ইসলাম মানুষকে কর্মোদ্যমী হতে শেখায় এবং বৈধ পথে উপার্জনের নির্দেশ দেয়। এ জন্য ইসলামের প্রথম যুগে দেখা গেছে একজন আশ্রয়হীন সাহাবি অন্যের অনুগ্রহ গ্রহণ না করে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রত্যয় করেন এবং সফল হন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) মদিনায় এলে নবী (সা.) তাঁর এবং সাদ ইবনে রাবি আনসারি (রা.)-এর মধ্যে ভ্রাতৃবন্ধন গড়ে দিলেন। এ আনসারির দুজন স্ত্রী ছিল। সাদ (রা.) আবদুর রহমান (রা.)-কে নিবেদন করলেন, আপনি আমার একজন স্ত্রী এবং সম্পদের অর্ধেক নিন। তিনি জবাবে বলেন, আল্লাহ আপনার স্ত্রী ও সম্পদে বরকত দিন। আপনি আমাকে বাজার দেখিয়ে দিন। এরপর তিনি বাজারে গিয়ে পনির ও মাখনের ব্যবসা করে লাভবান হলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৭২)
ইসলামের দৃষ্টিতে পার্থিব কর্মকাণ্ড
ইসলাম মুমিনদের পার্থিব জীবন থেকে বিমুখ হতে বলেনি; বরং সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবন-জীবিকা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে পরকালের আবাস অনুসন্ধান করো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৭)
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘পৃথিবীতে আল্লাহ যেসব খাদ্য, পানীয়, পোশাক, বাসস্থান, স্ত্রী-সন্তান বৈধ করেছেন তা থেকে বিমুখ হয়ো না। কেননা তোমার ওপর অধিকার রয়েছে তোমার প্রতিপালকের, তোমার নিজের, তোমার পরিবার ও তোমার প্রতিবেশীর। সুতরাং প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করো।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘অংশ ভুলে না যাওয়ার অর্থ হলো হালাল জিনিস উপভোগ করা, তা প্রত্যাশা করা ও পার্থিব জীবনের পরিণতির ব্যাপারে তুমি অমনোযোগী হয়ো না।’ (আত-তাসহিল লি-তাবিলিত তানজিল, পৃষ্ঠা ২০৬)
জীবিকার সন্ধানও ইবাদত
মুমিনের জীবন-জীবিকার সন্ধানও ইবাদত নিয়ত পরিশুদ্ধ হয় এবং সে শরিয়তের নির্দেশনা মান্য করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তি যদি তার ছোট সন্তানের জন্য জীবিকার সন্ধানে বের হয় তবে তা আল্লাহর পথে, যদি সে তার বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য জীবিকার সন্ধানে বের হয় তবে তা আল্লাহর পথে, যদি সে নিজের জন্য জীবিকার সন্ধান করে—যা তাকে পাপমুক্ত রাখবে তা আল্লাহর পথে, আর যদি সে লৌকিকতা ও অহংকার প্রকাশের জন্য বের হয় তবে তা শয়তানের পথে।’ (জামিউস সগির, হাদিস : ১৪২৮)
ধর্ম জীবন-জীবিকার পথে বাধা নয়
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘উকাজ, মাজান্না ও জুল-মাজাজ জাহেলি যুগের বাজার ছিল, ইসলাম আবির্ভাবের পর লোকেরা এসব জায়গায় ব্যবসা করা গুনাহের কাজ মনে করল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন, ‘তোমাদের ওপর কোনো গুনাহ নাই তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ অনুসন্ধানে। অর্থাৎ হজের মওসুমে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৯৮)
বৈধ কাজে গ্লানি নেই
ইসলাম কোনো বৈধ কাজকে ছোট করে দেখে না। তাই মুমিন কোনো বৈধ কাজে গ্লানি বোধ করে না। যদি না তা দ্বিন পালনে প্রতিবন্ধক হয়। উকবা ইবনু আমির (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমার রব সে ব্যক্তির ওপর খুশি হন যে পাহাড়ের উচ্চ শৃঙ্গে বকরি চরায় এবং নামাজের সময় আজান দেয় ও নামাজ আদায় করে। আল্লাহ তাআলা বলেন : তোমরা আমার এ বান্দাকে দেখো, সে আজান দিচ্ছে, নামাজ কায়েম করছে ও আমাকে ভয় করছে। আমি আমার এ বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালাম।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৬৬৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, উত্তম উপার্জন কোনটি? তিনি বলেন, ‘পবিত্র ব্যবসা এবং ব্যক্তির হাতের উপার্জন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৫২৭৬)
দুনিয়াবিমুখতার অর্থ
কোরআনের একাধিক আয়াত ও হাদিসে মুমিনদের দুনিয়াবিমুখতার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন—রাসুলুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়া ও তার মধ্যের সব কিছুই অভিশপ্ত, কিন্তু আল্লাহ তাআলার জিকির ও তাঁর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অন্যান্য আমল, আলেম ও ইলম অন্বেষণকারী এর ব্যতিক্রম।’ (সুনানে তিরমিজি, আয়াত : ২৩২২)
মুসলিম পণ্ডিত ও গবেষকরা বলেন, এমন আয়াত ও হাদিস তাদের জন্য প্রযোজ্য, পার্থিব জীবন যাদের দ্বিনি কাজে প্রতিবন্ধক হয়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে ব্যক্তির কাছে এক লাখ মুদ্রা রয়েছে সে কি জাহেদ (দুনিয়াবিমুখ) হতে পারে? তিনি বলেন, হ্যাঁ, যদি বৃদ্ধি পেলে সে খুশি না হয় এবং তা কমে গেলে সে দুঃখিত না হয়। (ফয়জুল কাদিরস : ৪/৯৪)
পবিত্র কোরআনে এমন ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘তারা এমন ব্যক্তি ব্যবসা ও বেচাকেনা যাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে না।’ (সুরা নূর, আয়াত : ৩৭)
মাতারুল ওররাক সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বলেন, ‘তারা বেচাকেনা করত। কিন্তু যখন তাদের কেউ আজান শুনত তাদের হাতে দাঁড়িপাল্লা থাকলে তা নামিয়ে রাখত এবং নামাজে চলে যেত।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১০/২৫২)
প্রাচুর্য এলে মুমিন আল্লাহমুখী হয়
যখন কোনো মুমিনের হাতে অর্থ-সম্পদ আসে, তখন সে আরো বেশি আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হয়। বিশেষত আল্লাহ সম্পদশালী মুমিনের জন্য যেসব বিশেষ বিধান দিয়েছেন তা পালন করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করে আল্লাহ তার জন্য তা বহু গুণে বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন। আর তাঁর দিকেই তোমরা প্রত্যানিত হবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৪৫)
আল্লাহ সবাইকে উত্তম জীবন ও জীবিকা দান করুন। আমিন।