পিবিএ,সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরাসহ উপকূলের দিকে প্রচন্ড দাপটে ধেয়ে আসছে সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্পান । উপকূলবাসিকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে যাওয়ার জন্য বার বার আহ্বান জানানো হচ্ছে। আবহাওয়া বার্তা দিয়ে মানুষকে সতর্ক করা হচ্ছে। উপকূলের পরিস্থিতি জানতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব এবং মোবাইল ফোনে কান পেতে ছিলেন গোটা দেশবাসি। খবর জানাচ্ছিলেন চিপছিপে গড়নের এক কিশোর এস এম শাহিন আলম।
আম্পানের খবর জানাতে দুর্বার গতিতে সে দাপিয়ে বেড়িয়েছে উপকূল থেকে উপকূলে। কখনও গলা পানিতে নেমে আবার কখনও অশান্ত কপোতাক্ষ অথবা খোলপেটুয়া নদীর উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে উপকূলের মানুষের জন্য খাবার অথবা ত্রাণ সমাগ্রী নিয়ে ছুটেছেন। প্রবল গ্রাসি ঘূর্ণিঘড় আম্পানের পর এমন দৃশ্যের সাথে পরিচিত হয়েছে সাতক্ষীরা এবং খুলনা কয়রা উপকূলের অনেক মানুষ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এখন জোয়ার-ভাটা চলছে সাতক্ষীরার আশাশুনির প্রতাপনগর এবং খুলনার কয়রার বেদকাশিতে।
কয়রা উপজেলার কাটমারচর এমন একটি দুর্গম এলাকা যেখানে চারিদিকে পানি আর পানি। এমন পানিবন্দি জায়গার মাঝখানে একটি ঘর। ঘরটি ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। ঘরটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে কেউ থাকতে পারে। তবুও কৌতুহল মেটাতে সেখানে যেয়ে দেখা গেল ঘরের মধ্যে ছয়-সাতজনের একটি পরিবার। তবে আশ্চর্যের বিষয় সেখানে একজন গর্ভবতী নারীও আছেন। তার হাত, পা প্রচন্ড ফোলা এবং খুবই অসুস্থ। যে যেকোন সময় তার প্রসব বেদনা উঠতে পারে। এমন পানিবন্দি পরিবেশ আশেপাশে অন্য কোন মানুষ নেই। ধারে কাছে কোন আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় এবং ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় গর্ভবতী ওই নারীকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে পারেনি পরিবারটি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন নারী-শিশু বৃদ্ধসহ গর্ভবতী নারীও।তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন এই শাহিন।
শুধু গর্ভবতী নারী ও পানিবন্দী পরিবারটির ব্যাপারে নয়। বরং এমন অসংখ্য পরিবারের পাশে অসময়ে বন্ধু হয়ে দাঁড়ানো এক তরুণ এই শাহিন। কাউকে অতিক্রম করে নয় বরং ব্যাতিক্রম কিছু করতে চাওয়া সেই তরুণের নাম এসএম শাহিন আলম। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার এস এম শহিদল্লাহ ও জাহানারা খানম দম্পতির সন্তান এই শাহিন।
উপকূলীয় এলাকায় জন্মগ্রহণ করায় শাহিন খুব কাছ থেকে দেখেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রাম। উপকূলের বেশিরভাগ মানুষের দিনের শুরু হয় পানির সাথে। পানির সাথে তাদের নিবিড় বন্ধুত্ব। এই পানি আর সুন্দরবন যে তাদের আয়ের প্রধানতম উৎস। তবে হতাশার বিষয় হচ্ছে যেখানে চারিদিকে পানি আর পানি সেখানে নেই নিরাপদ খাওয়ার পানি।
সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি, কাকড়া, কুচিয়াসহ অসংখ্য সম্ভাবনাময়ী শিল্প যেখানে প্রতিনিয়ত হাতছানি দেয় সেখানে নেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আবার অভাবের তাড়নায় এলাকার শিশুদের ঝরে পড়া, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা, পুষ্টিকর খাবারের অভাব বরাবরই কাছ থেকে দেখেছেন শাহিন আলম। এজন্য নিজের জন্মস্থান অবহেলিত এই উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য বরাবরই কিছু করতে চেয়েছেন।
ইচ্ছাটা অনেক দিন আগের। ২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা উপকূল বিদ্ধস্ত করে দিয়ে যায় তখন শাহিনের বয়স মাত্র ৮ বছর। প্রকৃতিক দুর্যোগের পর উপকূলের মানুষ যে কতোটা দুর্বিষহ জীবন-যাপন করে তা তখন খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
সে সময়ের কথা স্মরণ করে এস এম শাহিন আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। সেসময় খুব কাছ থেকে দেখেছি উপকূলের মানুষকে কতোটা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। আইলা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন আমরা ঘরের মধ্যে মাচা করে তার উপর থাকতাম। জোয়ারের সময় ঘরে পানি ঢুকতো। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। খাবার কিছু ছিলো না। আমাদের এই দ্বীপে যখনই কোন ট্রলার আসতো আমি ছুটে যেতাম ভাবতাম এই বুঝি কেউ আমাদের জন্য কিছু নিয়ে এলো।
তিনি আরো বলেন, সে সময় সবচেয়ে কষ্টের বিষয় ছিল, বিভিন্ন সময়ে ট্রলারে করে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলবাসীর জন্য ত্রাণ নিয়ে আসতো। কিন্তু এই ত্রাণের সবই থাকতো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য। আমাদের শিশুদের জন্য আলাদা করে কেউ কিছু নিয়ে আসতো না। এই বিষয়টি সব সময় আমাকে কষ্ট দিতো। আমি তখন থেকেই ভাবতাম উপকূলের অবহেলিত শিশুদের জন্য কিছু করা দরকার।
অদম্য ইচ্ছা থাকলে সবকিছু না হলেও অনেক কিছু যে করা যায় প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ রেখে চলেছেন সদ্য যৌবনে পা রাখা এই তরুণ। ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি, ‘বুলবুল’ এর সময়েও দাঁড়িয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে। আর কয়েকদিন আগে প্রলয় তান্ডব চালিয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর আগে থেকে এখনো পর্যন্ত নিরলস কাজ করে চলেছেন।
উপকূলের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য খাবার এবং নিরাপদ পানির ব্যাবস্থা করেছেন। শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার এবং খেলনা সামগ্রী নিয়ে হাজির হয়েছেন। গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। স্যানিটারী ন্যাপকিন পৌছে দিয়েছেন উপকূলের অবহেলিত কিশোরীদের কাছে। করোনার এই প্রাদুর্ভাবে মানুষকে সচেতন করতে বারবার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য কাজ করেছেন। সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করেছেন উপকূলের মানুষের মাঝে।
শাহিনের সবচেয়ে শক্তির জায়গা তার ফটোগ্রাফি। তার প্রতিটি ছবিই যেন কথা বলে। শাহিন শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয়। সবসময় উপকূলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরেন ছবির মাধ্যমে। যেসব ঝুকিপূর্ণ এলাকায় সচারচার গণমাধ্যমকর্মীরা যেতে পারে না সেসব জায়গাতে গিয়েও নিয়মিত ফেইসবুক লাইভে এসে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন উপকূলের মানুষের কষ্টের কথা। মূলত তার এই ছবি আর লাইভ দেখেই দেশ-বিদেশের অনেক বিত্তবান মানুষ ও সংগঠন উপকূলবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে। এরকম বিভিন্ন ব্যাক্তি ও সংগঠনের সহযোগিতায় শাহিন প্রায় সাত লক্ষাধিক টাকার বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছে দিয়েছেন উপকূলের মানুষের কাছে।
আত্মতৃপ্তির কথা উল্লেখ করে এসএম শাহিন আলম বলেন, আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি সবথেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই উপকূলে আবার সবচেয়ে বেশি আনন্দও পেয়েছি এই উপকূলে। যখন ট্রলারে করে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ায়, অবহেলিত শিশুদের জন্য কিছু করতে পারি তখন যে ভালোলাগা কাজ করে পৃথিবীর আর কোথাও সে ভালো লাগা খুঁজে পায়নি। উপকূলের শিশুদের মুখে হাসি ফুঁটাতে পারলে প্রাণটা ভরে যায়। নিজেকে সফল মনে হয়।
অসংখ্য প্রতিভার অধিকারী শাহিন শুধু উপকূলবাসীর জন্য কাজ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন লেখাপড়া। বর্তমানে সে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুকাল থেকেই জড়িত আছেন সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সাথে। তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডি নিউজ ২৪.কমের ‘হ্যালো’র মাধ্যমে। ‘ইউনিসেফ’-এর শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে সাতক্ষীরার কয়েকটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কাজ করছেন। নিয়মিত তুলে ধরছেন উপকূলবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথা। উপস্থাপনাও করেন দারুন। উপকূলের বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরছেন নিয়মিত।
তার প্রত্যেকটি ছবিই জীবন্ত। প্রত্যেকটি ছবি, ভিডিও নতুন করে উপকূলের সাথে মানুষের পরিচয় করিয়ে দেয়। উপকূলের মানুষ যে কতোটা সংগ্রাম করে দিন কাটায় তা মনে করিয়ে দেয়। সম্প্রতি শাহীন আলমকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে।
আঠারো যে মাথা নোয়াবার নয় তা বারবার প্রমাণ করে চলা শাহীন আলমের ইচ্ছা উপকূলের জন্য টেকসই কিছু করার। বারবার প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত হওয়া উপকূলবাসীকে যেন প্রতি দুর্যোগে ঘর ছেড়ে যেতে না হয়। অন্যের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। শিশুরা যেন ঝরে না পড়ে, তাদের ভবিষৎ যেন সুন্দর হয় এমনটাই চাওয়া শাহিনের। তার চাওয়া সকলের বাসযোগ্য নিরাপদ উপকূল।
পিবিএ/এস,এম,হাবিবুল হাসান/এসডি