ডিজিটাল প্রতারণা

‘ভাঙ্গা পার্টি’ যেভাবে তটস্থ রাখে বিকাশ-ক্রেডিট কার্ড-অনলাইন লেনদেন জগৎকে

দুজন যুবক গ্রামের একটি নির্জন স্থানে বসে একের পর এক মানুষকে বিভিন্ন ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি সেজে ফোন করছে। তারপর গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তারা মূলত প্রতারণার মাধ্যমে ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের অর্থ আত্মসাৎ করছিল।

নেটফ্লিক্সের একটি ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘জমতারা’ যারা দেখেছেন, তাদের কাছে দৃশ্যটি পরিচিত লাগার কথা। সিরিজটির প্রথম পর্বের প্রথম দৃশ্যই ছিল এমন।

ঢাকার পুলিশ বলছে, বাংলাদেশেই রয়েছে এমন কিছু গ্রাম যেগুলোতে পাওয়া যাবে হুবহু জমতারার এই দৃশ্যপট।

মূলত ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা, পার্শ্ববর্তী রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি এবং মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কিছু গ্রামের কথা জানাচ্ছে পুলিশ, যেখানকার অনেক অধিবাসীরা পুলিশের ভাষায় ‘এভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়াকে অপরাধ বলেই মনে করেন না’। ঢাকায় পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে এদের কোডনেম ‘ভাঙ্গা পার্টি’।

ঢাকার সাতটি মামলার সাথে ‘ভাঙ্গা পার্টি’র সম্পর্ক:
ঢাকার নিম্ন আদালতে একটি মামলা এখন বিচারাধীন, যে মামলাটির ভিকটিম গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শিকার হয়েছিলেন ‘বিকাশ প্রতারণা’র। ভিকটিম একজন কলেজ ছাত্রী। মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে, একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি টেলিফোনে প্রতারণার মাধ্যমে ছাত্রীটির বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে কমপক্ষে তেত্রিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

পুলিশ বলছে, অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযুক্তদের অবস্থান জানার চেষ্টা করা হয়।

মামলা করার পর পুলিশ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দুজন ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তার করে। দেখা যায় দুজন ব্যক্তির বাড়িই ঢাকা থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরবর্তী ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার একটি গ্রামে।

ঢাকার বিভিন্ন থানায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে দায়ের হওয়ায় অন্তত সাতটি ডিজিটাল প্রতারণা মামলার নথি পড়বার সুযোগ হয়েছে আমার। এর মধ্যে পাঁচটি ছিল বিকাশের অর্থ হাতিয়ে নেবার এবং দুটি ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের অর্থ হাতিয়ে নেবার অভিযোগ।

প্রতিটি মামলাতেই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে হয় অভিযুক্তদের ধরা হয়েছে নয়তো অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে বিকাশ প্রতারণাগুলোর সাথে জড়িতদের সবারই বাড়ি মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। আর ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার মামলাগুলোর আসামীরা ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলছেন, এ ধরণের অভিযোগ যখনই তারা পান, তখনই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অভিযুক্তদের অবস্থান চিহ্নিত করেন তারা।

মি. ইসলাম বলছেন, ২০১৬ সালে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স-ন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অধীনে এই বিভাগটি গঠনের পর থেকে এ ধরণের যত অভিযোগ এসেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ভাঙ্গা পার্টি’র সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

এই অভিযুক্তদেরকে ‘ভাঙ্গা পার্টি’ বলে বর্ণনা করছিলেন মি. ইসলাম।

টোপ পার্টি এবং ওয়েলকাম পার্টি:
যদিও এই অভিযুক্তদের ভাঙ্গা পার্টি বলে উল্লেখ করছেন ঢাকার কর্মকর্তারা, কিন্তু পুলিশ বলছে, মূলত ফরিদপুরের দুটি উপজেলায় এবং সংলগ্ন মাগুরা এবং রাজবাড়ির কিছু গ্রামজুড়ে এদের কার্যক্রম বিস্তৃত।

পুলিশের নথি থেকে জানা যাচ্ছে, ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এবং মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বহু মানুষ ডিজিটাল প্রতারণাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে।

পুলিশ বলছে, এদের মধ্যে ভাঙ্গার আজিমনগরে যারা কাজ করে, তারা বেশি ‘স্মার্ট’। তারা স্মার্টফোনে এমন কিছু অ্যাপ ব্যবহার করতে পারদর্শী, যেগুলো দিয়ে মোবাইলের কলার আইডি গোপন রাখা বা বদলে ফেলা যায়। এভাবে তারা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড-ডেবিট কার্ড কিংবা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা তথ্য পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে বলে উদাহরণ আছে।

তবে এরা সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করে বিভিন্ন পুরষ্কারের লোভ দেখিয়ে। স্থানীয়ভাবে এরা ‘ওয়েলকাম পার্টি’ বলেও পরিচিত।

আপনি যদি আপনার মোবাইলে কখনো মেসেজ বা অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোন পেয়ে থাকেন যেখানে আপনাকে বলা হচ্ছে, ‘আপনি ৫০ লাখ টাকা লটারি জিতেছেন’ বা ‘বিনামূল্যে একটি আইফোন দেয়ার জন্য আপনাকে নির্বাচন করা হয়েছে’, তাহলে জোর সম্ভাবনা আছে আপনি ‘ওয়েলকাম পার্টি’র খপ্পরে পড়েছেন। এদের এই লোভের ফাঁদে যদি আপনি পা দেন তাহলে পরবর্তী ধাপেই আপনাকে বলা হবে, পুরষ্কারের অর্থ বা পণ্য পেতে আপনাকে কিছু অর্থ খরচ করতে হবে।

ঢাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এরকম ‘লটারিতে জেতা’ একটি স্মার্টটিভি পাওয়ার জন্য প্রতারক চক্রকে বিকাশ মারফত দুই দফায় হাজার দশেক টাকাও দিয়ে ফেলেছিলেন। পরে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের হস্তক্ষেপে ভুল বুঝতে পেরে রণেভঙ্গ দেন।

ডুমাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই নদী ফরিদপুরকে মাগুরা থেকে আলাদা করেছে। আবার রাজবাড়ীর জেলার শেষ সীমাও এখানে। গড়াইয়ের এপারে ডুমাইন, ওপারে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা। গড়াইয়ের যেপাড়ে ডুমাইন, তার পাশেই রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নাড়ুয়া ইউনিয়ন।

মধুখালী থানার পুলিশ বলছে, এসব এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ‘টোপ পার্টি’র কার্যক্রম।

এরা মূলত বিকাশ প্রতারক। একসময়ে নানা ছলেবলে ওটিপি হাতিয়ে নেবার মাধ্যমে প্রতারণা করা হতো মোবাইল প্লাটফর্মের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহারকারীদের সাথে। তবে সম্প্রতি বিকাশসহ কিছু মোবাইল প্লাটফর্মের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার পর ওটিপি হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করা কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে।

এখন এরা মূলত সম্ভাব্য শিকারদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্টে ভুলে কিছু টাকা চলে গেছে। শিকার তাদের ফাঁদে পা দিলে টাকাটা ফেরত পাঠায় এবং এক পর্যায়ে বুঝতে পারে সে প্রতারণার শিকার হয়েছে।

বেশিরভাগ প্রতারণার অভিযোগই বিকাশ-কে ঘিরে
যদিও মোবাইলে অর্থ লেনদেনের বেশ কিছু প্লাটফর্ম আছে বাংলাদেশে, কিন্তু সবচেয়ে পুরনো এবং নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় প্লাটফর্মটি হচ্ছে বিকাশ। বাংলাদেশে মোবাইল প্লাটফর্মে অর্থ লেনদেন করে এমন প্রায় দশ কোটি গ্রাহকের অর্ধেকর বেশিই বিকাশের গ্রাহক।

বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই এই বিকাশ-কেন্দ্রিক। পুলিশ বলছে, তাদের কাছে এ ধরণের যত অভিযোগ আসে তার বেশিরভাগই দেখা যায় বিকাশের অর্থ হাতিয়ে নেবার ঘটনা। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম।

এককালীন পাসওয়ার্ড বা ওটিপি হাতিয়ে নেবার মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এত বেড়ে গিয়েছিল যে মোবাইল লেনদেনের প্লাটফর্মগুলো রীতিমত তটস্থ হয়ে ছিল।

প্রতারিত বা প্রতারণার চেষ্টার শিকার হননি, এমন বিকাশ ব্যবহারকারী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। বিবিসিতেই আমার একজন সহকর্মী বলছিলেন, তিনি অন্তত দুবার প্রতারকদের ফোনকল পেয়েছেন। আরেকজন সহকর্মীর পরিবারের একজন সদস্য গতবছরই বেশ কিছু টাকা খুইয়েছিলেন প্রতারক চক্রের কাছে।

বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্কভিত্তিক প্রথম আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান বিকাশ-এর রয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ গ্রাহক।

প্রতারণার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় পুলিশের তরফ থেকে ক্রমাগত চাপ দেয়া হচ্ছিল বিকাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য।

এক পর্যায়ে বিকাশ ২০২০ সালের শেষভাগে তাদের নিরাপত্তা ফিচারে কিছু পরিবর্তন আনে, যার পর ওটিপি হাতিয়ে নেবার মাধ্যমে প্রতারণা বেশ কমে এসেছে। কিন্তু ভুল বুঝিয়ে বা ছলেবলে অর্থ হাতিয়ে নেবার ঘটনা এখনো ঘটছে বলে বিবিসির কাছে স্বীকার করেন বিকাশের মুখপাত্র শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম।

বিবিসির কাছে পাঠানো লিখিত বিবৃতিতে বিকাশ জানাচ্ছে, তাদের দৈনিক গড়ে যে ৭০-৮০ লাখ লেনদেন হয় তার মধ্যে খুব কমই প্রতারণামূলক লেনদেন, তবে প্রতারণার ঘটনাগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যে ফরিদপুর এলাকায় ঘটছে সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল প্রতিষ্ঠানটি।

বিকাশ জানাচ্ছে, প্রতারণা ঠেকাতে তাদের বড়সড় একটি দল রয়েছে যারা নির্দিষ্ট সময় পরপর সন্দেহভাজন লেনদেনগুলোর তালিকা তৈরি করে পুলিশের কাছে সরবরাহ করে এবং প্রয়োজনে সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দেয়।

ঈদের সময় অর্থ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রতারণার ঘটনাগুলোও বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলছেন, “যারা ধরা খান তাদের মূলত সচেতনতার অভাব রয়েছে”। এসব কারণে বিস্তৃত সচেতনতামূলক কর্মসূচী রয়েছে বিকাশের, যার আকার তাদের বিজ্ঞাপন ও বিপণন প্রচারণার চাইতেও বড়, বলছিলেন মি. ডালিম।

পুলিশের ভাষায়, ভাঙ্গার আজিমনগরে রয়েছে একদল ‘স্মার্ট’ প্রতারক, যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী এবং তাদের বেশিরভাগ শিকার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা।

প্রতারণা চক্রের গোড়াপত্তন যেভাবে:
ফরিদপুরের পুলিশের কাছে এই মুহূর্তে দুটি তালিকা রয়েছে, যার মধ্যে একটি তালিকায় ডুমাইন ইউনিয়নের অন্তত দুইশ জন সন্দেহভাজনের নাম রয়েছে। আর ভাঙ্গার রয়েছে ৫৭ জনের নামের তালিকা।

তবে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান বলছেন, ভাঙ্গার তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। এটি আজিমনগর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণপাড়া নামে একটি গ্রামের সন্দেহভাজনদের আংশিক তালিকা মাত্র। এই উপজেলার প্রকৃত সন্দেহভাজনদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

তবে মধুখালী, বালিয়াকান্দি ও শ্রীপুরে যাদের নাম আসে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বিকাশ বা অন্যান্য মোবাইল অর্থ লেনদেনের প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীদের সাথে প্রতারণা করে।

‘আমি বিকাশ থেকে বলছি, আপনার অ্যাকাউন্টে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা আছে। আপনি যদি সমস্যাগুলো ঠিক করতে চান তাহলে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে’ ….. এভাবেই শুরু হয়, কেউ এদের ফাঁদে পা দেয়, কেউ দেয় না, বলছিলেন ইন্সপেক্টর শাহজালাল।

ঢাকার সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগে প্রায় চার বছর ধরে কাজ করছেন এস এম শাহজালাল। তিনি মূলত মোবাইলে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগগুলো তদন্ত করেন।

“অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষকে ধরা খেতে দেখেছি। আর্মি অফিসার, ডাক্তার, প্রশাসনের ক্যাডার…. এমনকি পুলিশ অফিসারও পেয়েছি আমি, যারা এদের প্রতারণার শিকার হয়েছে”। বলছিলেন ইন্সপেক্টর শাহজালাল।

তিনি বলছেন, তিনি গত চার বছরে অন্তত কুড়িবার শুধুমাত্র মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নেই অভিযান চালিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি অভিযুক্তদের আটক করতে সমর্থ হয়েছেন বলে জানান।

তবে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে শুধুমাত্র যারা প্রতারিত হবার পর থানায় গিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করছেন, তাদের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেই। কিন্তু একটি বিরাট সংখ্যক মানুষই প্রতারিত হওয়ার পর ঘটনা চেপে যাচ্ছেন হেয় হবার আশঙ্কায় কিংবা অনেকে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চান বলে। সেসব ক্ষেত্রে প্রতারকেরা নিঃসন্দেহে পার পেয়ে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন মানুষকে প্রতারণার শিকারে পরিণত করছে।

এই এলাকায় প্রতারণার পেশায় যুক্ত থাকার মাধ্যমে অনেকেই বিত্তশালী হয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেন মি. শাহজালাল।

ভাঙ্গায় কবে কীভাবে এই প্রতারণার কর্মকাণ্ডের শুরু হয়েছিল তা স্পষ্ট জানা যায় না। তবে মধুখালীর পুলিশ, ডুমাইনের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আর ঢাকায় বসবাসরত কয়েকজন ডুমাইনবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এক যুগের কিছু বেশি আগে প্রতারণার শুরু হয়েছিল মোবাইল টপআপ- বা ফ্লেক্সিলোড প্রতারণার মাধ্যমে।

ডুমাইনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই নদীর দুপাশের সৌন্দর্য নিয়ে এলাকার মানুষদের যথেষ্ট গর্ব আছে। এই নদীর পাড়ে একটি মেহগনি বাগানে অস্থায়ী চালাঘর বানিয়ে দশ-বারোজন যুবক প্রথম গড়ে তুলেছিল প্রতারক চক্র। তারা দিনভর সেখানে আড্ডা দিত এবং মোবাইল ফোনের কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি সেজে কেতাদুরস্ত ভাষায় কথা বলে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে মোবাইল ফোনে টপ-আপ করিয়ে নিত।

একসময় যখন এলাকার অন্যরা দেখলো, যে এদের অবস্থা বদলে যাচ্ছে, মাটির ঘরের জায়গায় উঠছে সুদৃশ্য টাইলস লাগানো দালান-কোঠা, তখন লোভ ছড়িয়ে পড়লো গ্রামের আরো মানুষের মধ্যে।

২০১১ সালে বাংলাদেশে মোবাইলে অর্থ লেনদেনের প্রথম প্ল্যাটফর্ম বিকাশ আত্মপ্রকাশ করলে গড়াই নদীর ওপারে মাগুরার শ্রীপুর আর রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতেও বিস্তার লাভ করে ‘টোপ পার্টি’র রমরমা বাণিজ্য।

“ডুমাইনে একসময় যারা ভ্যান চালাতো, এখন তাদের দালানবাড়ি”, বলেন মি. শাহজালাল। তদন্ত করতে গিয়েই তিনি দেখেছেন, প্রতারণার পেশা এই এলাকায় এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যে অনেক প্রবাসী শ্রমিকও দেশে ফিরে এসেছে প্রতারক চক্রে যোগদান করতে।

ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ খুরশীদ আলম মাসুমও বলছিলেন, গত দশ বছরে তিনি তার এলাকার সন্দেহভাজন এবং বিভিন্ন মামলায় নাম আসা ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে কীভাবে বিত্তশালী হয়ে উঠতে দেখেছেন।

তিনি বলছেন, গত দশ বছরে তার ইউনিয়নেই অন্তত ৫০টি ঝাঁ চকচকে দালান উঠেছে, যারা তেমন একটা বিত্তশালী ছিলেন না এবং এখনও তাদের উল্লেখ করার মতো কোনো সৎ উপার্জনের উৎস নেই।

“তাদের বাড়িঘর দেখলে আমার মনে হয় আমার বাড়িটি আমি ভেঙে ফেলি”, বিবিসিকে বলছিলেন মি. আলম। তিনি মনে করেন এসব বাড়ির মালিকদের সবাইই ডিজিটাল প্রতারণার সাথে যুক্ত এবং এভাবে তারা বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন অল্পদিনের মধ্যেই।

এদিকে, ইন্সপেক্টর শাহজালাল বাংলাদেশের আরো কিছু এলাকার কথা উল্লেখ করেন, বিশেষ করে নাটোরের লালপুর, ভোলা এবং গাজীপুরের কিছু এলাকার কথা বলেন, যেখানে মূলত বিকাশ প্রতারক চক্রের কার্যক্রম আছে। গাইবান্ধার ‘জ্বীনের বাদশা’ নামে আরেকদল প্রতারকের কথা উল্লেখ করছিলেন তিনি। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, এসব চক্রের সদস্যদের সাথেও ‘ভাঙ্গা পার্টি’র কোন না কোনভাবে যোগসাজশ রয়েছে।

হয় তাদের কোন না কোন সদস্যের স্থায়ী ঠিকানা ফরিদপুরের উল্লেখিত এলাকাগুলোতে নয়তো তারা ওই এলাকার সন্দেহভাজন প্রতারকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে, তথ্য আদান-প্রদান করে, বলেন মি. শাহজালাল।

এই এলাকার এসব প্রতারকরা স্থানীয় একশ্রেণীর প্রভাবশালীদের আশ্রয় প্রশ্রয় পায় বলেও অভিযোগ আছে। এমনকি পুলিশের কোন কোন পর্যায়ের সদস্যদের প্রশ্রয়ও তারা পেয়েছে বলে বিবিসির কাছে স্বীকার করেন ফরিদপুরের এসপি মোঃ আলিমুজ্জামান।


ভাঙ্গা বা মধুখালীর এসব গ্রামের অনেক বাসিন্দাই ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়াকে কোন অপরাধ মনে করেন না।

অভিযুক্তরা কী বলছেন?
পুলিশের তালিকা থেকে পাওয়া কয়েকজন সন্দেহভাজনের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম আমি। পাঁচ জনের সাথে কথা হয় আমার। তিনজন ভাঙ্গার, দুইজন মধুখালীর।

সবাইই প্রতারণার সাথে সংস্রব থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। দুজন বলেছেন তারা ফরিদপুর জেলাতেই আর থাকেন না।

একজন বলছিলেন তিনি একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদের ভাই। এলাকায় থাকেন না। অন্যত্র ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। কথিত ‘টোপ পার্টি’র সাথে কখনই সংস্রব ছিল না তার।

‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শত্রুতাবশত আমার কথা বলে থাকতে পারে’, বলছিলেন তিনি। তিনি আসলেই এই অপরাধের সাথে যুক্ত কি না, সেটা বিবিসির তরফ থেকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায়নি, তাই তার পরিচয় গোপন রাখা হলো। বাকীদের পরিচয়ও গোপন রাখছি একই কারণে।

কিন্তু যাদের সাথে আমার কথা হয়েছে, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, তাদের এলাকায় এ ধরণের প্রতারণার ঘটনা ঘটে এবং বহু মানুষ প্রতারণার সাথে যুক্ত।

তবে মধুখালীর যাদের সাথে কথা হয়েছে আমার, তাদের একজন বলছিলেন, ‘টোপ পার্টি’র সাথে জড়িত ছিল, এমন বেশিরভাগ মানুষই সেখানে ভাল হয়ে গেছে।

“কেউ অটোরিকশা কিনে চালাচ্ছে, কেউ ভ্যান চালাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ভাল হয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার করার পরও ভাল হয়নি”, বলছিলেন এই ব্যক্তি।

ডিজিটাল প্রতারণা এখানে একটা ‘ইন্ডাস্ট্রি’:
এই প্রতিবেদনের জন্য যেসব পক্ষের সাথে আমার কথা হয়েছে, তারা সবাই একবাক্যে একটি কথা আমাকে বলেছেন, ভাঙ্গা বা মধুখালীর এসব গ্রামের অনেক বাসিন্দাই ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়াকে কোন অপরাধ মনে করেন না।

আমি যখন এই প্রতিবেদন নিয়ে খোঁজখবর শুরু করি, তার প্রথম দিকেই ঢাকায় সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম আমাকে বলেছিলেন, “এটা যে একটা ক্রাইম, এই বিবেকবোধ এদের নেই। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রির মত হয়ে গেছে”।

ডুমাইনের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ খুরশীদ আলম মাসুম বলছেন, অভিযুক্তদের বেশিরভাগই সাধারণত পরিবারের সমর্থন পায়। মি. আলমের ভাষায়, “আমি যখন লক্ষ লক্ষ টাকা আমার বাবাকে দেবো, আমার বাবাও আমাকে সাপোর্ট দেবে”।

একই কথা বলছিলেন ডুমাইন থেকে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী শেখ খলিলুর রহমান। “অভিযুক্তদের অভিভাবকদের অনুশোচনা বোধ বা লজ্জাবোধ একেবারেই নেই”, বলেন মি. রহমান।

প্রতারণার বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে ১৮ই ডিসেম্বর ২০২০-এ ডুমাইনে প্রথম একটি সুধী সমাবেশে উপস্থিত হন স্থানীয় গণ্যমান্যরা এবং পুলিশের কর্মকর্তারা।

মধুখালীর ডুমাইনের বাসিন্দা শেখ খলিলুর রহমান প্রায় দু দশক ধরে ঢাকায় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ব্যবসার সাথে জড়িত । বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, তার এলাকার একটি বড় সংখ্যক মানুষ ডিজিটাল প্রতারণা করতে করতে এক পর্যায়ে মাদক বেচাকেনার সাথেও যুক্ত হয়ে যায়। এরই এক পর্যায়ে তারা ‘ডুমাইন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ গঠন করেন, যার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।

“আমরা দেশে না থাকতে পারি, কিন্তু বছরে দুচারবার তো যাই। আমাদের আত্মীয়স্বজন সেখানে থাকে। আমরা চাই যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারি”, বলেন মি. রহমান।

কিছু সন্দেহভাজনের আত্মসমর্পণ:
মি. রহমানের নেতৃত্বাধীন ডুমাইন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি ফরিদপুরের পুলিশের সাথে মিলে গত বছর ডিসেম্বর মাসে একটি সুধী সমাবেশ ডাকেন।

এসময় পুলিশের হাতে ছিল ‘টোপ পার্টি’র দুইশ সন্দেহভাজন সদস্যের তালিকা। তারা গভীর রাত পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টাব্যাপী ওই সমাবেশে গ্রামবাসীকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। এবং সন্দেহভাজনদের ভাল হয়ে যাওয়ার জন্য এক মাস সময় বেধে দেন।

এক মাসের মাথায় গত ১৮ই জানুয়ারি তালিকার ৯৫ জন ব্যক্তি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রতিশ্রুতি দেন যে তারা আর প্রতারণার সাথে যুক্ত থাকবেন না।

এরপর পুলিশ এই ৯৫ জনকে নজরদারিতে রাখে এবং বাকী সন্দেহভাজনদের বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে আটক করে।

একই রকম একটি সুধী সমাবেশ ভাঙ্গাতেও করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে যাওয়ায় আর ফলোআপ করা যায়নি।

প্রায় চার মাস পর এসে দেখা যাচ্ছে ডুমাইনে ‘টোপ পার্টি’র প্রতারণার অভিযোগ বেশ কমে এসেছে। তবে ভাঙ্গায় ‘ওয়েলকাম পার্টি’র কার্যক্রম চলমান, পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি নেই।

এসপি মি. আলিমুজ্জামান বলছেন, “ডুমাইনে শেষ হয়েছে বলব না। তবে নিয়ন্ত্রণে আছে। অভিযোগ খুব একটা আসে না, যেটা ভাঙ্গা নিয়ে এখনো আসে”।

২০২১ সালের প্রথম চারমাসে ফরিদপুরেই এ ধরণের সাতটি মামলা হয়েছে যাতে ৩৭ জনকে আসামী করা হয়। মি. আলিমুজ্জামান বলছেন, এদের মধ্যে ত্রিশ জনের বেশি আসামীকেই তারা গ্রেপ্তার করেছেন।

ঢাকায় সিটিটিসি’র সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের নাজমুল ইসলাম মানুষকে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলছেন, পুলিশ এ ব্যাপারে নিয়মিতভাবেই সতর্কীকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী চালাচ্ছে।

“নিজেরা সতর্ক থাকলে প্রতারকেরা সুবিধা করতে পারবে না”, বিবিসিকে বলেন মি. ইসলাম।

সুত্র: বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন...