিলে আসব।’

মিছিলে আসা অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক। বিপুল সংখ্যক মানুষের কারণে স্বাস্থ্যবিধিরও খুব একটা বালাই ছিল না।

চত্বর পূর্ণ হয়ে গেলে সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তখন গেইটের সামনে ভিড় জমে গিয়েছিল। র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা সামনে থেকে লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

ভেস্তা দলের অনেক তরুণ বাইরে ছিলেন। অনেকে বড় বড় আলাম নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রাস্তায়। তারা ভেতরে প্রবেশ করে মিছিলে অংশ নিতে পারেনি। মূল গেইটের সামনে আরিফুল ইসলাম নামের একজন তরুণ বলেন, ‘আমি ভেস্তা, আমি ঢুকতে পারিনি। ভেস্তা যদি ঢুকতে না পারে কীভাবে হবে। ভেতরে অনেক অপ্রয়োজনীয় মানুষ ঢুকে গেছে।’

প্রধান মিছিলের পর হয় ফাঁকা শিকানি। সকাল থেকে অনাহারী থাকার পর এর মাধ্যমে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ খাওয়া-দাওয়া করেন।

কারবালা প্রান্তরের নারী ও শিশুদের অসহায় অবস্থার স্মৃতিতে রোববার সন্ধ্যার পর হোসেনী দালানে হবে শামে গরিবা (অসহায়দের সন্ধ্যা)। শামে গরিবার সময় দালানের সব সাজসজ্জা সরিয়ে ফেলা হয়। নিভিয়ে দেয়া হয় আলো, মেঝেতে থাকে না কোনো বিছানা বা ফরাশ। এ অবস্থায় চলে বয়ান ও মাতম।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...