শিয়ালের সঙ্গে মানুষের মিতালি

‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে’—প্রচলিত দুই লাইনের এই ছড়া শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে আসলেই কি খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে হয়? মানুষের কাছে অতি ধূর্ত এ প্রাণীর বিয়ে হলেও হয়তো তাতে শামিল হওয়া যাবে না। কেননা লোকালয়ের কাছাকাছি বসবাস করা শিয়ালের সঙ্গে মানুষের তেমন সখ্য নেই। অরণ্য কেটে লোকালয় বাড়ার কারণে ক্রমেই এদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে।
তবে প্রচলিত ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খ্যাঁকশিয়ালের সঙ্গে মিতালি গড়ে তুলেছেন নওগাঁর বদলগাছীর সোমপুর বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু। বিশ্ব ঐতিহ্য নওগাঁর সোমপুর বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। সন্ধ্যা নামলেই এখানে শিয়ালের দল গর্ত থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে আসে। জড়ো হয় ডাকবাংলোর সামনে। অপেক্ষা কখন আসবে তাদের মনিব ফজলুল করিম আরজু। কারণ প্রতিদিনই রাতে শিয়ালের জন্য খাবার নিয়ে হাজির হন তিনি। এভাবেই ধীরে ধীরে শিয়ালের সঙ্গে আরজুর সখ্য গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুক্রবার রাত ১০টা। বিহারের ভেতরে ডাকবাংলোর সামনে অপেক্ষায় রয়েছে ২০-২৫টি খ্যাঁকশিয়াল। কিছুক্ষণ পর হাতে অনেক পাউরুটি ও রান্না করা খাবার নিয়ে ডাকবাংলোর সামনে এসেছেন পাহাড়পুর বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু। খাবার দিয়ে শুরু হয় কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা। সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালের ডাকাডাকি। ডাক শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে আরও বেশ কয়েকটি শিয়াল। প্রায় প্রতিদিনের চিত্র এটি। মানুষের ভালোবাসায় এভাবেই তৈরি হয় প্রায় অসম্ভব এক সখ্য। দারুণ এ মেলবন্ধন আসলে দেখার মতো এক দৃশ্য।
শুক্রবার রাতে দৃশ্যটি দেখতে আসেন বদলগাছি থানার ওসি আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শিয়ালের সঙ্গে তিনি (আরজু) যে সখ্য গড়ে তুলেছেন, সেটি দেখে আমি সত্যিই অভিভূত।’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাহাড়পুর বিহারজুড়ে প্রায় অর্ধশত খ্যাঁকশিয়ালের বসবাস। মাটির ঢিবিতে গর্ত করে বসবাস করে আসছে এরা। বছর দু-এক আগে পাহাড়পুর বিহার ও জাদুঘরে যোগদান করেন আরজু। যোগদানের পর থেকেই পদক্ষেপ নিতে একদম দেরি করেননি প্রাণী ও প্রকৃতিপ্রেমী আরজু। খ্যাঁকশিয়াল এখন খুব কমই দেখা যায়। প্রায় বিলুপ্তির দিকে যাত্রা করা এই প্রাণীর বংশবিস্তারে এগিয়ে এলেন তিনি। নিরাপদ করলেন শিয়ালের আবাসস্থল।
কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু বলেন, ‘ক্ষুধা পেলেই বাসার দরজায় এসে শব্দ করে, ডাকাডাকি করে ওরা। লকডাউনে দীর্ঘদিন বিহার ও জাদুঘর বন্ধ ছিল। তাই দর্শনার্থীর আগমন ছিল না। ফলে চরম খাবারসংকটে পড়েছিল খ্যাঁকশিয়ালগুলো। কিন্তু এদের কাউকেই অভুক্ত থাকতে হয়নি। ক্ষুধার্ত শিয়ালগুলোর জন্য আলাদা করে চাল কিনে রান্না করা ভাত, খিচুড়ি ও পাউরুটি খেতে দেওয়া হয়েছিল। এখনো প্রতিদিন খেতে দিতে হয়। শিয়ালগুলোকে খাবার দিতে আমার খুবই ভালো লাগে।’
এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করে আসছেন বিহারের সাইট পরিচালক সারোয়ার হোসেন ও স্থানীয় আরও কয়েকজন। তাঁরাও খাবার দেন। ভালো মনের অধিকারী এসব মানুষের ডাকেও সাড়া দেয় শিয়ালগুলো। অল্পদিনেই শিয়ালগুলোকে পোষ মানিয়ে ফেলেছেন বলে জানান তাঁরা। বিহারের সাইট পরিচালক সারোয়ার হোসেন বলেন, শিয়াল হিংস্র হলেও শিয়ালের হিংস্র আচরণ কখনোই তাঁদের চোখে পড়েনি। ভালোবাসায় সব হিংস্রতা জয় করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন...