স্বপ্নীল রায়: আত্মহত্যা কোনো সমাধান না হলেও সারা বিশ্বেই কম-বেশি আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। তবে ব্যক্তি ও পরিস্থিতি ভেদে আত্মহত্যার কারণ ভিন্ন। কেউ সবকিছু পেয়ে আত্মহত্যা করছে আবার কেউ কিছু না পাওয়ার ক্ষোভে আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তি এমন এক মানসিক অবস্থা পৌছে যায় যখন সে বাস্তব যুক্তিতর্কের বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে আত্নহত্যা করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এর ভেতর উন্নত দেশেও আত্নহত্যা প্রবণতা রয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্নহত্যা বিরোধী দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর সারা বিশে^ যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ আত্মহত্যা । সংস্থাটির মতে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্নহত্যার পথ বেছে নেন।
অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন। এবং অগণিত মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সংস্থাটির আশংকা মতে, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি বছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্নঘাতী হবেন। বাংলাদেশে আত্মহত্যা করার পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ রয়েছে। পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব এবং দুরত্ব তৈরি হওয়া, প্রেমে ব্যার্থতা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করা, কাঙ্খিত জিনিস না পাওয়া, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে, ঋণ থেকে মুক্তি পেতে, মানসিক সমস্যাজনিত কারণে, মাদক দ্রব্যে আসক্ত হলে ইত্যাদি আরও অনেক ছোট-বড় বহু কারণ রয়েছে। যে সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত সহজ সে সমস্যার জন্যও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে যে কারণেই আত্মহত্যা করুক না কেন তা কোনভাবেই কাম্য নয়। আবার শুধুমাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করে তা থেকে বেঁচে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি।
আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধীতে পরিণত হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছেলে বা মেয়ে যদি কোন কারণে আত্মহত্যা করে তার থেকে দুঃখের আর কোন কিছু হতে পারে না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আত্মহত্যা একটি মহাপাপ। নিজের জীবন শেষ করার ভেতর কোন সমাধান লুকিয়ে নেই। আজকাল অনেকেই রীতিমত ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করছে অনেকে। প্রশ্ন হলো আমাদের এই প্রজন্মের এইসব মেধাবী ছেলে মেয়েরা যদি আত্মহত্যার মত অপ্রত্যাশিত অপরিমাণদর্শী চিন্তাভাবনার পথ বেছে নেয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আমরা কোথায় দাড়াব।
প্রতি বছর বহু প্রাণ আত্মহত্যার কারণে ঝরে যায়। পত্রিকায় দেখে তার একটা হিসাব করা হয়। কিন্তু আলোচিত ঘটনা ছাড়া তা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এক জরিপ অনুযায়ী আত্মহত্যায় বাংলাশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪ তম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। যা ২০১৭ সালে ছিল ১০ হাজারের কিছু বেশি।
এদেশে প্রতি লাখে সাত দশমিক আট জন মানুষ আত্মহত্যা করে। ২০১৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম যা ২০১১ সালে ছিল ৩৮ তম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রবণ বেশিরভাগই ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী। তাছাড়া বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৪ সালে ১৪৫ জন শিশু আত্মহত্যা করে। গড়ে প্রতিমাসে যা ছিল ১২ জন। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ২২৮ জনে। এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দাড়ায় আত্মহত্যা একটি ব্যাধী হয়ে ইতিমধ্যেই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। যার থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক ভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাধান কোথায়? কিভাবে এই সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। তারপর সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। জীবনে হতাশ হওয়ার যেমন কারণ রয়েছে তেমনি জীবনকে ভালোবাসার মতো কারণও রয়েছে প্রচুর। বর্তমান সমাজে হতাশা নামক ব্যধি খুব সহজেই মানুষের মনে বাসা বাঁধছে। এই হতাশা কাটাতেই অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
পারিবারিক বন্ধন হালকা হওয়ার সাথে সাথে এসব হতাশ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সামাজিক অস্থিতিশীলতা, চাকরির বাজারের অস্থিরতা,সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের অভাব,ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধের অনুপস্থিতি,মাদকদ্রব্যের বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়া,সন্তানের বেড়ে ওঠায় একাকিত্ব এসব কিছুই তার ব্যক্তির জীবনের ওপর শ্রদ্ধাবোধ আলগা করতে ভূমিকা রাখে। জীবনকে ভালোবাসার চেয়ে ভালো আর কোনো কিছুই হতে পারে না। প্রথমে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হবে। কোনো চাহিদা পূরণ না হলেও জীবন শেষ না করে বরং নতুন করে আবার শুরু করা যায়-এমন অনুভূতিই পারে আত্মহত্যার এ মিছিল থামাতে।
লেখক: স্বপ্নীল রায়
শিক্ষক ও সাংবাদিক
পাবনা